ঢাকা, বুধবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

খেলা

পর্বতারোহী বিথী পরিবারের সমর্থনও পাননি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪১ ঘণ্টা, আগস্ট ২৩, ২০১৮
পর্বতারোহী বিথী পরিবারের সমর্থনও পাননি পর্বতারোহী শায়লা পারভিন বিথী। ছবি: শোয়েব মিথুন

সাঁতারু হলে হয়তো প্রশ্ন উঠতো না! কিন্তু নদীর পাড়ে বেড়ে ওঠা কোনো মেয়ে যখন পাহাড়ে উঠে যায়, সেখানে বড়সড় একাধিক প্রশ্নবোধক চিহ্ন ঝুলতে থাকে তার সামনে। কেন, কিভাবে, মেয়ে কতশত প্রশ্ন।

কিন্তু এসবকে পাত্তা না দিয়েই পাহাড়ে পা রেখেছেন বাংলাদেশের পিরোজপুরের মেয়ে শায়লা পারভিন বিথী। দেখিয়েছেন উঁচুতে ওঠার স্বপ্নের পথ।

জানিয়েছেন বাংলাদেশের পতাকা কিভাবে ওড়াতে হয় হাজার হাজার মাইল উচ্চতায়।  

কিভাবে হয়ে উঠলেন পাহাড়ের মেয়ে! সামাজিক-পারিবারিক বাধা, স্বপ্ন নিয়ে কথা হলো বিথীর সঙ্গে। সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেলো তার কাছ থেকেই। তার মতো করেই জানা যাক, তার গল্পটা।

‘ছোট বেলা থেকে আসলে পর্বতারোহণের কোনো ইচ্ছা ছিল না। আসলে আমার তো নদী চেনার কথা। টেলিভশন বা বইয়ে যতটুকু দেখেছি ওইটুকুই পাহাড় চেনা। পাহাড় নিয়ে তেমন কোনো আকর্ষণও ছিলো না। আসলে মূলত শুরুটা একদমই হঠাৎ করে। '

‘২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বন্ধুদের নিয়ে সীতাকুণ্ড পাহাড়ে যাই। জীবনের প্রথম এত কাছ থেকে পাহাড় দেখা। ভাগ্যক্রমেই সেখানে এমএম মুহিত ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। তিনি বাংলাদেশ মাউন্টেনিং অ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাবের (বিএমটিসি) প্রেসিডেন্ট। উনি দুইবারের এভারেস্ট বিজয়ী একমাত্র বাংলাদেশি। ওখানেই তার ক্লাব সম্পর্কে জানতে পারলাম। '

‘এরপর ঢাকায় এসে তার সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তাদের ক্লাবে গেলাম। অনেক অনেক কথা শুনলাম পাহাড় নিয়ে। সেখানেই পর্বতারোহি মানুষগুলোর কাছাকাছি থাকতে থাকতে পাহাড় চিনতে শুরু করলাম। এভাবেই আসলে পাহাড়ের প্রতি আকর্ষণ বাড়লো। '

‘সেই আকর্ষণ থেকেই ২০১৪ সালের নভেম্বরে প্রথমবার পাহাড়ের উদ্দেশ্যে যাই তাদের সঙ্গে। বান্দরবন পাহাড়ে আমার প্রথম অফিশিয়াল ট্রেকিং। পাঁচ দিনের এই ট্রেকিংয়ে পাহাড়কে আরও আপন মনে হলো। সেবার ঢাকায় ফিরে সবাই খুব উৎসাহ দিলেন। বললেন, আমি পারবো। কিন্তু আমার নিজেরও তখন বিশ্বাস ছিলো না যে আমি এরপর আরও আগাবো। 'শায়লা শারমিন বীথি‘এরপর ২০১৫ সালে কেয়াজুরি পর্বতে সামিটে যাওয়ার পরিকল্পনা হয়। সেখানে আমাকেও সিলেক্ট করা হয়। সেই দলে ৭ জন সদস্য নির্বাচন করা হয়। যাদের মধ্যে ৫ জন কেয়াজুরির চূড়ায় যাওয়ার জন্য আর আমি ও আরেক আপুকে বেজ ক্যাম্প পর্যন্ত যাওয়ার জন্য নির্বাচন করা হয়। দারুণ এই সুযোগ পেয়ে বেশ রোমাঞ্চিত ছিলাম। শুরু হলো আমাদের ফিটনেস নিয়ে কাজ করা। '

‘এটাই দেশের বাইরে প্রথম যাত্রা। প্রথম নেপালে যাওয়া। প্রথম এত উচ্চতায় যাওয়ার সুযোগ। তাও হিমালয়ের কাছে। এই অনুভূতি আসলে বোঝানোর মতো না। ১৫ হাজার ৫০০ ফুট উঁচুতে ছিলো এ বেজ ক্যাম্প। যা বেশ ভালোভাবেই শেষ করি আমরা। এটা আসলে দারুণ এক অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতার পর যেনো পাহাড়ের প্রেমেই পড়ে গেলাম। ' 

‘দেশে ফেরার পর সবাই খুব খুশি। ক্লাব থেকে সিদ্ধান্ত হলো যেহেতু আমরা শারীরিক ভাবে সুস্থ থেকে বেজ ক্যাম্প শেষ করতে পেরেছি তাহলে আমাদের আরও ভালোভাবে তৈরি হওয়া উচিৎ। সিদ্ধান্ত হলো আমাদের ভারতে ট্রেনিংয়ে পাঠানো হবে। ২০১৬ সালের এপ্রিলে ক্লাব থেকে ৫ জন মেয়ে একসাথে ট্রেনিংয়ে গেলাম। ভারতের নেহেরু ইন্সটিটিউট অব মাউন্টেনিংয়ে। '

‘এই ট্রেনিংয়েও আমি ভালো করি। ‘এ’ গ্রেড পেয়ে উত্তীর্ণ হই। আসলে ‘এ’ গ্রেড পেলে এডভান্স কোর্স করার সনদ দেওয়া হয়। ক্লাব খুবই খুশি হয়। বিশেষ করে মুহিত ভাই। কারণ এই মানুষটা না থাকলে আমি কখনই এত দূর আসতে পারতাম না। আমার যতটুকু সফলতা পুরোটাই তার সফলতা। '

‘এর পর আমরা নেপালের মেরা পিকে যাওয়ার পরিকল্পনা করি। ৬ হাজার ৪৭৪ মিটার এই পিকের উচ্চতা। আসলে এটাই নিয়ম পর্বতারোহিদের। আস্তে আস্তে উচ্চতা বাড়ানো হয়। সাধারণত মেরা পিককে প্রথম দিকে নির্বাচন করা হয়। এরপর অন্য কিছু। আমরা ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে মেরা পিকে গেলাম। দলে ৪ জন ছিলেন। আমার প্রথম পর্বত জয়। অসাধারণ এক অনুভূতি। '

শায়লা শারমিন বীথি

‘এরপর ২০১৭ সালের এপ্রিলে আমরা অন্নপূর্না সার্কিটে যাই। ২০১৭ সালের অক্টোবরে নেপালের মাউন্ট লারকে সামিট করি আমরা। সেবার ছিলাম ৬ জন। তবে ভাগ্য খারাপ হওয়ায় আবহাওয়া অনেক খারাপ হয়ে যায়। তাই হাই ক্যাম্প থেকেই ফিরে আসতে হয়। পর্বতের উচ্চতা ছিল ৬ হাজারের কিছুটা বেশি। তবে আবহাওয়ার কারণে আমরা ৫ হাজার ৫০০ ফুট উঁচু থেকে আমরা ফিরে আসি। '

‘আর সবশেষ চলতি বছরের এপ্রিলে আমরা লাকপারি পর্বতে যাই। এটা আমার যাওয়া এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ পর্বত। ৭ হাজার ৪৫ মিটার। একদিকে যেমন ভালোলাগা ছিলো তেমনি ভয়ও ছিলো। পারবো কিনা। এটি ছিলো তিব্বতে। এভারেস্টের ঠিক কোলেই ছিলো। আর এভারেস্টে যারা যেতে চায় তারা লাকপারিকে পরীক্ষামূলক হিসেবে দেখে। '

‘ক্লাইম্বিক ক্লাবের তত্বাবধানে সেখানে যাই আমরা। আমরা ছাড়াও সেখানে কয়েকশত ক্লাইম্বার ও তাদের সঙ্গে কয়েকশত শেরপা ছিলো। দেখে মনে হয়েছিল কোনো তাবুর শহর। ১২ মে সকাল ৯টার দিকে আমরা মিডেল ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। ৫ হাজার ৮০০ ফুট উঁচু বেজ ক্যাম্প থেকে আমাদের এ যাত্রা শুরু হয়। পথটা তেমন উঁচু না হলেও প্রচণ্ড লম্বা একটি পথ। তবে মজার ব্যাপার হলো, যারা এভারেস্টে যাবে তাদেরও একই বেজ ক্যাম্প ও মিডল ক্যাম্প পার হয়ে যেতে হতো। '

‘কি যে দারুণ এক অভিজ্ঞতা! চোখের সামনে মানুষগুলোকে এভারেস্টে যেতে দেখছি। অসাধারণ লাগছিলো। আমাদের সঙ্গে থাকা ২ জনও এভারেস্টে যাবে, এটা ভাবতে আমার মনে হচ্ছিলো আমিই যাচ্ছি। তিনজন শেরপা নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। একদিনের রাত আড়াইটায় যাত্রা শুরু করে পরেরদিন রাত ৯ টায় আমাদের সেই সামিট শেষ হয়। আর এই সামিটে জীবনের এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয়। '

‘শেরপাদের সঙ্গে মেইন রোফে আটকানো ছিলাম আমরা। হঠাৎ করেই কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই গলা পর্যন্ত বরফে ডুবে গেলাম। একজন শেরপা আমাকে তুলতে আসলেন কিন্তু আমি পায়ের নিচে কোনো তল খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কোনো পরিমাপও করতে পারছিলাম না আসলে কতোটা গভীর এই ‘হিডেন হোল’। শেষ পর্যন্ত অনেক কষ্টে সেই হোল থেকে আমাকে বের করা হলো। ' 

‘অনেক ভয় পেয়েছিলাম। ভাইয়ারা জানতে চাইলে অবশ্য বলেছি ভয় পাইনি। কিন্তু এ ধরনের হিডেন হোল খুব খারাপ আমি আগেই জানতাম। তাই ভয়টা বেশি ছিল। বেশ কয়েকবার আমি হাল ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু মুহিত ভাইয়ের উৎসাহে শেষ পর্যন্ত আমি লাকপারির চূড়ায় পৌঁছাতে পেরেছি। কিন্তু সেখানে পৌঁছে এতটাই ক্লান্ত হয়ে গেলাম, যে তখন আনন্দটা তেমন ছুঁতে পারেনি। '

‘ফিরতি পথেও কম কষ্ট হলো না। ৬ ঘণ্টায় পার করে নামতে হয়েছে। রাত সাড়ে নয়টায় যখন আবার ক্যাম্পে পৌঁছালাম তখন এত ক্লান্ত ছিলাম, কিছু একটু মুখে দিয়েই ঘুমিয়ে গেলাম। কিন্তু পরের দিন যখন সবাই অভিনন্দন জানাতে আসলো তখন আসলে আসল সামিটের রোমাঞ্চটা পাচ্ছিলাম। ’

শায়লা শারমিন বীথিএকটানা সফলতার গল্প শুনিয়ে যেনো একটু হাঁপিয়ে উঠলেন। কিন্তু পাহাড় জয়ের আনন্দ যেনো চোখে-মুখে ঠিকরে বের হচ্ছিল। জানতে চাইলাম, পরের পরিকল্পনা কী? আবার শুরু করলেন বিথী।

‘আসলে মুহিত ভাইয়ের মতে, যেহেতু আমি লাকপারি জয় করেছি সেহেতু আমি এখন এভারেস্টের জন্য অনেকটাই প্রস্তুত। স্বপ্ন যেহেতু আছে। পরের পরিকল্পনায় সেটাকেই রেখেছি। কিন্তু কিছু সমস্যা আছে। এর মধ্যে প্রধান সমস্যা হলো আর্থিক। কারণ এভারেস্ট তো আর মুখের কথা না। অনেক অর্থের দরকার। সেক্ষেত্রে স্পন্সর ছাড়া সম্ভব না। এখন দেখা যাক, যদি তেমন কেউ এগিয়ে আসে তবে ইচ্ছা আছে পরের বছর এপ্রিলে এভারেস্টের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার। ’

এত কিছু পাওয়া, এত সফলতা কিন্তু সমাজ-পরিবার কতোটা সঙ্গ দিয়েছে বিথীর? বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় প্রতিনিয়ত যা শোনা যায়, বিথীর কন্ঠেও শোনা গেলো সেই আক্ষেপ।

‘সমাজ তো কোনোভাবেই মানতে পারেনি। এখনও তেমন না। এমনকি পরিবারও কখনো সাপোর্ট দেয়নি। এমন কী প্রথমবার যখন নেপাল গেলাম, আমি বাড়িতে বলে যাইনি। শুধু মা কে বলেছিলাম। ভারতে ট্রেনিংয়ে যাওয়ার দিন বাবাকে বলে গেছি। এটুকুই। প্রথমদিকে খুব কথা শোনাতো। তবে আশার কথা হচ্ছে এখন বাধা দেয় না তবে খুব একটা যে সাপোর্ট দেয় তাও না। হ্যা ভাই-বোন-বন্ধুরা খুব উৎসাহ দেয়। '

‘আর সমাজের কথা কী আর বলবো! আমি যেবার লারকে অভিযানে যাই সেবার দলে আমি শুধু একটা মেয়ে ছিলাম। বাকি ৫ জন ছেলে ছিল। ইমিগ্রেশনে আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো, আমি যে ৫ জন ছেলের সঙ্গে যাচ্ছি আমার ভয় করছে না? আমি ছেলের সঙ্গে যাচ্ছি সেটা প্রশ্ন, কিন্তু আমি যে একটা মানুষ আমি পাহাড়ে যাচ্ছি, আমার যেকোনো ধরনের সমস্যা বা দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু আমাদের সমাজের চিন্তা-ভাবনা কতোটা ছোট। এ নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যাথা নেই। কিন্তু আমি মেয়ে তা নিয়ে তাদের যতো চিন্তা। '

‘আমি ভোরে যখন দৌড়াতে যাই, আমার দারোয়ানের প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় প্রায় প্রতিদিন। রাস্তায় মানুষের চোখে প্রশ্ন দেখতে পাই। এসব পার করেই চলতে হচ্ছে। ’

সমাজ বাধা দেয়, বাধা আসে ঘর থেকেও তবু স্বপ্ন থেমে থাকে না। থাকবে না বিথীরও। একজন নারীর হাতে এভারেস্টের চূড়ায় উড়বে লাল-সবুজের পতাকা।

বাংলাদেম সময়: ২০৪০ ঘণ্টা, আগস্ট ২৩, ২০১৮
এমকেএম/এমএমএস/এমএইচএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।