ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

খেলা

বিস্ময়ের নাম সানজিদা-মার্জিয়া

এম আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪৩৬ ঘণ্টা, মে ৩, ২০১৫
বিস্ময়ের নাম সানজিদা-মার্জিয়া ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কলসিন্দুর থেকে (ধোবাউড়া) ঘুরে এসে: খুব বেশিদিন হয়নি তাদের ফুটবলার হয়ে উঠার বয়স। ফুটবলের প্রাথমিক জ্ঞানই নিয়েছেন এইতো ক’দিন।

সব মিলিয়ে বছর চারেক। কিন্তু এরইমধ্যে নিজেদের বয়সের ফুটবলের মাঠ মাতিয়ে সাড়া ফেলেছেন দেশের ফুটবল অঙ্গনে।

‘যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে’ এ আপ্ত বাক্যটিই যেন বেশ মানিয়ে গেছে বাংলাদেশ অনুর্ধ্ব-১৪ নারী ফুটবল দলের দুই খেলোয়াড় সানজিদা ও মার্জিয়ার নামের পাশে।
 
ময়মনসিংহ জেলার ধোবাউড়া উপজেলার কলসিন্দুর গ্রামের ফুটবল কন্যাদ্বয়ের পায়ের জাদুতে মুগ্ধ আপামর ফুটবলপ্রেমীরা।

স্থানীয় কলসিন্দুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম ও অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছেন সানজিদা ও মার্জিয়া। এ বিদ্যালয়ের তথা এক গ্রামেরই ১০ কিশোরী খেলছেন অনুর্ধ্ব-১৪ জাতীয় নারী ফুটবল দলে। সপ্রতিভ এ দ‍ুই কিশোরী স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে দেশের সেরা ফুটবলার হতে চান।

সম্প্রতি সরেজমিনে বাংলানিউজের এ প্রতিবেদক তাদের বিদ্যালয়ে গেলে তুলে ধরেন ‘ফুটবলার হয়ে উঠার গল্প’। জানালেন ফুটবলকে নিয়ে তাদের ভবিষ্যত স্বপ্নের কথাও।

দলের নির্ভরযোগ্য ফরোয়ার্ড সানজিদার পুরো নাম মাজেদা আক্তার। তবে সবাই ডাকেন সানজিদা নামেই। কলসিন্দুর গ্রামের কৃষক লিয়াকত আলী আর মা জোছনা বেগম দম্পতির ৬ সন্তানের মধ্যে তৃতীয় তিনি।

মাত্র বছর চারেক আগে নিজের বিদ্যালয় মাঠেই খেলার ডাক পড়ে সানজিদার। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা মুজিব গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে।

অথচ ফুটবল খেলার প্রাথমিক জ্ঞানও ছিল না সানজিদার। কখনও  পায়ে জড়াননি ফুটবল। তবুও শিক্ষক আর সহপাঠীদের চাপাচাপিতে পায়ে বল নিয়ে মাঠে নেমে গেলেন।

অনুশীলনেই নিজের ‘জাত’ চেনালেন। বিদ্যালয় মাঠ থেকে শুরু করে ইউনিয়ন, জেলা এমনকি আন্তজার্তিক ম্যাচেও নিজের পায়ের জাদুতে মুগ্ধ করলেন সবাইকে।

এরপর আর পিছু ফেরা নয়। একের পর এক বিস্ময় জাগানিয়া পারফরম্যান্স আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিযে যায় তাকে। গেল বছরের অক্টোবরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এএফসি অনুর্ধ-১৬ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপে খেলেন তিনি। সেই আসরেই ঘুরে যায় ফুটবলার ভাগ্যের চাকা।

এশিয়ার সেরা ১০ ফুটবলার বাছাই করে এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন (এএফসি)। এ তালিকায় সপ্তম স্থানে নিজের জায়গা করে নেন পতুর্গাল সুপার স্টার রোনাল্ডোর গুণমুগ্ধ সানজিদা।

নিজের ফুটবলার হয়ে উঠার গল্প বলতে গিয়ে বললেন, ‘তখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি। টিফিনের সময় স্যার আমাদের মাঠে নামান। আমরা কিছুই বুঝি না।

জীবনে কোনো দিন ফুটবলে পা ছুঁইনি। প্রথমদিকে ফুটবলে যখন লাথি দিতাম ভীষণ লজ্জাও লাগতো।

‘কিন্তু ম্যাডাম আর স্যাররা অভয় দিতেন। সাহস যোগাতেন,’ বলেন আন্তজার্তিক ৭ ম্যাচে ৮ গোল করা এ কিশোরী ফুটবলার।  

খেলাধূলাতে যেমন টিম সেরা, তেমনি পড়াশোনাতেও বেশ ভালো সানজিদা। অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষায় অসামান্য কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।

পেয়েছেন জিপিএ ৪ দশমিক ৬১। বিশ্ব মানচিত্রে এখন উজ্জ্বল করতে চান কলসিন্দুরের নাম। শুধু তাই নয়, খেলতে চান জাতীয় মহিলা ফুটবল দলে।

এ প্রসঙ্গে সানজিদা বলেন, আমি দেশের সেরা নারী ফুটবলার হবার স্বপ্ন দেখি। জানি এ স্বপ্ন পূরণ অনেক কঠিন। কিন্তু হারতে চাই না। ইচ্ছা পূরণ হলে খেলোয়াড়ি জীবন শেষে নারী ফুটবলের উন্নয়নে আত্মনিয়োগ করতে চাই। ফুটবলের সঙ্গে সারাটা জীবন থাকতে চাই। ’

সানজিদার বাবা লিয়াকত আলী বলেন, ‘এক সময় ভাবতাম পঞ্চম শ্রেণি পাস করলেই মেয়েকে বিয়া দিয়া দিমু। এখন আর তা ভাবি না। আমার মেয়ে এখন সারা দেশে নাম করেছে। এটা আমার জন্য গর্বের। ওর স্বপ্ন পূরণে সব সময় আমি পাশে থাকমু। ’

সানজিদার সঙ্গে যখন আলাপ চলছিল তখন পাশেই নীরবে দাঁড়িয়েছিলেন আরেক ফুটবল বিস্ময় মার্জিয়া আক্তার। তিনিও কলসিন্দুর গ্রামের মানুষের চোখের মণি।

বাবা কৃষক আব্দুল মোতালেব আর গৃহিণী মা রাশিদা খাতুন। ফুটবল আইডল লিওনেল মেসি।

এবারের এএফসি অনুর্ধ্ব-১৪ রিজিওন্যাল চ্যাম্পিয়নশিপে ৩ ম্যাচে ৪ গোল করার বিরল কৃতিত্ব রয়েছে তার। আন্তজার্তিক ৮ ম্যাচে গোলের সংখ্যা ৬। ঘরোয়া লিগে করেছেন ১৫ থেকে ২০ গোল।

এ মার্জিয়া গেলবার সারা দেশে মেয়েদের জাতীয় ফুটবল লিগে ময়মনসিংহ জেলার পক্ষে খেলে দেশসেরা খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি পেয়েছেন। দায়িত্ব পালন করেন ময়মনসিংহ জেলা দলের অধিনায়ক হিসেবেও। ২০১৪ সালে ওই লিগে সিরাজগঞ্জের বিপক্ষে এক ম্যাচে ৪ গোল করেন তিনি।

সম্প্রতি নেপালের কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত এএফসি অনুর্ধ্ব-১৪ চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা প্রত্যাশী শক্তিধর ভারতের বিপক্ষে তার পা থেকে আসে একমাত্র গোল।

শেষ মিনিটে তার করা ফ্রি কিক গোলবারে লেগে ফেরত না আসলে সেই ম্যাচের ফলাফল অন্যরকম হতে পারতো। দেশসেরা হবার স্বপ্ন তার চোখেও।

‘যখন প্রথম ফুটবলে লাথি দেই তখন ভয় করতো যদি ব্যাথা পাই। তখন বল রিসিভ করতে পারতাম না। স্যার প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। আর প্রথম যখন ফুটবল খেলা শুরু করি তখন আব্বা-আম্মা মানাও করতেন। ম্যাডাম আর স্যারকে পাগল ডাকতেন তারা,’ এক নাগারে বলছিলেন মার্জিয়া।

লক্ষ্য প্রসঙ্গে জানালেন, বহুদূর যেতে চান। ভালো ফুটবল খেলে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে চান।   বাবা মোতালেবও তার মেয়েকে নিয়ে এখন গর্ব করেন।

বললেন, ‘এলাকার লোকজন এখন অনেক সম্মান করে। মার্জিয়ার বাবা নামে ডাকে। আমার মেয়ে এ এলাকার মুখ উজ্জ্বল করেছে। ভবিষ্যতে দেশের মুখও উজ্জল করবে। ’

বাংলাদেশ সময়: ০৪৩৬ ঘণ্টা, মে ০৩, ২০১৫
এএমকে/এমএ

** নিচে তাকাইয়া দেখি দোলনার মতো ঘর দুলতাছে
** ‘কলসিন্দুরের মেয়েরাই জাতীয় টিমের হাল ধরবে’
** জাতীয় দলে এক গ্রামেরই ১০ কিশোরী!

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।