ট্যাগটা তাদের গায়ে লেগেই আছে ‘চোকার’! কিন্তু কেন? তার উত্তরে সাউথ আফ্রিকাকে নিয়ে কতো শব্দ খরচ করেছে ক্রিকেট মিডিয়া তার হিসেব নেই। তবে এই চোকার শব্দটা শুনতে শুনতে সাউথ আফ্রিকান ক্রিকেটাররা রীতিমতো ক্লান্ত।
হ্যাঁ, শন পোলকের দাবিটা মোটেও অসত্য নয়। চাপের মুখে ভেঙে পড়া দলের নাম শুধু সাউথ আফ্রিকা নয়। তবে সাউথ আফ্রিকার মতো এরকম চোকার অপবাদ নিয়ে ক্রিকেট বিশ্বে অন্য কোনো দলকে ঘুরতে হয় না। এটাকে ওদের দুর্ভাগ্যই বলতে পারেন।
তবে সৌভাগ্য সাউথ আফ্রিকার। এরকম একটা অপবাদ মুঁছতে তাদের হয়ে ব্যাট করার জন্য দু’একজন ভদ্রলোকও ক্রিকেট বিশ্বে আছেন। যারা সাউথ আফ্রিকান নন। ভিন্ন দেশি ক্রিকেটার। এবং সেই তালিকায় খুব উপরের দিকে রাখা উচিৎ মাশরাফি বিন মর্তুজার নাম। তবে তিনি অবশ্যই বাইশ গজের ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মর্তুজা নন। মাঠের বাইরের মাশরাফি। খুব বড় একটা হৃদয় যার বুকের মাঝখানে! তাই মাশরাফির পক্ষে বলা সম্ভব ‘কাউকে চোকার বলে ছোট করা উচিৎ নয়। ওরকমভাবে বললে একটা জাতিকে অপমান করা হবে। আমি অন্তত কোনো ব্যক্তি বা জাতিকে অপমান করতে রাজি নই চোকার বলে!’
মাশরাফি না চাইলেও যে মিরপুরের শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে হাজার হাজার দর্শক দেখলেন চাপে পড়লে সত্যিই ‘চোক’ করে সাউথ আফ্রিকা। আর মাশরাফি এবং তার দলকে কৃতিত্ব দিতে হবে সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে প্রোটিয়াদের রীতিমতো টুটিচেপে ধরেছিল তারা। ম্যাচের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রচণ্ডরকমে চাপে ছিল সাউথ আফ্রিকা। যে চাপ থেকে তারা বের হয়ে আসতেই পারলো না। বরং শেষ দিকে রীতিমতো হাঁসফাঁস করছিল! চাপটা এমনভাবে টের পাচ্ছিলো যে সৌম্য সরকারের দেয়া ক্যাচ নিতে গিয়ে দু’জন ফিল্ডার মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে গেলেন! মনে করিয়ে দিলেন গতবিশ্বকাপের সেমিফাইনাল ম্যাচের কথা। চাপের মধ্যে পড়ে ক্যাচ ড্রপ, রান আউট মিস সবই করেছিল সাউথ আফ্রিকানরা! এটা হয়তো বিশ্বকাপ ম্যাচ নয়। বড় কোনো টুর্নামেন্টও নয়। তবে বাংলাদেশের বিপক্ষে ওয়ানডে ইতিহাসে এতোটা চাপে কখনো পড়েনি সাউথ আফ্রিকানরা। ২০০৭ এর বিশ্বকাপে গায়ানায় যে ম্যাচটা হেরেছিল বাংলাদেশের বিপক্ষে সাউথ আফ্রিকা সেই ম্যাচেও হয়তো এতোটা চাপ অনুভব করেনি তারা!
তবে এবার ম্যাচ পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে এসে বাংলাদেশ অধিনায়ক ‘চোক’ ইস্যুতে যেভাবে সাউথ আফ্রিকানদের পাশে দাঁড়ালেন, সেটা শুনে স্বর্গ থেকেও নেলসন ম্যান্ডেলা অভিভুত হতে পারেন! কোনো দলের গায়ে চোকারের লেবেল এঁটে দিয়ে একটা জাতির জাতীয় সত্ত্বাকে আঘাত করার দর্শনে বিশ্বাসী নন বাংলাদেশ অধিনায়ক। কিন্তু স্বর্গবাসী ম্যান্ডেলা কেন, ঢাকায় থাকা সাউথ আফ্রিকান সাংবাদিকরাও যে শুনলেন না বাংলাদেশ অধিনায়কের সেই উদার ক্রিকেটীয় দর্শনের বাণী! শুনলে হয়তো বুঝতেন বাংলাদেশ অধিনায়ক বাইশ গজের চেয়েও অনেক বেশি চৌকশ মাঠের বাইরে। তাই মাশরাফির পক্ষে বলা সম্ভব;‘বাইশ গজের চ্যালেঞ্জ বাইশ গজেই। ‘ কোনো ক্রিকেটীয় চ্যালেঞ্জের ছায়া জীবনের ওপর ফেলতে দিতে রাজি নন তিনি। যে মানুষটা গোটা ক্রিকেট ক্যারিয়ারের ইনজুরি নামক চ্যালেঞ্জের হার্ডল পেরিয়ে এসেছেন একের পর এক, তার কাছে আসলে ক্রিকেটের বাকি সব চ্যালেঞ্জ-ই তুচ্ছ! সে কারণে মাশরফি বলতে পারেন;‘ আমি জীবনের অন্য কিছুকে চ্যালেঞ্জ মনে করি না। আমার কাছে চ্যালেঞ্জ বলতে আমার ছেলে আর মেয়েকে ঘিরে জীবনটাই। অন্য কিছু নয়। ’ এই হচ্ছে যার জীবন দর্শন, অধিনায়ক হিসেবে তার দর্শন,আগে টিম। তারপর ব্যক্তি। তাই ব্যক্তির পারফরম্যান্সের চেয়ে দলের পারফরম্যান্সটাই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশ অধিনায়কের কাছে।
তবে সেই অধিনায়ককেও মাঠের বাইরে অনেক অপ্রত্যাশিত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি কি দাঁড় করানো হচ্ছে না? এরকম একজন অধিনায়ক যে দলটাকে মাঠে নেতৃত্ব দেন, সেই অধিনায়ক কি সব সময় তার পছন্দের একাদশ পাচ্ছেন? কিংবা দেয়া হচ্ছে? একাদশ গড়ার ক্ষেত্রে যে দেশে গণ ‘ওপেনিয়ন পোল’ নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে, সেই দেশে মাশরাফির মতো অধিনায়কের ক্রিকেট দর্শন, জীবণ দর্শন একটু বেমানান মনে হতেই পারে। তারপরও অভিবাদন জানাতেই হবে সেই মাশরাফিকে, যিনি মানুষ হিসেবে অনেক অ-নে-ক বড়। ম্যাচের আগের দিন প্রচণ্ড চাপের মধ্যে থেকেও সাউথ আফ্রিকাকে হারিয়ে উঠে এসে বলতে পারেন; ‘ওদের কেন, কাউকে-ই চোকার বলার নীতিতে আমি বিশ্বাসী নই। ’
বাংলাদেশ সময়: ০৩১৮ ঘণ্টা, জুলাই ১৩, ২০১৫
এসএইচ