মাদারীপুর: খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয়। ক্রাচে ভর দিলে সেই গতি কিছুটা বাড়ে।
মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার শিরুয়াইল ইউনিয়নের পূর্বকাকৈর এলাকার পল্লী চিকিৎসক হুমায়ুন কবির খানের দুই ছেলের মধ্যে বড় সাহাদাত হোসেন মিশন। ঢাকায় ইন্টেরিয়র ডিজাইনের কাজ করতেন তিনি। ১৯ জুলাই সরাসরি আন্দোলনে যোগ দেন। প্রথম দিনই রাবার বুলেটে আহত হন। এরপর ৪ আগস্ট দ্বিতীয় দফায় গুলির আঘাতে ভেঙে যায় অপর পা। দীর্ঘ ১০ মাস ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে বাড়ি ফিরেছেন তিনি। তবে আর কাজ করা সম্ভব হয়নি। থমকে গেছে তার স্বাভাবিক জীবন, থেমে গেছে উপার্জনের চাকাও। এখন দিন কাটছে বাড়ি, নিজ ঘরে। অপেক্ষা, পরিপূর্ণ সুস্থ হওয়ার! সরকার যেন তার মতো অসংখ্য আহত জুলাইযোদ্ধাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে শিগগিরই, এমনটাই তার দাবি।
সরেজমিনে আহত সাহাদাত হোসেন মিশনের বাড়ি গিয়ে দেখা গেছে, বাড়ির পাশের রাস্তায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন তিনি। সারাক্ষণ ঘরের মধ্যে বসে থাকতে ভালো না লাগায় মাঝে মধ্যেই বাড়ির বাইরে বের হন বলে জানান তিনি।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আহত সাহাদাত হোসেন মিশন বলেন, ১৮ জুলাই কাজের জন্য আমি চট্টগ্রামে ছিলাম। ঢাকার অবস্থা ফেসবুকে দেখি। তখনও ইন্টারনেট ছিল। আন্দোলনের শুরু থেকেই আমি স্বৈরাচার হটানোর পক্ষে ছিলাম। মনে মনে প্রার্থণা করতাম স্বৈরাচারের অবসান হোক এ দেশে। এরপর আন্দোলন যখন বেগবান হচ্ছে, তখন আর নিজেকে আটকে রাখতে পারিনি। ওই রাতেই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হই। ১৯ জুলাই, ঢাকায় ফিরে সরাসরি আন্দোলনকারীদের সাথে যোগ দেই। তখন আমি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে যাই। ছাত্রদের সঙ্গে মিশে যাই আন্দোলনে। তুমুল আন্দোলন, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলছে। তাদের সঙ্গে রামপুরার দিকে যখন যাই, তখনই পুলিশের গুলি বর্ষণ। রাবার বুলেট লাগে ডান পায়ে। বাসায় ফিরে যাই ওই অবস্থায়। চিকিৎসা নিয়ে কিছুটা সুস্থ হয়ে কাজ শুরু করি। কাজ শেষে আন্দোলনে যাই, খোঁজখবর রাখি নিয়মিত।
তিনি বলেন, এরপর ৪ আগস্ট আন্দোলন যখন তুমুল পর্যায়ে। তখন বন্ধুদের নিয়ে বেড়িয়ে পড়ি। যোগ দেই আন্দোলনে। প্রথমে শাহাবাগ পিজি হাসপাতালের ওখানে যাই। তখন হাসপাতালে আগুন জ্বলছিল। সেখান থেকে আমরা বিকেল ৫টার দিকে তেজগাঁও-কারওয়ান বাজারের মাঝামাঝি স্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছিলাম। স্বৈরাচার হটানোর স্লোগানে স্লোগানে রাজপথ তখন উত্তাল। মনে হচ্ছে জয়ের দ্বার প্রান্তে আমরা! ওই মূহূর্তে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ-বিজিবির গুলিবর্ষণ শুরু হয়। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলছে। এরই মধ্যে পর পর দুটি বুলেট এসে বিদ্ধ হয় বাম পায়ে। মুহূর্তেই ভেঙে টুকরো হয়ে যায় বাম পা! সেই থেকে ১০ মাস হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলাম। কাজ করতে পারি না। জুলাই ফাউন্ডেশন, মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়সহ সরকারি-বেসরকারি অনুদান পেয়েছি। কিন্তু আমাদের মতো আহতদের স্থায়ী কর্মসংস্থান দরকার। বর্তমান সরকারের কাছে এ দাবি জানাচ্ছি। যাতে করে আমরা ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারি।
আহত সাহাদাত হোসেন মিশনের বাবা মো.হুমায়ুন কবির খান বলেন, ৪ আগস্ট বিকেলে ওর গুলি লাগার ২-৩ মিনিট আগে আমি ফোন দেই ছেলেকে। আমার ছেলে বলে, আব্বা আমার লাশ খুঁজতে আইসেন না। আমার জীবন আমি দিয়ে দেবো, তবুও রাজপথ ছাড়বো না! আমার ছেলে পরিবারের ভরণপোষণের একজন ছিল। আজ গুলি লেগে পঙ্গু হয়ে আছে। আমার ছেলের জন্য সরকার কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা দিক,এখন এটাই একমাত্র চাওয়া।
দুপুরের তপ্তরোদ তখন মাথার ওপর। টগবগে তরুণের দুই বাহুর নিচে ক্রাচ! তাতে ভর দিয়ে শ্লথ গতিতে হেঁটে বাড়ির বাইরে এলেন বাংলানিউজের এই প্রতিবেদককে বিদায় জানাতে। চোখের মধ্যে পানি চিক চিক করছে তার। চোখে-মুখে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন। চিকিৎসকের আশ্বাস আর মানুষের দোয়া নিয়ে পরিপূর্ণভাবে সুস্থ হবার আশায় দিন গুনছেন কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে থাকা আহত জুলাইযোদ্ধা মিশন!
জেএইচ/এএটি