সিলেট: ‘ছেলেকে হাফেজ বানিয়েছিলাম, জানাজা পড়াবে বলে। কিন্তু সে আশা পূরণ হলো না।
নিহত পাবেল শহীদ ক্বারী মো. কামরুল ইসলাম পাবেল সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ঢাকাদক্ষিণ ইউনিয়নের কানিশাইল গ্রামের রফিক উদ্দিন ও দিলারা বেগম দম্পতির ছেলে।
বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপচারিতায় রফিক উদ্দিন বলেন, ‘আমার ৪ ছেলের মধ্যে ৩য় ছেলে কামরুল। তাকে হাফিজি শিক্ষা দিয়েছিলাম এ জন্যই যে, ‘মারা গেলে যাতে জানাজা পড়ায়। ’
তিনি বলেন, ঘটনার দিন ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সিলেট নগরে কোতোয়ালি থানা সংলগ্ন ঘড়ি ঘরের সামনে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় ক্বারী মো. কামরুল ইসলাম পাবেল। ওইদিন বিকেলে একটি ফোন আসে আমার ছেলে গুলি খাইছে। এরপর আরেক ফোন আসে আমার ছেলে আর এ দুনিয়ায় নেই। পুলিশের গুলিতে আমার ছেলে শহীদ হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত মামলার কোনো আসামি ধরা পড়ছে কিনা জানি না। যারা রাষ্ট্র চালায়, আসামিদের চিহ্নিত করে বিচার করার দাবি জানান তিনি।
শহীদ কামরুলের মা দিলারা বেগম বলেন, ছেলে আমার ডাইরি লিখতো। মারা যাওয়ার আগে লিখে গেছে-‘আমার জীবনের ঘটনা, আমার জীবনে যা ঘটেছে, তা আমার জীবনকে আলোকিত করেছে । ‘সত্যিই আমার ছেলে এ দেশের জন্য নিজের জীবন দিয়ে আলো ছড়িয়ে গেছে। সে প্রায়ই বলতো, ‘আম্মা আমি তোমারে ফালাইয়া কোনোখানো যাইতাম নায়। ’ আমি চাই আমার ছেলেরে যারা গুল্লিখরি মারছইন, বাচ্চায় কোরআন শরীফ পড়েছে, যে কোরআন শরীফ বুকে লইয়া গুল্লি খাইছে, যে কোরআন বুকের মাঝে রেকর্ড করা, এর বিচার আমি চাইয়ার। এক বছর অইগেছে, কোনো বিচার পাইছিনা। আমি চাই, সৎভাবে আমার বাচ্চার বিচার হোক। ’
কামরুলের স্মৃতিচারণ করে মা দিলারা বেগম আরও বলেন, ‘কামরুল প্রায়ই আমারে কইতো (বলতো), তোমার এক ফোয়া (ছেলে) মরলে কিচ্ছু অইতো নায়, আরো তিন ফোয়া আছে। ’ আমি মনে খরতাম (করতাম) হে (সে) ঢং করের (করছে)। ’
ওইদিন দুপুর ১২টা থেকে ১টার মধ্যে শেষবার কামরুলের সঙ্গে ফোনে কথা বলার স্মৃতি আওড়ায়ে তার মা বলেন- ‘মা আমার পিন্দিবার কাপড় নেই। এটা বলার পর আামর ভাইর বৌ বাথরুমে যায় তার কাপড় ধুয়ে দিকে। এরই ফাঁকে সে বাসা থেকে বেরিয়ে যায় বিজয় মিছিলে। যখন কথা হয়, ‘তখন বলছি, বাবা দোকান বন্ধ করিলাইছনি, চাইও বাইর হইয়া যাইবায়। ’ এরপর আমার ভাইর বউ ফোন দিয়ে কেঁদে বলে, পাবেল গুল্লি খাইছে। তখন ভাইজিও বলে ভাইয়া গুল্লি খাইছে। মনে করেছি, পায়ে-হাতে পড়েছে। পরে হুনি (শুনেছি) আমার ছেলে আর নেই। আশা করছিলাম, আমার বাচ্চায় (ছেলে) আমার জানাজা পড়বো, কিন্তু তার জানাজা দেখতে হয়েছে। ‘ কথা বলার সময় সন্তানের ছবি বুকে নিয়ে আহাজারি করেন দিলারা বেগম।
পাবেল নিহতের ঘটনায় ২২ আগস্ট আদালতে একটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় সাবেক এমপি হাবিবুর রহমান হাবিব, সাবেক প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী, শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, পুলিশ পরিদর্শক ইয়ারদোসসহ মোট ৫৬ জনের নামল্লোখ করে অজ্ঞাত ৩০০ জনকে আসামি করা হয়। কেননা, এজাহারে ঘটনাস্থল দক্ষিণ সুরমা এলাকা উল্লেখ করা হয়, যা ভুল ছিল। এরপর ওই দিনই পাবেলের বড় ভাই পিপলু বাদী হয়ে সিলেটের অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আরেকটি মামলা (সিআর-৯৮২/২৪) করেন। এ মামলায় কোতোয়ালি মডেল থানায় কর্মরত ৪৫ জন পুলিশ সদস্যকে আসামি করা হয়েছে।
পরিবারের সদস্যরা জানান, পাবেল শহীদ হওয়ার পর ডিসি, এসপি, ইউএনও ছাড়াও অনেক রাজনৈতিক নেতারা বাড়িতে ঘুরে যান। এ পর্যন্ত জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে ৫লাখ টাকা, সরকারি সঞ্চয়পত্রের ১০ লাখ ও জেলা পরিষদ থেকেও অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
ফিরে দেখা সেদিন: সারাদেশে শত সহস্রশহীদের আত্মদানের মাধ্যমে যখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিজয় অর্জিত হয়। সেদিন বিকেলে সৃষ্টি সুখের উল্লাসে যখন বিপ্লবীরা আত্মহারা। তখন নগরের সার্কিট হাউস এলাকায় একটি বুলেট কেড়ে নেয় শহীদ কামরুল ইসলাম পাবেলের প্রাণ। জয়ের আনন্দ বুকে নিয়েই ৫ আগস্ট বিকেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি। নিজের জীবনে আলো ছড়ানোর আগেই রাজপথের সংগ্রামে গিয়ে নিস্তব্দ হয়ে যান পাবেল। পাবেলের স্বপ্নের অভিযাত্রার এখানেই ইতি হয়ে যায়।
পাবেলের সঙ্গে থাকা সহকর্মী মাহিন বলেন, আমরা বিজয় মিছিলে অংশ নিয়ে বাসায় ফিরছিলাম। কীন ব্রিজের নিচে আসা মাত্র পাবেলের গায়ে গুলি লাগে। গুলিবিদ্ধ পাবেল মুহূর্তেই মাঠিতে লুটিয়ে পড়ে। উপস্থিত অনেকে এগিয়ে এসে পাবেলকে রিকশাযোগে ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসক পাবেলকে মৃত ঘোষণা করেন। পাবেল সিলেট নগরীর কাজিরবাজারে নানা বাড়িতে থাকতেন। ওই এলাকার নাজিম ভ্যারাইটিজ স্টোরে কর্মরত ছিলেন তিনি।
রফিক উদ্দিনের চার ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে পাবেল ছিলেন চতুর্থ। ছেলে পিপলু, টিপু সুলতান ও মেয়ে হালিমা আক্তার বিএ অধ্যয়নরত। নিহত পাবেল সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ঢাকা দক্ষিণ হোসাইনিয়া দারুল ওলুম মাদরাসা থেকে ২৮ পারা কোরআন হিফজ সম্পন্ন করেন। তিনি সিলেট জামেয়া মাদানিয়া ইসলামিয়া কাজির বাজার মাদরাসাও কিছুদিন পড়ালেখা করেন।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গোলাপগঞ্জের মানুষ যখন আওয়ামী লীগ পতনের সরকার আনন্দ স্রোতে ভাসছিল। তখন পাবেলের বাড়িতে চলছিলো শোকের মাতম। পাবেলের মৃত্যুর এক বছর পূর্ণ হলেও থামেনি বাবা-মায়ের কান্না।
এনইউ/জেএইচ