অ্যাডিলেড থেকে: বাঘের থাবায় নিহত সিংহ! আর তাতেই শোকস্তব্ধ ইংলিশরা! আতঙ্কিত তেরঙার চরকাধারী! ৯ মার্চ রাতের পর থেকে ইংলিশ ক্রিকেটে যেন চলছে জাতীয় শোক! অন্যদিকে বাঙালির বিশ্বে চলছে আনন্দোল্লাস। সেটা যেন জাতীয় পর্যায় ছাড়িয়ে আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে।
তাদের আনন্দটা হয়তো অন্য জায়গায়। ক্রিকেটীয় চিরশত্রুর আগে ভালোমতো আঁচড় দিয়েছে বাঘ। রক্তাক্ত সিংহকে বিশ্বকাপে নিস্তব্ধ হতে দেখে তারা আনন্দ পাবে না কেন? ব্র্যাডম্যানের শহরে বাঙালিদের দেখলে তাই অজিরা বলে উঠছেন, ‘হাই! ইউ গাইজ কিক ব্যাক পম! ওয়েলডান!’ সরাসরি সেভাবে এর বাংলা করা ঠিক হবে না। তবে ভাবার্থ ঠিক রেখে এটুকু লেখা যায়, তোমরা আমাদের পূর্বপুরুষের জন্মভূমির লোকজনকে পশ্চাদদেশে লাথি মেরে বিশ্বকাপ থেকেই বের করে দিলে! ভালোই করেছে। তোমাদের অভিনন্দন।
হ্যাঁ, অভিনন্দনের জোয়ারে ভাসছেন মাশরাফি ও তার দল। টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশ দলকে অভিনন্দন জানিয়েছেন ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক ইয়ান বোথাম। সাবেক এই ইংলিশ তারকা অলরাউন্ডার লিখেছেন, আমি ব্যথিত। দুঃখিত। ইংল্যান্ডের হার মর্মান্তিক। কিন্তু অভিনন্দন বাংলাদেশকে। ওয়েলডান বাংলাদেশ।
কিন্তু ইংল্যান্ডের যেটা প্রাপ্য সেটা মিটিয়ে দিতেও কার্পণ্য করেননি অনেকে। কেপি মানে কেভিন পিটারসেন যেমন লিখেছেন, আমি বিশ্বাস করতে পারছি না! সত্যিই পারছি না! ওয়েলডান বাংলাদেশ। তোমরা এটার যোগ্য। ইংল্যান্ড যে বিশ্বকাপের জন্য কম প্রস্তুতি নিয়েছে তা কীভাবে বলবো? ব্যাক টু ব্যাক অ্যাসেজ খেলেছে তারা। এই বিশ্বকাপের আগে ছ’মাসতো ওয়ানডে ম্যাচ-ই খেললো!
কেন হারাল ইংল্যান্ড- তার ময়না তদন্ত হয়তো চলবে আরো কিছুদিন। অনেক সুপারিশ আসবে। এবং আসতে শুরু করেছে। কিন্তু বিশ্বক্রিকেটে ভারত-অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে জোট বেঁধে ‘বিগ থ্রি’ হতে গিয়ে ইংল্যান্ডের হাল তো দেখলো বিশ্ব ক্রিকেট। স্কটল্যান্ড ছাড়া বাকি কোনো দলকে হারানোর ক্ষমতা এখন তাদের নেই! ইংল্যান্ডকে হারানোর ওই দৃশ্য তাসমান সাগরের ওপারে হ্যামিল্টনে বসে টেলিভিশনে দেখেছেন ভারতীয় দলের সদস্যরা। ভারতীয় এক সাংবাদিক তেমনটা জানালেন মোবাইলে হ্যামিল্টন থেকে। আর এই ভারতের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ কোয়ার্টার ফাইনালে মেলবোর্নে। সেখানে এই ম্যাচ নিয়ে নতুন করে আগ্রহ তৈরি হয়েছে স্থানীয়দের মধ্যেও।
অনেকে ধরে নিয়েছিল এমসিজিতে ভারত খেলবে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। কিন্তু ক্রিকেট দেবতা তখন বোধহয় মুচকি হাসছিলেন। কারণ তিনি যে অন্যরকম চিত্রনাট্য লিখে রেখেছিলেন। আর সে অনুযায়ী পারফরম করিয়ে নিলেন বাংলাদেশকে দিয়ে। যখন যা দরকার ছিল সেটাই করলো বাংলাদেশ দল। আর বাংলাদেশ দলের এই পারফরম্যান্সের পর এম এস ধোনির দলও নতুন করে ভাবছে বাংলাদেশকে নিয়ে। ভারতীয় এক সিনিয়র সাংবাদিক অবশ্য বললেন, ভাবতে বাধ্য হচ্ছে। আট বছর আগের ইতিহাস ফিরে আসবে না আবার এমন গ্যারান্টি কে দিতে পারেন? কে বলতে পারেন ১৯ মার্চ এমজিসি ২০০৭ সালের কুইন্স পার্ক ওভাল হবে না সেটা নিশ্চিত করে কি বলা যায়?
পোর্ট অব স্পেনে সেদিন ভারতকে হারিয়ে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় করে দিয়েছিল বাংলাদেশ। সে দিন তিনি মাঠে থেকে দেখেছিলেন ভারতের হার। তাই আতঙ্কের একটা চোরাস্রোত বইতে শুরু করেছে ভারতীয়দের মধ্য এমনটা মনে করেন সেদিনের ডেকান হেরাল্ডের সাংবাদিক আজকের উইজডেন ইন্ডিয়ার ডেপুটি এডির আর কৌশিক। মেলবোর্নে অবশ্য ধোনির দলের পেছনে থাকবে সত্তর হাজারের মতো সমর্থক। তবে পিছিয়ে থাকবেন না মেলবোর্নের বাঙালি দর্শকরাও।
মনাস ইউনিভার্সিটির ইংরেজির শিক্ষক বায়েজিদ আলম যেমন টেলিফোনে বললেন, আমরা কোয়ার্টার ফাইনালে টিকিট কেটে ফেলেছি আজ। সত্যিই আগে ভাবতে পারিনি। বাংলাদেশ বিশ্বকাপে এতোটা দূর আসতে পারবে। আমার অজি বন্ধুরাও আজ একটু অন্যরকমভাবে অভিনন্দন জানালো আমাদের। সত্যিই এতো দূরে থেকেও ভালো লাগছে। গর্ব করে বলার মতো একটা জিনিস আমাদেরও আছে। ক্রিকেট। ১৯ মার্চ আমরাও থাকছি এমসিজিতে। লিখে দিন বাঙালিরা ঢাক-ঢোল-কাশা-ঘণ্টা নিয়েই সেদিন হাজির হবে এমসিজিতে।
তার কথাগুলো শুনতে মনে হলো মেন ইন ব্ল বনাম মেন ইন গ্রিনের লড়াইয়ে তাহলে গ্যালারিতেও চলবে লড়াই। গ্যালারি যদি কখনো নীল সমুদ্র মনে হয় তারপরই তা রং পাল্টে হতে পারে সবুজ !
তবে তার আগে অস্ট্রেলিয়ার সব বাঙালির জীবনে শরৎ এখন এসেছে বসন্ত হয়ে! যেখানে বাসন্তী রং হলুদ নয়, সবুজ! মেলবোর্নের ইয়ারা নদীর পাড়ে ১৯ মার্চ নীল না সবুজ ঢেউ আঁছড়ে পড়বে সেটা এখন-ই বলা যাচ্ছে না। কিন্তু টরেন্স নদীর পাড়ে অ্যাডিলেডে ইংলিশদের উপর সুনামির মতো আঁছড়ে পড়লো যে ঢেউ তার রং খানিকটা সবুজ, খানিকটা লাল!
রুবেলের হাত থেকে সাদা বল এরকম বেদনার নীল ছড়াবে ইংলিশদের মনে সেটা হয়তো ভাবতে পারেননি কেউ! যে শহর থেকে উঠে আসা রুবেলের সেই বাগেরহাটের এক অ্যাডিলেড প্রবাসী ডাক্তার মোর্শেদ ম্যাচের পরদিন সকালে কেনসিন্টন এলাকার হোল্ডেন স্ট্রিটের দুই নম্বর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বলছিলেন, এই বাড়িটায় যে লোকটা বাস করতেন বেঁচে থাকলে তিনি বোধহয় বলতেন ইংলিশরা। ব্যাটসম্যানের শরীর টার্গেট করে বল করতে শিখেছিল! কিন্তু নিজেদের স্টাম্প কীভাবে অক্ষত রাখতে হয় সেটা শিখতে পারেনি!
তাই একটা ছেলে পর পর দুই বলে স্টাম্প ভেঙে দিলো ওদের দুই ব্যাটসম্যানের। বৃদ্ধ কি বলতেন রুবেলকে জানি না। তবে আমার বলতে ইচ্ছে করছে, ওয়েলডান, রুবেল। তুমিও পেতে পারতে ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কারটা। কিন্তু আক্ষেপের কিছু নেই। তুমিতো গোটা দেশকে খুশির জোয়ারে ভাসিয়ে দিলে!
হোল্ডেন স্ট্রিটের দুই নম্বর বাড়ির বাসিন্দা আমৃত্যু একটা ক্ষোভ পুষে রেখেছিলেন ইংরেজদের প্রতি। বডি লাইন সিরিজে ওরা যা করেছিল তার জন্য। কিন্ত সেই ইংরেজরা বোধহয় অনেকদিন রুবেলকে মনে রাখবেন। কারণ, স্যার ডনের শহরেই তাদের স্বপ্নের কফিনে শেষ দুটো পেরেক পুতে দিয়েছেন রুবেল পর পর দু’বলে! ইংরেজরা খুব তাড়াতাড়ি ভুলে যেতে পারবেন তা!
বাংলাদেশ সময়: ২২০৪ ঘণ্টা, মার্চ ১০, ২০১৫