ঢাকা: পুঁজিবাজারে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই ২০১৩ সালে বাস্তবায়ন করা হয় বহুল আলোচিত ‘ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন’ প্রক্রিয়া—যার মাধ্যমে স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর মালিকানা ও ব্যবস্থাপনাকে আলাদা করা হয়েছিল। আশা করা হয়েছিল, এর ফলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসবে, বাজার হবে স্থিতিশীল।
ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশনের মূল উদ্দেশ্য ছিল এক্সচেঞ্জ পরিচালনায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করা। কিন্তু বাজারসংশ্লিষ্টদের মতে, বাস্তবে এর প্রভাব প্রায় শূন্য। স্বতন্ত্র পরিচালকদের মধ্যে অনেকে পুঁজিবাজার-অভিজ্ঞ না হওয়ায় কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে বাজারের শৃঙ্খলা নষ্ট হয়েছে, বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং ডিএসইর প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দুর্বল হয়েছে।
বাজারসংশ্লিষ্টদের মতে, গত ১২ বছরে স্বতন্ত্র পরিচালকদের মধ্যে অনেকেই পুঁজিবাজার বহির্ভূতখাত থেকে এসেছেন। বাজার সম্পর্কে তাদের পর্যাপ্ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা না থাকায় পুঁজিবাজারের উন্নয়নে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেননি। শুধু তাই নয়, পুঁজিবাজারকে রাজনীতিকরণের মাধ্যমে তৎকালীন সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে তারা কাজ করেছেন। এর ফলে বাজারের শৃঙ্খলা নষ্ট হয়েছে। বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং ডিএসইর প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি ভেঙে পড়েছে।
বিগত সরকারের আমলে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে অস্তিত্বহীন কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করে কোটি কোটি টাকা বাজার থেকে তুলে নেওয়ায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে ডিমিউচ্যুয়ালাইজেন। এতে করে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশা দেখা দেয়। কথার সঙ্গে কাজের মিল না থাকায় কর্তৃপক্ষের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা শূন্যের কোটায় নেমে আসে।
বিনিয়োগকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী সম্মিলিত পরিষদের সভাপতি আ ন ম আতাউল্লাহ নাঈম বাংলানিউজকে বলেন, যে স্বপ্ন দেখিয়ে ডিমিউচ্যুয়ালাইজেন করা হয়েছে, তা আজ পর্যন্ত বাস্তবায়ন না হওয়ায় বিনিয়োগকারীরা হতাশ। উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ভালো দেশীয় ও মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি বাজারে আনার ব্যাপারে বিএসইসিসহ সংশ্লিষ্টদের কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান হয়নি।
ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন ছিল পুঁজিবাজার সংস্কারের বড় একটি পদক্ষেপ। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিনিয়োগকারীর আস্থা ফেরাতে হলে কাঠামোগত সংস্কারের পাশাপাশি দরকার সুশাসন, স্বচ্ছতা ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর স্বার্থরক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা। অন্যথায় ডিমিউচ্যুয়ালাইজেনের সুফল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও অর্থসূচক সম্পাদক জিয়াউর রহমান বলেন, কাগজে-কলমে মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা আলাদা হলেও বাস্তবে এখনো মালিকরাই স্টক এক্সচেঞ্জে প্রভাব বিস্তার করছেন। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা বা সক্ষমতা—কোনোটিই বাড়েনি।
তিনি আরও জানান, ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশনের পর এক্সচেঞ্জগুলোর তালিকাভুক্ত হওয়ার কথা থাকলেও কোনোটি তা করেনি। এছাড়া কৌশলগত বিনিয়োগকারীদের মাধ্যমে নতুন প্রযুক্তি ও কারিগরি সক্ষমতা বৃদ্ধির যে প্রত্যাশা ছিল, তাও পূরণ হয়নি।
জিয়াউর রহমানের মতে, গত সরকারের সময়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির দায় নিয়ন্ত্রক সংস্থার পাশাপাশি স্টক এক্সচেঞ্জগুলোকেও নিতে হবে।
এদিকে স্টক এক্সচেঞ্জ পরিচালনায় এক যুগ আগে বাস্তবায়ন হওয়া ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন আইন নতুন করে পর্যালোচনার দাবি জানিয়েছে স্টক ব্রোকারগুলোর সংগঠন ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ডিবিএ)। একই সঙ্গে শেয়ারধারক পরিচালকরাও যাতে স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান হতে পারেন সেই দাবি তুলেছে সংগঠনটি।
সম্প্রতি সরকারের কাছে দেওয়া চিঠিতে ডিবিএ বলেছে, ডিএসইর পর্ষদ চেয়ারম্যানসহ স্বতন্ত্র পরিচালকদের রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়া হয়। স্বতন্ত্র পরিচালকদের অনেককে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়ায় তারা বাজার সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা না থাকায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেননি।
বাজার বিশ্লেষকদের মতে, শুধু কাঠামোগত সংস্কার করলেই পুঁজিবাজার স্থিতিশীল হবে না। প্রয়োজন শক্তিশালী নীতি সহায়তা, পেশাদার ব্যবস্থাপনা, কার্যকর তদারকি এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ।
ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশনের উদ্দেশ্য সফল হয়নি জানিয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বাংলানিউজকে বলেন, ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন স্কিমে বলা ছিল, ৫ বা ১০ বছর পর এটি রিভিউ করতে হবে। কিন্তু এক যুগেও তা হয়নি। বরং এখন দেখা যাচ্ছে, বাজারে শতাধিক নিম্নমানের কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে। আগে এমন জালিয়াতি দেখা যায়নি।
তিনি বলেন, এখন সময় এসেছে স্কিমটি পুনর্বিবেচনার। তবে রাজনৈতিক সরকার না এলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসবে বলে মনে হয় না।
ডিএসই ইতোমধ্যে কৌশলগত বিনিয়োগকারীদের কাছে ২৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করেছে। তবে বাকি ৩৫ শতাংশ শেয়ার এখনো সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রি হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএসইর এক কর্মকর্তা বলেন, ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন একটি চলমান প্রক্রিয়া। বাজারের দুরবস্থা ও উপযুক্ত দাম না পাওয়ায় সাধারণ জনগণের কাছে শেয়ার বিক্রি করা সম্ভব হয়নি।
এর প্রধান কারণ হিসেবে বাজারের খারাপ অবস্থা এবং উপযুক্ত দাম না পাওয়ার কথা বলেন তিনি।
তবে ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন ঠিক মতো ফাংশন করলে অবশ্যই বিনিয়োগকারীরা উপকৃত হবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের পরিচালক ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশনের লক্ষ্য ছিল মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনা পৃথক করা। যদি এক্সচেঞ্জগুলো স্কিম অনুযায়ী ফাংশন করে, তাহলে অবশ্যই বিনিয়োগকারীরা উপকৃত হবেন।
এসএমএকে/এজে