ঢাকা, সোমবার, ৭ আশ্বিন ১৪৩২, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

সারাদেশ

সাতক্ষীরা-৩: সীমানা পুনর্বিন্যাসে সম্ভাব্য প্রার্থীদের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ

শেখ তানজির আহমেদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬:০২, সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৫
সাতক্ষীরা-৩: সীমানা পুনর্বিন্যাসে সম্ভাব্য প্রার্থীদের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ ওপরে বাঁ থেকে রবিউল বাশার, শহীদুল আলম, আইয়ুব হোসেন, নিচে বাঁ থেকে আজিজুর রহমান, ইয়াসিন ও আলাউদ্দিন

সাতক্ষীরা: সংসদীয় আসনের চূড়ান্ত সীমানার গেজেট প্রকাশের পর বেশ অস্বস্তিতে পড়েছেন সাতক্ষীরা-৩ আসনের (কালিগঞ্জ-আশাশুনি) সম্ভাব্য সংসদ সদস্য প্রার্থীরা।  

এ আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাস হওয়ায় তাদের দীর্ঘদিনের নির্বাচনী প্রস্তুতি যেন গুলিয়ে গেছে।

ইসির সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি যেন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীরাও হয়ে পড়েছেন বিভ্রান্ত।

নির্বাচন কমিশনের তথ্য মতে, ১৯৮৪ সালে সাতক্ষীরা জেলা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত সাতক্ষীরা জেলায় পাঁচটি সংসদীয় আসন ছিল। এক্ষেত্রে জেলার আশাশুনি উপজেলা নিয়ে ছিল সাতক্ষীরা-৩ আসন। দেবহাটা ও কালিগঞ্জ উপজেলা নিয়ে ছিল সাতক্ষীরা-৪ আসন।

২০০৮ সালে তৎকালীন নির্বাচন কমিশন সাতক্ষীরা জেলা থেকে একটি আসন কমিয়ে চারটি আসন গঠন করে। তখন আশাশুনির সঙ্গে দেবহাটা উপজেলা ও কালিগঞ্জ উপজেলার চারটি আসন নিয়ে গঠন করা হয় সাতক্ষীরা-৩ আসন। আর কালিগঞ্জের বাকি আটটি ইউনিয়ন শ্যামনগরের সঙ্গে যুক্ত করে গঠন করা হয় সাতক্ষীরা-৪ আসন। এভাবেই চলেছে ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত।  

সম্প্রতি আবার সাতক্ষীরার চারটি সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। যেখানে দেবহাটা উপজেলাকে বাদ দিয়ে আশাশুনির সঙ্গে কালিগঞ্জ উপজেলার চারটিসহ বাকি আটটি ইউনিয়নকে যুক্ত করে গঠন করা হয়েছে সাতক্ষীরা-৩ আসন। আর দেবহাটাকে যুক্ত করা হয়েছে সাতক্ষীরা-২ আসনের সঙ্গে।

দীর্ঘ ১৭ বছর পর সাতক্ষীরা-৩ আসনের সীমানা দ্বিতীয়বারের মতো পুনর্বিন্যাস করায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন সাধারণ মানুষ। সেই সঙ্গে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন রাজনৈতিক দলগুলোর মনোনয়ন প্রার্থীরা।

সাতক্ষীরা জেলা নির্বাচন অফিস জানায়, সাতক্ষীরা-৩ (কালিগঞ্জ-আশাশুনি) আসনের ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ৯৮ হাজার ৩৭।

এ আসনে বিএনপির দু’জন হেভিওয়েট প্রার্থী মাঠে রয়েছেন। মনোনয়নপত্র কিনতে পারেন দলটির কয়েকজন তরুণ নেতাও।

আগে এ আসনে দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করলেও আসনের সীমানা পরিবর্তনের পর ‘প্রার্থী মনোনয়ন’ নিয়ে নতুন করে ভাবতে পারে জামায়াত।

মাঠে নেই সদ্য গঠিত এনসিপির কোনো নেতাকর্মী। স্থবির হয়ে আছে জাতীয় পার্টি। এছড়া আত্মগোপনে রয়েছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া আওয়ামী লীগ।

তথ্য বিশ্লেষণে জানা গেছে, ১৯৮৪ সালে খুলনা থেকে আলাদা হয়ে সাতক্ষীরা মহাকুমা ‘জেলা’ হিসেবে মর্যাদা পায়। এরপর ১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তৎকালীন সাতক্ষীরা-৩ (আশাশুনি) আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে স ম সালাউদ্দীন, ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির স ম সালাউদ্দীন, ১৯৯১ সালে জামায়াতের রিয়াছাত আলী, ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ডা. মোখলেসুর রহমান ও ২০০১ সালে জামায়াতের রিয়াছাত আলী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

এরপর সাতক্ষীরা-৩ (আশাশুনি-দেবহাটা-কালিগঞ্জের চারটি ইউনিয়ন) আসন থেকে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের ডা. আ ফ ম রুহুল হক, ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের ডা. আ ফ ম রুহুল হক, ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের ডা. আ ফ ম রুহুল হক ও ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগের ডা. আ ফ ম রুহুল হক সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

এদিকে তৎকালীন সাতক্ষীরা-৪ (কালিগঞ্জ-দেবহাটা) আসন থেকে ১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মুনসুর আহমেদ, ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির মুনসুর আলী, ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের মুনসুর আহমেদ, ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির শাহাদাত হোসেন ও ২০০১ সালে জাতীয় পার্টি (নাফি) কাজী আলাউদ্দীন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

বার বার ভাঙাগড়া এ আসনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশায় মাঠে রয়েছেন দলটির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও ড্যাবের সাবেক সহসভাপতি ডা. শহীদুল আলম এবং বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও তৎকালীন কালিগঞ্জ-দেবহাটা আসনের সাবেক এমপি কাজী আলাউদ্দীন। মনোনয়ন কিনতে পারেন ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ও স্বেচ্ছাসেবক দল কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাংস্কৃতিক সম্পাদক আশাশুনির সন্তান মির্জা ইয়াছিন আলী এবং সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশনের খুলনা বিভাগের কো-অর্ডিনেটর ইঞ্জিনিয়ার মো. আইয়ুব হোসেন মুকুল।  
 
আগের সীমানা ধরে এ আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করেছিল জামায়াত। জেলা জামায়াতের সাবেক আমির মুহাদ্দিস রবিউল বাশারই ছিলেন এ আসনে দলটির প্রার্থী। কিন্তু সীমানা বদলে যাওয়ায় এ আসনে প্রার্থী মনোনয়নে আরেকবার ভাবতে পারে জামায়াত। এরই মধ্যে নির্বাচনী এলাকায় দলীয় নেতাকর্মীদের মুখে এমন গুঞ্জন শোনা গেছে। নতুন সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে আলোচনা শুরু হয়েছে জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি মাওলানা আজিজুর রহমানকে নিয়ে। যদিও এ বিষয়ে এখনো মুখ খোলেননি দলটির দায়িত্বশীল নেতারা।

সাধারণ মানুষ ও বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সীমানা পুনর্বিন্যাসের কারণে আসনভিত্তিক নতুন প্রস্তুতির দরকার হতে পারে সব দলের প্রার্থীরই।

খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সাবেক এমপি কাজী আলাউদ্দীনের বাড়ি কালিগঞ্জের মৌতলা ইউনিয়নে (শ্যামনগর লাগোয়া)। এতোদিন তিনি প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন শ্যামনগর উপজেলা ও কালিগঞ্জের আটটি ইউনিয়ন অর্থাৎ আগের সাতক্ষীরা-৪ আসনের জন্য। ফলে এখনকার সাতক্ষীরা-৩ আসনের সীমানায় নতুন অন্তর্ভুক্ত আশাশুনিতে তিনি একেবারেই নতুন।  

একইভাবে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও ড্যাবের সাবেক সহসভাপতি ডা. শহীদুল আলম এতোদিন প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন পূর্বের সাতক্ষীরা-৩ (আশাশুনি, দেবহাটা ও কালিগঞ্জের চারটি ইউনিয়ন) আসনের জন্য। এর মধ্যে দেবহাটা উপজেলা সাতক্ষীরা-২ আসনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আশাশুনি তার কাছে পুরোনো হলেও কালিগঞ্জের নতুন আটটি ইউনিয়নে তিনি একেবারেই নতুন।  

একই সমস্যায় পড়েছে জামায়াতও। সাতক্ষীরা-৩ আসনে জামায়াত মনোনীত প্রার্থী মুহাদ্দিস রবিউল বাশারের বাড়ি দেবহাটায়। কিন্তু দেবহাটা উপজেলা সাতক্ষীরা-৩ আসন থেকে বাদ পড়া এবং কালিগঞ্জের নতুন আটটি ইউনিয়ন সাতক্ষীরা-৩ আসনে যুক্ত হওয়ায় তিনিও পড়বেন চ্যালেঞ্জের মুখে।

সবমিলিয়ে সাতক্ষীরা-৩ আসনের সমীকরণ সীমানা পুনর্বিন্যাসজনিত কারণে বেশ জটিল হয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল। আর জামায়াত চায় নিজেদের ভোট ব্যাংক কাজে লাগাতে।  

নির্বাচনী প্রস্তুতি নিয়ে সাতক্ষীরা জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি মাওলানা আজিজুর রহমান বলেন, আমাদের যাবতীয় নির্বাচনী প্রস্তুতি আছে। আমরা জনগণের সঙ্গেই আছি। এ আসনে আমাদের ঘোষিত প্রার্থী জেলা জামায়াতের সাবেক আমির মুহাদ্দিস রবিউল বাশার।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সীমানা পরিবর্তন হওয়ার পর প্রার্থিতা নিয়ে এখনো কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। আমরা কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি।

দলের মনোনয়ন ও নির্বাচন প্রস্তুতি প্রসঙ্গে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য, ড্যাবের সাবেক সহসভাপতি, সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি (৮৩-৮৪) ও ছাত্র সংসদের নির্বাচিত জিএস ডা. শহীদুল আলম বলেন, আমি দীর্ঘদিন এলাকার মানুষের সঙ্গেই আছি। সাতক্ষীরা-৩ আসনের সীমানায় কিছুটা পরিবর্তন এলেও সমস্যা হবে না। এ আসনে বিএনপি অত্যন্ত শক্তিশালী। আমার বিশ্বাস আমরা সাতক্ষীরা-৩ আসনে বিজয়ী হয়ে তারেক রহমানকে উপহার দিতে পারবো।

বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক এমপি কাজী আলাউদ্দিন বলেন, আমি এক সময় কালিগঞ্জ-দেবহাটা আসনের এমপি ছিলাম। এখন নির্বাচন কমিশন ঘোষিত সংসদীয় আসনের চূড়ান্ত সীমানা অনুযায়ী দেবহাটা পড়েছে সাতক্ষীরা-২ আসনের (সাতক্ষীরা সদর ও দেবহাটা) মধ্যে, আর কালিগঞ্জ পড়েছে সাতক্ষীরা-৩ আসনের (কালিগঞ্জ-আশাশুনি) মধ্যে। আমি বিগত ১৫ বছর কাজ করেছি শ্যামনগর ও কালিগঞ্জে। এখনো শ্যামনগর ও কালিগঞ্জেই কাজ করছি, প্রতিদিন দুই উপজেলাতেই একাধিক প্রোগ্রামে অংশ নিচ্ছি। দুই আসনের নেতাকর্মীরাই আমাকে চাচ্ছে, তারা বলছে, আমাদের ছেড়ে যেয়েন না। এমন পরিস্থিতিতে আমি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য দলীয় হাইকমান্ডের সিগন্যালের অপেক্ষায় আছি।

ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ও স্বেচ্ছাসেবক দল কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাংস্কৃতিক সম্পাদক মির্জা ইয়াছিন আলী বলেন, এখন পৃথিবীব্যাপী তরুণদের জয়জয়াকার চলছে। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে আমাদের দলও তরুণদের গুরুত্ব দেবে বলে প্রত্যাশা করছি। সেক্ষেত্রে আমি অবশ্যই আশাবাদী।

সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশনের খুলনা বিভাগের কো-অর্ডিনেটর ইঞ্জিনিয়ার মো. আইয়ুব হোসেন মুকুল বলেন, দলের খারাপ সময়ে আমরা কাজ করেছি। দীর্ঘদিন ধরে সাপোর্ট দিয়েছি। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বাণী তৃণমূলে পৌঁছে দিতে কাজ করেছি। আমার বিশ্বাস, যারা দুর্দিনের কর্মী, যারা সুষ্ঠু ধারার রাজনীতি করেছে এবং করে আগামী নির্বাচনে দল তাদের গুরুত্ব দেবে।  

এসআই
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।