ঢাকা, মঙ্গলবার, ২০ শ্রাবণ ১৪৩২, ০৫ আগস্ট ২০২৫, ১০ সফর ১৪৪৭

সারাদেশ

জুলাইগাথা

অভ্যুত্থানের রণক্ষেত্র লক্ষ্মীপুরে ৪ আগস্ট যা ঘটেছিল

মো. নিজাম উদ্দিন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮:৪০, আগস্ট ৪, ২০২৫
অভ্যুত্থানের রণক্ষেত্র লক্ষ্মীপুরে ৪ আগস্ট যা ঘটেছিল জুলাই অভ্যুত্থান

স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১ দফা দাবিতে উত্তাল যখন সারাদেশ, সেই রেশ ধরে লক্ষ্মীপুরও ছিল বেশ উত্তাল।  

৪ আগস্ট ২০২৪।

এদিন সকাল ১১টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীরা অবস্থান নেয় লক্ষ্মীপুর-ঢাকা মহাসড়কের ঝুমুর চত্বরে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় সাধারণ লোকজনও।  

এদিকে আন্দোলনকারীদের প্রতিহত করতে সকালে জেলা শহরের উত্তর তেমুহনী এলাকায় অবস্থান নেয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা।  

তাদের নেতৃত্বে ছিলেন জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি ও সদর উপজেলা পরিষদের অপসারণকৃত চেয়ারম্যান একেএম সালাহ উদ্দিন টিপু। যিনি আলোচিত পৌর মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা প্রয়াত আবু তাহেরের মেঝো ছেলে।  

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীরা যখন ঝুমুর চত্বরে বিক্ষোভ করে, তখন উত্তর তেমুহনী থেকে তাদের ওপর হামলার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগের লোকজন এগিয়ে আসে। শহরের বাগবাড়ি এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সাধারণ ছাত্র-জনতার ওপর হামলা করে। তবে সেখানে আন্দোলনকারীদের সংখ্যা ছিল একেবারে কম। আওয়ামী লীগের লোকজন হামলার উদ্দেশ্যে ঝুমুর চত্বরের দিকে এগিয়ে আসে। জেলা জজ আদালতের সামনে আসার পরেই আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। এলাকা হয় রণক্ষেত্র। আহত হয় অনেকে। চলতে থাকে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীদের ধাওয়ায় পিছু হটে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তারা মাদাম ব্রিজের পশ্চিম পাশে অবস্থান নেয়। আর আন্দোলনকারীদের অবস্থান ছিল ঝুমুর থেকে পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সামনে মহাসড়কের ওপর। দুইদিক থেকে বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। থেমে থেমে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনাও ঘটে। তবে মাদাম ব্রিজের পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে আওয়ামী লীগের অস্ত্রধারীরা। এতে সেখানে আন্দোলনকারীদের কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়। সাদ আল আফনান নামে এক আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হলে তাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেওয়ার পথে দুপুরের দিকে মারা যায়। তার মৃত্যুর খবরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলনকারীদের মধ্যে।  

এদিকে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার ধাওয়ায় পিছু হটে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। যুবলীগ নেতা একেএম সালাহ উদ্দিন টিপুর নেতৃত্বে তারা শহরের তমিজ মার্কেট এলাকায় অবস্থান নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। আন্দোলনকারীদের একটি অংশ উত্তর তেমুহনী হয়ে শহরের তিতাখাঁ জামে মসজিদের সামনে অবস্থান নেয়। আরেকটি অংশ রেহান উদ্দিন ভুঁইয়া সড়ক হয়ে মোরগহাটা এলাকায় অবস্থান নেয়। বিকেলে দুইদিক থেকে যখন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ঘিরে ফেলা হয়, তখন তারা অবস্থান নেয় তমিজ মার্কেটের টিপুর বাসভবনের ছাদে। সেখান থেকে টিপুর নেতৃত্বে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে অনবরত গুলিবর্ষণ করা হয়। বিকেলে টিপুর বাসভবনের ছাদ থেকে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি করার একটি ফুটেজও ছড়িয়ে পড়ে।  

তাদের গুলিতে আহত হতে থাকে আন্দোলনকারীরা। সহযোদ্ধারা তাদের উদ্ধার করে সদর হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যায়। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে জেলা সদর হাসপাতালে আন্দোলনকারী তিন শিক্ষার্থীর লাশ নিয়ে আসা হয়। তারা হলেন- সদর উপজেলার উত্তর জয়পুর ইউনিয়নের বাসিন্দা ও লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী কাউছার আহমেদ বিজয়, রায়পুর উপজেলার দক্ষিণ রায়পুর গ্রামের বাসিন্দা ও শিক্ষার্থী ওসমান গণি ও সদরের ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের বাসিন্দা ও দালালবাজার ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী সাব্বির আহমেদ।  

দিনভর হামলা ও গুলিতে আন্দোলনকারীদের মধ্যে অন্তত চার শতাধিক আহত হয়। এদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয় আড়াই শতাধিক। আহতদের জেলা সদর হাসপাতালসহ শহরের বিভিন্ন ক্লিনিকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। তবে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ায় অনেক হাসপাতালে ঠিকমতো চিকিৎসাও পায়নি আহতরা। গুরুতর আহতদের পাঠানো হয় ঢাকায়।

এদিকে টিপুর বাসভবন থেকে পালাতে গিয়ে গণপিটুনিতে হামলাকারী আটজন নিহত হয়। এরা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মী।  

এদিন সন্ধ্যায় যুবলীগ নেতা টিপুর যে বাসভবনের ছাদ থেকে গুলি করা হয়, ওই বাসভবন এবং এর উল্টো পাশে তার আরেকটি বাসভবনে আগুন লাগিয়ে দেয় ছাত্র-জনতা। বাসভবনের ছাদ থেকে কৌশলে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় টিপুসহ তার বেশ কয়েকজন সহযোগী। তবে সেখানে আরও বেশ কয়েকজন থেকে যায়। রাতভর নীচে অবস্থান নেয় আন্দোলনকারীরা। পরে রাত প্রায় ৩টার দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা ভবনের আগুন নিয়ন্ত্রণে এনে ছাদ থেকে প্রায় ২৫ জন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের উদ্ধার করে।  

বলা যায়, ৪ আগস্ট সকাল থেকে পরদিন ভোররাত পর্যন্ত জেলা শহর রণক্ষেত্র পরিণত হয়। উত্তেজনা ছিল জেলাব্যাপী। আর আহাজারি ছিল হতাহতদের স্বজনদের মধ্যে।  

সাদ আল আফনান নিহত হওয়ার ঘটনায় তার মা নাছিমা আক্তার বাদী হয়ে যুবলীগ নেতা একেএম সালাহ উদ্দিন টিপুসহ ৭৫ জনের নাম উল্লেখসহ আরও ৬০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে সদর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।  

অপরদিকে সাব্বির হত্যার ঘটনায় তার বাবা আমির হোসেন বাদী হয়ে পৃথক আরেকটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় টিপুসহ ৯১ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত ২০০ জনকে আসামি করা হয়।

আর কাউছার হত্যা মামলা দায়ের করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আদালতে। আর গণপিটুনিতে আটজনের মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে আরেকটি মামলা দায়ের করে।

এদিকে এসব মামলার এজাহারনামীয় এবং অজ্ঞাত কিছু আসামিদের গ্রেপ্তার করতে পারলেও ঘটনার মূলহোতা যুবলীগ নেতা একেএম সালাহ উদ্দিন টিপুকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। ৫ আগস্টের পর কৌশলে তিনি দেশ ত্যাগ করেন। তবে কোন দেশে তিনি অবস্থান করছেন, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুকে মাঝেমধ্যে সক্রিয় হন তিনি। ৪ আগস্টের ঘটনায় আহত আবদুল মতিন নামে একজন আন্দোলনকারী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক পিংকুকে আসামি করে সদর থানায় মামলা দায়ের করেন। কিন্তু হত্যা বা আহতের ঘটনায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়ন কোনো মামলার আসামি হননি। তবে তার বাসভবনে অগ্নিসংযোগ করা হয়। ৫ আগস্টের পর তিনিও আত্মগোপনে চলে যান। জনশ্রুতি রয়েছে, তিনিও বিদেশে পালিয়ে যেতে পারেন।  

এদিকে পুলিশ বলছে, ৪ আগস্ট হত্যা ও হামলার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারে পুলিশ তৎপর রয়েছে। আর হত্যা মামলাগুলো গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে।  

জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর-সার্কেল) মোহা. রেজাউল হক বলেন, ৪ আগস্ট শহরের মাদাম এলাকায় সাদ আল আফনান হত্যার ঘটনায় একটি মামলা ও তমিজ মার্কেট এলাকায় তিনজনকে হত্যার ঘটনায় পৃথক আরেকটি মামলা হয়েছে। দুই মামলায় ১৬৫ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ৭০০ থেকে ৮০০ জনকে আসামি করা হয়। সেপ্টেম্বর মাসের দিকে মামলাগুলো দায়েরের পর লাশ উত্তোলন করে ময়নাতদন্ত করা হয়। বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করা হয়। মামলাগুলোর বহুমুখী তদন্ত চলছে। গুরুত্বের সঙ্গে মামলাগুলো তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্তের অগ্রগতি অনেক ভালো।  

তিনি বলেন, এ পর্যন্ত ১৫৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে ফুটেজ শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৮ জনকে। অনেক এজাহারনামীয় আসামি আছে, আবার সাক্ষীদের মাধ্যমেও আসামি শনাক্ত করা হয়েছে। ভিডিও ফুটেজ ও সিসিটিভি ফুটেজ যাচাই-বাছাই করে আসামি শনাক্ত করা হয়েছে।

মোহা. রেজাউল হক বলেন, এখন পর্যন্ত ১১৩ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে, যাদের গ্রেপ্তার করা দরকার। ঘটনার সঙ্গে বেশ কয়েকজনকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি, অন্যরাও গা-ঢাকা দেয়। লক্ষ্মীপুরসহ জেলার বাহিরে এবং ঢাকাতেও গ্রেপ্তার অভিযান চালানো হয়েছে। পলাতক আসামিদের পাসপোর্ট এবং বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশনে চিঠি দেওয়া আছে, তারা যেন দেশের বাহিরে পালিয়ে যেতে না পারে। বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার সময় বিমানবন্দর থেকেও আসামি গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার অভিযান চলমান রয়েছে।  

আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

সারাদেশ এর সর্বশেষ