ঢাকা: বাতাসে তখন ভেসে বেড়াচ্ছে মুক্তির আগমনী বার্তা। চারদিকে গুঞ্জন, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না দেশ কোন পথে এগিয়ে যাচ্ছে।
এটি ছিল কমনওয়েলথ একাদশের বিপক্ষে পাকিস্তান একাদশের বেসরকারি টেস্ট ম্যাচ। ছেলেটির হাতে ছিল গান এন্ড মুর কোম্পানির ব্যাট আর তাতে লাগানো ছিল একটি স্টিকার। স্টিকারে বাংলাদেশের মানচিত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিল দুটি শব্দ 'জয় বাংলা'। পাঠক, এতক্ষণ বলা হচ্ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ও সাবেক ক্রিকেটার জীবন্ত কিংবদন্তী রকিবুল হাসানের কথা।
পরদিন সবকটি সংবাদপত্রে গুরুত্বের সঙ্গে এ খবর প্রকাশিত হয়। এমনকি লন্ডনের কয়েকটি পত্রিকায়ও প্রকাশিত হয় খবরটি। চারিদিকে হৈ-চৈ পড়ে যায়। আলোচনা শুরু হয় রকিবুল হাসানকে নিয়ে। পাকিস্তান ক্রিকেট দলের ম্যানেজার তাকে জিজ্ঞেস করেন? জয় বাংলার মানে কি? উত্তর আসে, ‘পূর্ব পাকিস্তান জিন্দাবাদ’।
উল্লেখ্য, এটাই হচ্ছে পাকিস্তান সরকারের বিপক্ষে প্রথম পূর্ব পাকিস্তান ক্রীড়াঙ্গনের আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ। আর তাকে দেখে পুরো গ্যালারি 'জয় বাংলা' 'জয় বাংলা' স্লোগানে উত্তাল হয়ে উঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে পড়ুয়া একজন ছাত্রের জন্য বিষয়টি সত্যিই অনেক বড় সাহসের। এ ঘটনার পরে প্রথম দিনেই টিম ম্যানেজার শোকজ করেন। এমনকি তার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে ওয়ারেন্ট বের হতেও বেশী দেরি হয়নি।
২৬ ফেব্রুয়ারি যে টেস্ট ম্যাচ শুরু হয়েছিল তা বন্ধ হয়ে যায় ১ মার্চ চতুর্থ দিনের দুপুরেই। নিশ্চিত ড্র-য়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ম্যাচটি। কিন্তু ১ মার্চ দুপুর নাগাদ রেডিওতে শোনা গেলো ইয়াহিয়ার ঘোষণা, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে! সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠলো পুরো বাংলাদেশ।
এর কারণ ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে সামরিক সরকারের জেনারেল ইয়াহিয়া ও জুলফিকার আলি ভুট্টো। ৩ মার্চ যে জাতীয় সংসদ আহ্বানের কথা ছিল তা ভেঙে দেওয়া হয় ১ মার্চ সকালে। সারা বাংলা বিক্ষোভে জ্বলে উঠে। বাদ যায়নি ঢাকা মাঠে ক্রিকেট ম্যাচও। এরপর ক্রিকেটারদের নিরাপত্তার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে ক্যান্টনমেন্টে। একমাত্র বাঙালি ক্রিকেটার রকিবুল হাসান যেতে রাজি হলেন না। রয়ে গেলেন ক্যান্টনমেন্টের বাইরে।
মার্চের ৪ তারিখ পাকিস্তান ক্রিকেট দল ঢাকা ত্যাগ করে। জুলাইতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে একমাত্র বাঙালি ক্রিকেটার হিসেবে খেলার কথা ছিল রকিবুলের। কিন্তু তিনি ইংল্যান্ড যাননি। কারণ তখন দেশে জুড়ে বাঁজছে মুক্তির ডামাডোল।
একজন ক্রিকেটারের জন্য জাতীয় দলের হয়ে টেস্ট খেলার চেয়ে বড় আর কোনো চাওয়া হয়তো নেই। কিন্তু মাতৃভূমির জন্য সেদিন রকিবুল হাসান ত্যাগ করেছিলেন আজীবন লালিত টেস্ট খেলার স্বপ্ন। মুক্তিযুদ্ধে তার পরিবারের ছয় সদস্য শহীদ হন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৪৪ বছর, কিন্তু এখনও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ক্রীড়াবিদদের প্রতি কোনো সম্মান জানাতে পারেনি সরকার বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। এ সম্পর্কে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, 'বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে শহীদ মোস্তাক ও শহীদ জুয়েলের নামে দুটি গেটের নামকরণ হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ক্রিকেট স্টেডিয়াম সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়ার পর তাদের নামফলক আর নেই সেখানে। '
তিনি আরো বলেন, 'কোন জাতি কখনই উন্নতি করতে পারেনি যখন পর্যন্ত তাদের কৃষ্টি বা সংস্কৃতিক তারা লালন করতে পারেনি। আমাদের ক্রিকেটের একটি গৌরবেময় ইতিহাস আছে। এই ক্রিকেট একদিনে গড়ে ওঠেনি। যারা এই ক্রিকেটকে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে তাদের প্রাপ্য রয়েছে সম্মাননার। যদি এ ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয় তাহলে আজকের দিনে যে সব হিরো আছে তাদের আবার ৪০ বছর পরে ভুলে যাবে এ জাতি! তাই সঠিক ইতিহাস জানার অধিকার আছে সবার। '
তিনি আরো যোগ করেন, 'মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সব ক্রীড়াবিদের তালিকা হওয়া উচিত। যা এখনও হয়নি, অন্তত যারা শহীদ হয়েছেন তাদের নামে ক্রীড়া স্থাপনাগুলোর নামকরণ করা উচিত। তাদের পরিবার কি অবস্থায় আছে তা জানা আমাদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন তারা কিভাবে তাদের গ্রেটদের কথা স্মরণ রেখেছে। তারা কিভাবে মূল্যায়ন করেছে তাদের ক্রীড়াবিদদের। সব কিছুর পরে আমি বলতে চাই, মরনোত্তর স্বীকৃতি চাই না। '
বাংলাদেশ সময় : ১১২৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৫