ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১ কার্তিক ১৪৩২, ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ২৩ রবিউস সানি ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

আ. লীগের ভোটাররা কোন দিকে যাবে?

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯:০৭, অক্টোবর ১৬, ২০২৫
আ. লীগের ভোটাররা কোন দিকে যাবে? আওয়ামী লীগের লোগো

আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেশে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিতে না পারলে দলটির নেতাকর্মী-সমর্থকরা ভোট দেবেন কি না, ভোট দিলে কোন দলকে দেবেন, নির্বাচনের সময় তাদের অবস্থান কী হবে- বিষয়টি নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা চলছে।

সাধারণ মানুষের মধ্যেও এ বিষয়ে কৌতূহল রয়েছে।

আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে সরকার ও নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের প্রস্তুতি শুরু করেছে। আসন্ন নির্বাচনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকছে না বলেই বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রতীয়মান হচ্ছে। বিগত তিনটি নির্বাচন একতরফা হওয়ায় কোন দলের ভোট কত শতাংশ তা ধারণা করা না গেলেও মনে করা হয়, সারা দেশে আওয়ামী লীগের একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোটার ছিল। তবে চব্বিশের ডামি নির্বাচন ও গণঅভ্যুত্থানের পর সেই সংখ্যা কততে এসে ঠেকেছে তা বলা মুশকিল।  

গত বছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতন ঘটে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের। সেদিন শেখ হাসিনার সঙ্গে সঙ্গে পতন ঘটে টানা প্রায় ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগেরও। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের পর দ্রুত দেশত্যাগ করে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা। এখনও সেখানেই অবস্থান করছেন তিনি। তবে ভারতে যাওয়ার কিছুদিন পর থেকেই তিনি দলের আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীর সঙ্গে মোবাইল ফোন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন।

সরকার পতনের দিনেই আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরাও নিজেদের রক্ষা করতে আত্মগোপনে চলে যান। শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ও সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের অনেকেই ওই দিন বা কিছু দিনের মধ্যেই চলে যান দেশের বাইরে। আবার কেউ কেউ আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি ও পরিস্থিতি বুঝতে পেরে ৫ আগস্টের আগেই দেশ ছাড়েন। সরকার পতনের পর দলের সভাপতি শেখ হাসিনাসহ কেন্দ্র থেকে শুরু করে ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত অধিকাংশ নেতাকর্মীর নামে মামলা হয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার এক বছর দুই মাস হলো, এখনো আওয়ামী লীগের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীকেই আত্মগোপনে থাকতে হচ্ছে। গ্রেপ্তার হয়েছেন হাজার হাজার নেতাকর্মী। অসংখ্য মামলা হয়েছে, কোনো কোনো মামলায় ৫/৬শ’ থেকে হাজারের মতো আসামি করা হয়েছে।

আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাহী আদেশে দলটির যাবতীয় কার্যক্রম স্থগিত করে। শুধু আওয়ামী লীগ নয়, দলটির সব সহযোগী ও অঙ্গ সংগঠনের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। একই সঙ্গে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করা হয়। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম স্থগিতের মেয়াদ থাকবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিচারকাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত। অন্যদিকে দলটির নিবন্ধন ও দলীয় প্রতীক নৌকা স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন।

এদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করেছে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল যথাযথ ব্যবস্থা নেবে বলে জানা গেছে। আগামী বছর ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকছে না বলে ধারণা করা যাচ্ছে। তবে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারলে দলটির যে ভোটার রয়েছে তাদের অবস্থান কী হবে, নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে মানুষের মধ্যে সেই কৌতূহল তত বাড়ছে।

১৯৭৫ সালের পর আওয়ামী লীগ প্রথম ক্ষমতায় আসে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয়লাভের মধ্য দিয়ে। ১৯৯৬ সালের ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩৭ দশমিক ৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। সংসদে দলটির আসন ছিল ১৪৬টি। এরপর ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ফলাফলে ব্যাপক বিপর্যয় ঘটে। ওই নির্বাচনে দলটি মাত্র ৬২টি আসন পায়। কিন্তু সেই নির্বাচনে তাদের ভোট ছিলো ৪০ দশমিক ২ শতাংশ। বিগত ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসে। ওই নির্বাচনে দলটি ভোট পেয়েছিল ৪৮ দশমিক ০৪ শতাংশ। গত কয়েকটি নির্বাচনের এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী আওয়ামী লীগের ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ ভোট রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। বর্তমানে এই সংখ্যা কমলেও দলটির অন্তত ২৫ শতাংশ ভোট এখনও আছে বলেও ধারণা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। আর এ কারণেই আগামী নির্বাচনের আলোচনার সঙ্গে এই ভোটারদের অবস্থান কী হবে, সেই আলোচনাও কমবেশি উঠছে।

আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, যেহেতু আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সব আয়োজন সম্পন্ন করার চেষ্টা চলছে। সেটা যদি হয় এবং আওয়ামী লীগকে যদি নির্বাচন থেকে শেষ পর্যন্ত বাদ দেওয়াই হয় তাহলে আওয়ামী লীগও চেষ্টা করবে নির্বাচনে যাতে ভোটার উপস্থিতি কম থাকে। সে ক্ষেত্রে দলের কর্মী-সমর্থকদের প্রতি ভোট বর্জন করা, কোনোভাবে ভোটে অংশগ্রহণ না করা ও ভোট না দেওয়ার নির্দেশনা থাকবে। যত বেশি সংখ্যক কর্মী-সমর্থককে ভোট দেওয়া থেকে বিরত রাখা যায়, সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে আওয়ামী লীগ।

সূত্রগুলো আরও জানায়, এর জন্য বিভিন্নমুখী কৌশলও নেওয়া হতে পারে। এসব কৌশলের মধ্যে নির্বাচনে যারা অংশগ্রহণ করবেন তাদের মধ্যে তুলনামূলক দুর্বল দল, দুর্বল প্রার্থী, রাজনীতিতে আলোচিত নয় এমন দল বা প্রার্থী, জাতীয় বা স্থানীয়ভাবে যে প্রার্থীরা আলোচিত নন তাদের আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা ভোট দিতে পারেন। আর ভোট দিলেও কোনভাবেই রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল বা দলের প্রার্থীরা যাতে ভোট না পায় বা তাদের যাতে ভোট দেওয়া না হয়, দল থেকে কর্মী-সমর্থকদের এমন নির্দেশনাও দেওয়া হতে পারে। তবে নিজস্ব ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত না হওয়া এবং ভোট দেওয়া থেকে বিরত রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হতে পারে বলে জানায় সূত্রগুলো।

যদিও নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ কী কৌশল নিতে পারে, সে ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। কারণ বিষয়টি নিয়ে দলীয় ফোরামে আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা করার মতো অবস্থানে নেই দলটি। দলের নীতিনির্ধারণী ফোরামের আনুষ্ঠানিক বৈঠক করার কোনো সুযোগও নেই। তবে দলের সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যোগাযোগ রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ব্যবহার করে শেখ হাসিনাসহ দলের অন্যান্য নেতারা অনানুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের মধ্যে ও কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দিয়েই বিভিন্ন সময়ে দলের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত কর্মী পর্যায় পর্যন্ত জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আগামী নির্বাচনের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হলে এবং কর্মী-সমর্থকদের জন্য কোনো নির্দেশনা থাকলে একইভাবে তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। তবে বিষয়টি নিয়ে এখনই আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা ভাবছেন না বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে অজ্ঞাত স্থানে আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের এক নেতা জানান, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। দলের নেতাকর্মীদের ওপর চলছে জেল-জুলুম ও অত্যাচার-নির্যাতন চলছে। আওয়ামী লীগের কার্যক্রমকে নিষিদ্ধ রাখা হয়েছে। আগামী নির্বাচন থেকে বাদ দেওয়ার সব ধরনের আয়োজন চলছে। আওয়ামী লীগের একটা বড় সংখ্যক ভোটার রয়েছে। তাই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না দিলে আওয়ামী লীগ অবশ্যই চাইবে ভোটাররা যাতে ভোট না দেয়। যত বেশি সংখ্যক ভোটারকে দেওয়া থেকে বিরত রাখা যায়, সেই চেষ্টা হবে- এটাই স্বাভাবিক। এ বিষয়ে দল যথাযথ কৌশল নেবে।

এসকে/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।