আজকালের আবর্তে ক্রিকেট দলের নেতৃত্ব ছাড়ার ২৬ বছর পর তিনি নিজ দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব হাতে নেওয়ার খুব কাছাকাছি পর্যায়ে পৌঁছে গেছেন। তিনি আর কেউ নন, এই মুহূর্তে বিশ্ব গণমাধ্যমের সবচেয়ে বহুল আলোচিত নাম, ইমরান খান।
বুধবার (২৫ জুলাই) পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এরপর ভোটগণনা শেষে বৃহস্পতিবার (২৬ জুলাই) ফল ঘোষণার পর দেখা গেল স্পষ্ট ব্যবধানে এগিয়ে আছে ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ দল। দেশটির ইতিহাসে মাত্র দ্বিতীয়বারের মতো সামরিক হস্তক্ষেপ ছাড়াই ক্ষমতার পালাবদলের ঘটনা এটি।
দীর্ঘ ২২ বছর সংগ্রাম করার পর পাকিস্তানে নিজের নেতৃত্ব স্থাপন করতে সক্ষম হওয়ার পথে ইমরান খান। নির্বাচনী ফলাফল বলছে সরকার গঠনের জন্য পর্যাপ্ত আসন না পেলেও ১১৭ আসন নিয়ে শীর্ষেই আছে ইমরান খানের দল। এখন দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থানে থাকা দলের সঙ্গে জোট সরকার গঠন করবেন ইমরান।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের ৪ বছর পর ১৯৯৬ সালে রাজনীতিতে নামেন ইমরান খান। ১৯৯২ সালে জেতা শেষ তথা এখন পর্যন্ত একমাত্র ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচে জয়সূচক উইকেটটি তার করা বল থেকেই আসে। সেই শেষ, এরপর আর কখনও পাকিস্তানের হয়ে মাঠে নামেননি তিনি।
রাজনীতিতে সাফল্য আসে অনেক কঠিন ও বন্ধুর পথ পাড়ি দেওয়ার পর। ঠিক যেমনটা হয়েছে ইমরান খানের ক্ষেত্রে। ইমরানের দল গঠিত হওয়ার পর প্রথম তিন নির্বাচনে মাত্র ১টি করে আসন দখল করে। অবশেষে ২০১৩ সালের নির্বাচনে বিরাট সাফল্য ধরা দেয়। যদিও জাতীয়ভাবে নয়, তবু তার দল পাকিস্তানের পূর্ব-পশ্চিমাঞ্চলের রাজ্য খাইবার পাখতুনখাওয়ায় সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়।
বিগত দীর্ঘ ১৫ বছর ক্রিকেট থেকে শুধু দূরে নয়, বরং মাঝে মাঝে টেলিভিশন আলোচনায় উপস্থিত হওয়া ছাড়া এর ধারেকাছেও ঘেঁষা থেকে দূরে থাকেন ইমরান। তাও ক্রিকেটের চেয়ে রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয়েই কথা বলতে দেখা গেছে তাকে। এখন তাকে শুধু তার রাজনৈতিক বক্তব্যে ক্রিকেটীয় পরিভাষা ব্যবহার করতে দেখা যায়, তাও মাঝে মাঝে।
ইমরানের জীবনের বিরাট একটি অংশ ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত ছিল। ১৯৭১ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষিক্ত হওয়ার পর ১৯৯২ সালে বিশ্বকাপ জেতা পর্যন্ত প্রায় দুই যুগ তাকে বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে গণ্য করা হতো। খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে বারবার রূপান্তরিত করতে পারতেন তিনি। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮২-৮৩ সালের দিকে যখন তার সেরা সময় অতিবাহিত হয়েছে সেই সময় বিশ্বের যেকোনো ফাস্ট বোলারের চেয়ে তিনি অধিক ফাস্ট আর কার্যকর ছিলেন। আর ব্যাটসম্যান হিসেবে তার ব্যাট একটু ধীরে পরিস্ফুটিত হলেও যেকোনো পরিস্থিতি আর পজিশনে তিনি বহুমুখী ব্যাটিং প্রতিভা নিয়ে হাজির হতেন।
কিন্তু অধিনায়ক হিসেবেই নিজের সেরা সাফল্য দেখিয়েছেন ইমরান খান। তার অধিনায়কত্বেই পাকিস্তান দলটি পুরো পরিবর্তিত হয়ে ওঠে। ১৯৮২ সালে তিনি অধিনায়কত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, এবং তার নেতৃত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পাশাপাশি সেই সময়ের সেরা দলে পরিণত হয়। তার অধিনায়কত্বে তিনবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজে মুখোমুখি হয় পাকিস্তান। তিনবারই ১-১ ব্যবধানে সিরিজ ড্র হয়।
ইমরান খান তার দলের তরুণ খেলোয়াড়দের মূল পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন। তার সময়েই ওয়াসিম আকরাম আর ওয়াকার ইউনিসের মতো গ্রেট বোলাররা পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছেন।
ইমরানের সর্বশেষ যে রূপান্তর, যা ক্রিকেট মাঠের বহু দূরের বিষয়, তা তার জীবনের সেরা চমক একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। খেলোয়াড় হিসেবে তার জনপ্রিয়তা শুধু পাকিস্তানে নয়, পুরো বিশ্বেই সবচেয়ে বেশি পরিচিত পাকিস্তানি তিনিই। বিশেষ করে ইংল্যান্ডে তার জানাশোনা অনেক বেশি। সেখানে তার প্রথম স্ত্রী জেমাইমা ও তার সন্তানদের বাস বলে নয়, বরং কাউন্টি ক্লাব সাসেক্সের হয়ে খেলাকালীন থেকেই তিনি বহুল পরিচিত নাম।
খেলা ছাড়ার পর ইমরান প্রথমে একটি ক্যান্সার হাসপাতাল স্থাপনে মনোযোগী হন যেখানে দরিদ্রদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়। এরপরই তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন যেখানে তিনি রক্ষণশীল ও কিছুটা ডান-ঘেঁষা রাজনৈতিক ভাবাদর্শ নিয়ে হাজির হন। এভাবে হঠাৎ করে রাজনীতিতে আসা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয় তাকে। আশির দশকে তার গৌরবময় অর্জনকে সবাই ভুলে যেতে শুরু করে। যদিও ইমরান নিজের রাজনীতিতে আসাকে পূণর্জাগরণ হিসেবে অভিহিত করেন।
নির্বাচনে জয় লাভ করায় পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের (পিসিবি) ওপর ইমরানের প্রভাব পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হবে সন্দেহ নেই। যদি তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েই যান, সেক্ষেত্রে পিসিবির মূল চাবিকাঠি তার হাতেই চলে আসবে। ফলে বোর্ডের হর্তাকর্তাদের কয়েকজনকে নিয়ে তিনি তার নিজের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার হাতে দু’জন বোর্ড পরিচালক নিয়োগের এখতিয়ার থাকবে। শুধু তাই না, বোর্ডের চেয়ারম্যানকে বরখাস্ত করার এখতিয়ারও তার হাতে থাকবে। এটা বোর্ডে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে কেননা বর্তমান পিসিবি প্রধান নাজাম শেঠির সঙ্গে ইমরানের সম্পর্ক সেই ২০১৩ সালের নির্বাচনের পর থেকেই বেশ তিক্ত। আর পাকিস্তানে এটা অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে পিসিবির নেতৃত্বেও পরিবর্তন আসবে।
পাকিস্তানের ঘরোয়া ক্রিকেটেও পরিবর্তন আসতে পারে। কারণ, ইমরান খান দীর্ঘদিন থেকেই দেশটির ঘরোয়া ক্রিকেটের কিছু বিষয়ের বড় সমালোচক। বিশেষ করে ঘরোয়া দলগুলোর অধিকাংশেরই মালিকানা ব্যাংক কিংবা এয়ারলাইন্স কোম্পানিগুলোর।
অন্যদিকে রাজ্য পর্যায়ের দলগুলোর আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। অনেকদিন আগে তিনি একবার বলেছিলেন যে, ঘরোয়া ক্রিকেট হওয়া উচিত অস্ট্রেলিয়ান মডেলে, যেখানে খুব কম সংখ্যক রাজ্য দল থাকবে, আর সংখ্যার চেয়ে যেখানে মানের দিকে বেশি নজর থাকবে।
যেভাবে সব এগুচ্ছে, তাতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার হিসেবে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বাদ পেতে চলেছেন ইমরান খান। তার সমকক্ষ আর একজনকে কিছুদিন আগে দেখা গেছে একই দায়িত্বে। তিনি হলেন লাইবেরিয়ার সাবেক ফুটবলার ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট জর্জ উইয়াহ। গত কয়েক বছর ধরেই যিনি ইমরানের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমানে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ নওয়াজ শরিফও ঘটনাক্রমে জীবনে একবার ফার্স্ট-ক্লাস ক্রিকেট খেলতে মাঠে নেমেছিলেন।
বাংলাদেশ সময়: ২৩২২ ঘণ্টা, জুলাই ২৬, ২০১৮
এমএইচএম/আরএ