ঢাকা: তথ্যপ্রযুক্তির হাত ধরে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভিডিও কনটেন্ট তৈরি বা ভ্লগিং একটি ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি হাজার হাজার তরুণ-তরুণীসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ এই কন্টেন্ট তৈরি বা ভ্লগিংকে নিজের পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
সম্প্রতি ঢাকার রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় এমন দুটি ঘটনা পুলিশের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে। পুলিশের তথ্য মতে, গত ৯ আগস্ট বিকেলে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে চট্টগ্রামগামী একটি ট্রেনের ছাদে উঠে এক চীনা নাগরিক ভ্লগ বানানোর সময় তার মোবাইল ফোনটি খোয়া যায়। এর আগে ১ আগস্ট একই দেশের আরেক নাগরিক অভিযোগ করেন, স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় ভিডিও করার সময় কেউ তার মোবাইল ফোন নিয়ে গেছে।
পুলিশ বলছে, কিছু বিদেশি, বিশেষ করে চীনের নাগরিকের কার্যকলাপ রেলওয়ে এলাকায় উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি করছে। অভিযোগ রয়েছে, তারা স্টেশনে ঢুকে চলন্ত ট্রেনের ছাদে উঠে ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করছেন, যা নিরাপত্তা ও ট্রেন চলাচলের জন্য হুমকি হতে পারে। এছাড়া তাদের নিজেদের নিরাপত্তার বিষয়টিও সামনে চলে আসে। কনটেন্ট তৈরির সময় এদের সঙ্গে কিছু ভবঘুরে, বাস্তুহারা কিশোরদেরও দেখা যায়। এদের মধ্যে কেউ কেউ মাদকাসক্তও থাকে। ফলে কোনো ঝুঁকিই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
সোমবার (১১ আগস্ট) বিমানবন্দর রেলস্টেশনের পুলিশ ফাঁড়ি থেকে একটি সূত্র জানায়, ছয় মাস ধরে বেশ কয়েকজন চীনা নাগরিক আলাদা আলাদাভাবে বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে প্রবেশ করে ভিডিও করতে থাকেন। কনটেন্ট বানানোর নেশায় তারা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে ট্রেনের ছাদে উঠে যান। আবার দেখা যায়, কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে কোনো ট্রেনের ছাদে উঠে বিমানবন্দর স্টেশনে এসে নেমে পড়েন। সেই যাত্রার মধ্যে তারা ট্রেনে ছাদে কনটেন্ট তৈরি করেন, সে সময় তাদের সঙ্গে কিছু ভবঘুরে বা টোকাইও থাকেন।
রেলওয়ে পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়ে স্টেশনের ভেতরে ভিডিও কনটেন্ট তৈরি না করার জন্য বিদেশিদের অনুরোধ করা হলেও তা মানা হয় না। সম্প্রতি প্রবেশ নিয়ে পুলিশের সঙ্গে তাদের একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে, যা নিয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করা হয়েছে।
জিডিতে উল্লেখ করা হয়, কয়েক মাস ধরে কয়েকজন চীনা নাগরিক বিমানবন্দর স্টেশন এলাকায় মোবাইল নিয়ে ঘোরাঘুরি করে ভিডিওধারণ করছিলেন। পুলিশ তাদের জিজ্ঞাসা করলে তারা জানান, তারা ‘ভ্লগ’ করছেন। পুলিশ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া এমন কর্মকাণ্ড করা যায় না বলে তাদের সতর্ক করে।
এ সময় এক চীনা নাগরিক উত্তেজিত হয়ে পুলিশের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। পরে বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হয়।
১ আগস্ট এক চীনা নাগরিক অভিযোগ করেন, স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় ভিডিও করার সময় কেউ তার মোবাইল ফোন নিয়ে গেছে। বিষয়টি নিয়ে পুলিশ তদন্ত শুরু করে।
এর সপ্তাহখানেকের মাথায় ৯ আগস্ট বিকেলে আরেকটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। সেদিন কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে চট্টগ্রামগামী একটি ট্রেনের ছাদে উঠে এক চীনা নাগরিক মোবাইলে কন্টেন্ট বানাচ্ছিলেন। তখন কিছু টোকাই তার সঙ্গে উপস্থিত ছিল। এক পর্যায়ে ট্রেনটি ধীরগতিতে এলে সেই চীনা নাগরিক রাজধানীর কাওলা এলাকায় নেমে আবারও পুনরায় ফিরে যান বিমানবন্দর রেলস্টেশন এলাকায়। সেখানে বুঝতে পারেন তার মোবাইলটি খোয়া গেছে। এরপর তিনি মোবাইলের জন্য কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে যান। মোবাইল হারিয়ে আবেগপ্রবণ ও আক্ষেপের সেই ভিডিও কে বা কারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেয়।
পুলিশ বলছে, এই ঘটনায় ভুক্তভোগী সরাসরি কোনো অভিযোগ করেননি, কিন্তু তারা বিষয়টি আমলে নিয়ে তদন্ত করছেন।
সূত্র মতে, ওই দুই ভুক্তভোগীই নন শুধু, সম্প্রতি আরও দুই-তিনজন চীনা নাগরিককে রাজধানীর বিমানবন্দর ও রেলস্টেশন এলাকায় কিছু কিশোর ভবঘুরের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেছে। তারা ওই কিশোরদের নিয়ে বিভিন্ন ধরনের ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করছেন বলে ধারণা করা হয়।
এসব কনটেন্ট তৈরির সময় অসাবধানতা বা নিয়ম না মানার কারণে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটার শঙ্কা জাগে। সেই শঙ্কা বাস্তবে রূপ নিলে ওই ঘটনাই ছড়িয়ে যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, যা বাংলাদেশকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদেশি কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের শুধুই ক্রিয়েটর হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। তাদের নিজেদের পাশাপাশি দেশেরও নিরাপত্তার স্বার্থে এই ক্রিয়েটর বা ভ্লগারদের নিয়ম-কানুনের মধ্যে রাখা উচিত। খুবই দ্রুত সরকারের তরফ থেকে বিদেশি ভ্লগার বা কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের জন্য কোনো নির্দেশনা আসা উচিত।
কয়েক মাসে তিন শতাধিক অপরাধী গ্রেপ্তার
ঢাকা জেলার কমলাপুর রেলস্টেশনসহ অন্যান্য রেলওয়ে স্টেশনে যাত্রীদের নিরাপত্তায় রেলওয়ে পুলিশ বলছে, তারা ২৪ ঘণ্টা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে গত কয়েক মাসে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা গেছে। ভ্রাম্যমান হকার প্রবেশ নিষিদ্ধ, অবৈধ দোকান উচ্ছেদ করার পাশাপাশি ছিনতাইকারী, পকেটমার, অজ্ঞান পার্টি ও মাদক সংশ্লিষ্ট কয়েকশ অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
ঢাকা রেলওয়ে থানা (কমলাপুর) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জয়নাল আবেদীন বাংলানিউজকে বলেন, রেলওয়ে পুলিশ রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। স্টেশনসহ অন্যান্য রেলওয়ে জায়গায় থেকে, অজ্ঞান পার্টি, ছিনতাইকারী, মাদক বিক্রেতা, মাদকসেবী, টানা পার্টিসহ অন্যান্য অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে মামলার মাধ্যমে আদালতে পাঠানো হচ্ছে। গত কয়েক মাসে কয়েকটি স্টেশন এলাকা থেকে তিন শতাধিক অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়া স্টেশনের ভেতর ভ্রাম্যমাণ হকার ও অবৈধ দোকানও উচ্ছেদ করা হয়েছে।
ওসি বলেন, কয়েক মাস যাবত চীনা নাগরিকদের বিভিন্ন কার্যক্রমে পুলিশ উদ্বিগ্ন। চীনা নাগরিকদের স্টেশনের ভেতরে ও ট্রেনের ছাদে অবাধে চলাফেরার কারণে তাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও সামনে চলে এসেছে। এমনিতেই খবর পাওয়া যাচ্ছে, চীনা নাগরিকদের মোবাইল নিয়ে যাচ্ছে। এরকম সরাসরি অভিযোগ না পেলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব সংবাদ পেয়ে পুলিশ অলরেডি তদন্ত করছে।
‘বিদেশিদের অনুমতি ছাড়া স্টেশনে প্রবেশ বা ট্রেনের ছাদে উঠে ভিডিও কন্টেন্ট বানানোর বিষয়গুলো আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবগত করা হয়েছে। তারা ওপরের দিকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছেন। তবে বিদেশি নাগরিকদের যতটুকু সম্ভব সর্বত্র নিরাপত্তা দিয়ে বুঝিয়ে স্টেশন থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে’, বলেন ওসি।
স্থানীয় ভ্রমণবিধি-নির্দেশনা মানা উচিত বিদেশিদের
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, আমাদের দেশে বিদেশি নাগরিকদের হয়রানি কিংবা তাদের মোবাইল ফোনসহ মূল্যবান সামগ্রী চুরি-ছিনতাইয়ের অভিযোগ যেমন আছে, তেমনি বিদেশি নাগরিকদেরও যে দেশে যাচ্ছেন সেই দেশের শিষ্টাচার, আচরণবিধি বা নির্দেশনাগুলো মেনে চলা উচিত। আমাদের দেশে বিদেশি নাগরিকরা অনেক সময় বিভিন্ন জায়গায় একা ঘুরে বেড়ান। বিভিন্ন অপরাধপ্রবণ এলাকায় গিয়ে সরল বিশ্বাসে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলেন—টিকটক, ব্লগ বা ভিডিও করেন। এতে তাদের কাছে থাকা অর্থ, দামি ফোন বা বিভিন্ন সামগ্রীর প্রতি অপরাধপ্রবণ ব্যক্তিদের টার্গেট তৈরি হয়।
তিনি বলেন, বিদেশিরা যদি আমাদের দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে মেশেন বা তার যদি সেই প্রয়োজন এবং অনুমতি থাকে, তখন তিনি যে সংস্থার হয়ে বাংলাদেশে এসেছেন সেই সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে রাখা উচিত। আর কেউ যদি একেবারে টুরিস্ট হিসেবে বেড়াতে বা ঘুরতে আসেন এবং যদি এখানকার স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রা বা তাদের মতামত জানার প্রয়োজন হয়, তাহলে সেটি পুলিশের অনুমতি নিয়ে পুলিশের উপস্থিতিতে করা উচিত। অন্যথায়, চুরি, ছিনতাই, হত্যার মতো ঘটনাগুলো নানাভাবে বাড়বে।
জাতীয় নিরাপত্তা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আবার বিদেশি নাগরিকদের মধ্যে কোনো কোনো দেশের নাগরিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে যে তারা এখানকার অপরাধীদের সঙ্গে মিশে নানা ধরনের অপরাধে সম্পৃক্ত হন। কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে কন্টেন্ট তৈরি করে সেটা বাইরের অন্য কোনো পক্ষ বা শক্তির কাছে পাঠান। এটি জাতীয়ভাবে বা রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের জন্য খুব হুমকির। তাই কোনো বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশে যে প্রয়োজনেই আসুক, তাদের একটি নির্দিষ্ট প্রটোকল অথবা ভ্রমণবিধি অথবা আচরণবিধি অনুসরণ করে সেটি করা উচিত। তাদের কাজে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা আমার অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতা করা উচিত। এই বিষয়ে সরকার একটি নির্দেশনা দিয়ে রাখতে পারে। কোনো বিদেশি যদি অশুভ কোনো উদ্দেশ্যে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে মিশে কন্টেন্ট তৈরি করে আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক কিংবা সাংস্কৃতিক কোনো বিষয়বস্তু বা বৈশিষ্ট্যকে অন্য কোনো শক্তি বা সংগঠনের কাছে পাঠান, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট দেশকে জানিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।
সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক আরও বলেন, এই বিষয়ে সরকারের একটি নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন। প্রয়োজনে বিদেশিদের জন্য ভ্রমণবিধি এবং আচরণবিধি কেমন হবে সেটা পর্যটন মন্ত্রণালয় বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করতে হবে।
আরও পড়ুন: চলন্ত ট্রেনের ছাদে ভ্লগ করতে গিয়ে চীনা নাগরিকের মোবাইল খোয়া, পুলিশ তদন্তে
এজেডএস/এসসি/এইচএ/