কলসিন্দুর, ধোবাউড়া, ময়মনসিংহ থেকে: গ্রামের নাম কলসিন্দুর। গারো পাহাড় থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার উত্তরে নেতাই নদীর পাড়ের সমৃদ্ধ এক জনপদ।
বাংলাদেশ অনুর্ধ্ব-১৪ নারী ফুটবল দলে খেলছেন এ গ্রামেরই ১০ জন ফুটবলার। মেধা-গুণের সমন্বয়ে কিশোরী এ ফুটবলাররা ইঙ্গিত রেখেছেন চমৎকার এক ভবিষ্যতের। হয়তো তাদের ফুটবল সামনেও উপহার দেবে বড় বিস্ময়!
প্রমিলা এ ফুটবলারদের নজরকাড়া পারফরম্যান্সে বেজায় খুশি তাদের বাবা-মা। আনন্দে উদ্বেল স্থানীয় এলাকাবাসীও। গ্রামীণ হাট-বাজার থেকে শুরু করে চা স্টল সর্বত্রই তাদেরকে নিয়ে আলোচনা। দেশের সীমানা ছাপিয়ে বিদেশেও ছড়িয়েছে তাদের নাম-যশ। নিজেদের তারা নিয়ে গেছেন অন্য রকম এক উচ্চতায়।
ময়মনসিংহ জেলা সদর থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে ধোবাউড়া উপজেলার ২ নম্বর গামারিতলা ইউনিয়নের কলসিন্দুর গ্রাম প্রাচীনকাল থেকেই বিখ্যাত ছিল স্বনামে। পদ্মা-মেঘনা-যমুনার মতোই এখানে ছন্দবদ্ধ উচ্চারণ হয় কংশ-নেতাই-সোমেশ্বরীর নাম।
নেতাই নদীর কারণে এ অঞ্চলে ভাল শস্য উৎপাদন হয়। কলসিন্দুর থেকে সোজা উত্তরে তাকালে দূর থেকে ঢেউ খেলানো গারো পাহাড়ের হাতছানি। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে সারি সারি গাছের মনোলোভা নান্দনিক দৃশ্য।
কলসিন্দুর গ্রামে নারী ফুটবলারদের উত্থান আশা জাগানিয়া। ২০১১ সালের মাঝামাঝি সময়ে ফুটবলে শুরু হয় তাদের পথচলা। এ গ্রামের নামেই প্রতিষ্ঠিত কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওই সময়ের দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রীদের নিয়ে ব্যতিক্রমী এক মিশন শুরু করেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মিনতি রাণী শীল।
এ শিক্ষিকার ব্যক্তিগত উৎসাহে আর সহকারী শিক্ষক মফিজ উদ্দিনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ফুটবলে পা ছুঁতে শুরু করেন কোমলমতি ওই ছাত্রীরা। সময়ের পরিক্রমায় তারা একেকজন হয়ে উঠেন দেশকাঁপানো ফুটবলার। পরবর্তীতে প্রতিভা আর ইচ্ছাশক্তির জোরে দেশ ছাপিয়ে বিদেশেও তাদের কারো কারো সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।
চলতি বছর নেপালের কাঠমুন্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ মধ্য এশিয়া অঞ্চলের এএফসি অনুর্ধ-১৪ চ্যাম্পিয়ানশিপে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) বাছাইকরা দেশের ১৮ জন খেলোয়াড়ের মধ্যে কলসিন্দুর গ্রামেরই ১০ জন স্থান পায়।
বাংলাদেশ অনুর্ধ্ব-১৪ নারী ফুটবল দলে কৃতিত্বের সঙ্গে খেলা ১০ নারী ফুটবলাররা হলেন- সানজিদা আক্তার, মার্জিয়া আক্তার, মারিয়া মান্দা, শিউলি আজিম, তহুরা খাতুন (বাংলার ক্ষুদে মেসি), নাজমা খাতুন, শামসুন্নাহার, মাহমুদা, রূপা ও তাসলিমা।
২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন (এএফসি) অনুর্ধ্ব-১৬ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপের আসরে থেকে এশিয়ার সেরা ১০ ফুটবলারের মধ্যে সপ্তম স্থান অধিকার করেন কিশোরী ফুটবলার সানজিদা।
২০১৩ সালে এএফসি অনুর্ধ্ব-১৪ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে শ্রীলঙ্কায় খেলতে যান স্ট্রাইকার মার্জিয়া আক্তার ও গোলকিপার তাসলিমা। ওই বার বাংলাদেশ তৃতীয় হয় আর মার্জিয়া দেশের পক্ষে সর্বোচ্চ গোল করার কৃতিত্বও অর্জন করেন। গেল বছর অনুষ্ঠিত বঙ্গমাতা প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের সেরা খেলোয়াড় হন ক্ষুদে মেসি খ্যাত তহুরা।
চারিদিকে হৈচৈ ফেলে দেয়া প্রমীলা এসব ফুটবলারদের নিয়ে গর্বের শেষ নেই স্থানীয় এলাকাবাসীর। কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কলসিন্দুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠ লগুয়া ফজলুল হকের দোকানে বসেই আলাপ হচ্ছিল স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দাদের সঙ্গে। নিজের এলাকার মেয়েদের এমন সাফল্যে উচ্ছ্বসিত তারাও।
স্থানীয় কৃষক আব্দুর রশিদ হাসিমুখে বললেন, আমগোর এলাকার মেয়েরা আমগর এলাকাডারে গোটা দেশেই চিনাইছে। ওরা যে এমন ভাল খেলবো তা আমরা চিন্তাও করতে পারি নাই। ওদের সাফল্যে আমরা আনন্দিত।
কলসিন্দুর বাজার এলাকার ইউনুস আলী বলেন, ওগোর লেইগা সবাই আমগর গ্রামরে চিনে। আমি প্রতিদিন বিকেলে ওগোর অনুশীলন দেখি। ওরা আরো খুব ভালো করবো।
ধোবাউড়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মজনু মৃধা বলেন, কলসিন্দুরের মেয়েরা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের পরিবর্তন করেছে। তারা জয় করেছে এ অঞ্চলের মানুষের হৃদয়। এখন গোটা দেশ তাকিয়ে তাদের দিকে। দেশের নারী ফুটবলের জাগরণে তাদের এ অবস্থান নিঃসন্দেহে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৮০৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩০, ২০১৫
এসএইচ