চট্টগ্রাম: কাগজে কলমে ৫০ কোটি লিটার পানি সরবরাহের সক্ষমতা থাকলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন চট্টগ্রাম ওয়াসার। সিস্টেম লস, সঞ্চালন লাইনে ত্রুটিসহ বিভিন্ন কারণে এখনও সক্ষমতার পূর্ণ সুবিধা মিলছে না।
চট্টগ্রাম ওয়াসার হিসেব অনুযায়ী, ৪টি পানি শোধনাগার থেকে চট্টগ্রামে পানি সরবরাহ করা হয় প্রায় ৪৬ কোটি লিটার। এর মধ্যে কর্ণফুলী পানি শোধনাগার-১ ও ২ থেকে আসে ১৪ কোটি করে মোট ২৮ কোটি লিটার পানি। এর বাইরে মদুনাঘাট পানি শোধনাগার থেকে ৯ কোটি লিটার ও মোহরা পানি শোধনাগার থেকে ৯ কোটি লিটার পানি পাওয়া যায়। এ ছাড়া গভীর নলকূপ থেকে আসে প্রায় ৪ কোটি লিটার পানি। সব মিলিয়ে ওয়াসার দৈনিক উৎপাদন সক্ষমতা ৫০ কোটি লিটার। ওয়াসার দাবি, তা মোট চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশ। যদিও সিস্টেম লস সহ বিভিন্ন কারণে সক্ষমতা পুরোটা গ্রাহক পর্যায়ে পৌঁছে দিতে পারে পারে না প্রতিষ্ঠানটি। ফলে নগরের বিভিন্ন এলাকায় পানি পান না গ্রাহকরা।
সিস্টেম লসের কবলে ওয়াসা
ওয়াসার তথ্যানুযায়ী, প্রতিদিন যে পরিমাণ পানি উৎপাদন করে, তার প্রায় ৩০ শতাংশ ‘সিস্টেম লস’ (কারিগরি অপচয়) হিসেবে দেখানো হয়। অর্থাৎ ওয়াসা প্রতিদিন ৫০ কোটি লিটার পানি পরিশোধন করলে এর প্রায় ১৫ কোটি লিটারই নষ্ট হচ্ছে। যার বিল আসে না ওয়াসার পকেটে। ফলে লোকসান সমন্বয় করতে গড় বিলের খড়গ নেমে আসে গ্রাহকদের ঘাড়ে। প্রায় প্রতিদিনই গড় বিলের অভিযোগ নিয়ে ওয়াসায় হাজির হন গ্রাহকরা।
ডিজিটালাইজড হয়নি বিলিং ব্যবস্থা
ওয়াসার পানি সরবরাহে সক্ষমতা বাড়লেও এখনও আধুনিকায়ন করা যায়নি বিলিং ব্যবস্থা। ফলে ব্যবহারের চেয়ে বেশি বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে গ্রাহকদের। ওয়াসার একাধিক গ্রাহকের অভিযোগ, চাহিদা অনুযায়ী পানি না পেলেও মাস শেষে মোটা অঙ্কের বিল পরিশোধ করতে হয় তাদের। অন্যদিকে অভিযোগ রয়েছে, ওয়াসার অসাধু মিটার পরিদর্শকদের যোগসাজশে অনেক গ্রাহক মিটার টেম্পারিং করে পানি বিল কমিয়ে আনেন। এতে লোকসানে পড়ছে ওয়াসাও।
জানা গেছে, বিল ব্যবস্থা ডিজিটালাইজড করতে প্রায় দুই বছর আগে অটোমেটেড মিটার রিডিং ফিচারের স্মার্ট ওয়াটার মিটার প্রতিস্থাপনের প্রকল্প হাতে নেয় প্রতিষ্ঠানটি। পাইলট প্রকল্প হিসেবে প্রাথমিকভাবে তিন হাজার গ্রাহকের কাছে এ মিটার দেওয়া হয়। যা এখনও চলমান রয়েছে। তবে প্রকল্পের মাঝপথে কাউকে কিছুই না জানিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যান এ প্রকল্পের পরিচালক। ফলে অনেকটাই স্থবির প্রকল্পটি।
সঞ্চালন লাইনে ত্রুটি
বর্তমানে ওয়াসার আবাসিক সংযোগ রয়েছে ৯০ হাজার ৭২৩টি। এছাড়া ৭৭০ কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে ওয়াসা পানি সরবরাহ করে। তবে অধিকাংশ লাইনই পুরনো। বেশিরভাগ সঞ্চালন লাইন এখনও পুরোনো রয়ে যাওয়ায় পানি পরিশোধন সক্ষমতার পুরোটা সরবরাহ করা সম্ভব হয় না। প্রায় সময়ই পানির তীব্র বেগের কারণে নগরের বিভিন্ন স্থানে পানির পাইপ ফেটে রাজপথ তলিয়ে যেতে দেখা যায়। বহু বছরের পুরোনো এসব সঞ্চালন লাইন প্রতিস্থাপন করা না গেলে পানির সংকট আরও তীব্র হবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
পানিতে লবণাক্ততা
শুষ্ক মৌসুম এলেই ওয়াসার পানিতে বাড়ে লবণাক্ততা। নগরবাসীর সুপেয় পানির চাহিদা মেটাতে ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করে ওয়াসা। যা গত কয়েক বছরে বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ। ৩টি পানি শোধনাগার স্থাপন করা হয়, যার মধ্যে দুটি হালদায় ও একটি কর্ণফুলী নদী নির্ভর। এর মধ্যে শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার ১ ও ২ কর্ণফুলী নির্ভর এবং শেখ রাসেল পানি শোধনাগার ও মোহরা পানি শোধনাগার হালদা নির্ভর। শেখ রাসেল ও মোহরা পানি শোধনাগার থেকে নগরে চাহিদার ৫০ শতাংশ পানি উত্তোলন করা হয়। এছাড়া শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার ১ ও ২ এর মাধ্যমে ৩৮ শতাংশ এবং ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে বাকি ১২ শতাংশ পানির চাহিদা মেটানো হয়। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে কর্ণফুলী ও হালদার পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় পরিশোধন করার পরও লবণাক্ততা বাড়ছে। ফলে পানি সরবরাহ কমিয়ে দেয় ওয়াসা।
প্রতিষ্ঠানটির দাবি, কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পানি কম নির্গমনের কারণে পানিতে লবণাক্ততা বাড়ছে। তবে প্রকল্প শুরুর আগে সমীক্ষা কার্যক্রম যথাযথ না হওয়ায় ৬-৭ বছরের মাথায় নগরবাসীকে এ সমস্যায় পড়তে হচ্ছে বলে মনে করেন পানি নিয়ে গবেষণা করা বিশেষজ্ঞরা।
হালদা নদী যেখানে কর্ণফুলীর সঙ্গে মিশেছে, তার আধা কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম ওয়াসার মোহরা পানি শোধনাগার ফেইজ-১। এর জন্য দিনে ৯ কোটি লিটার পানি তোলা হয়।
দুই নদীর সংযোগস্থলের ছয় কিলোমিটার উজানে মদুনাঘাট পানি শোধনাগারের জন্যও প্রতিদিন ৯ কোটি লিটার পানির প্রয়োজন পড়ে।
চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে বৃষ্টির অভাবে কাপ্তাই হ্রদের উজানে পর্যাপ্ত পানি থাকে না। ফলে সেখান থেকে পানি ছাড়া হয় তুলনামূলক কম। সেই স্বল্প পানি বিপরীতমুখী সাগরের পানিকে জোরালো বাধা দিতে পারে না। ফলে অন্য সময়ের চেয়ে বেশি পরিমাণ সাগরের নোনা পানি কর্ণফুলী হয়ে ঢুকে পড়ে হালদা নদীতে। এই তীব্র লবণাক্ততার কারণে জোয়ারের সময় নদী থেকে পানি নেওয়া বন্ধ রাখতে হয় চট্টগ্রাম ওয়াসার দুই পানি পরিশোধন কেন্দ্রে। তাতে দৈনিক পানি পরিশোধন কমে যায় প্রায় ৫ কোটি লিটার। তখন চাহিদা অনুযায়ী পানি না পেয়ে দুর্ভোগ পোহাতে হয় চট্টগ্রামবাসীকে।
গত কয়েক বছর ধরেই এই সংকট চলছে। শুষ্ক মৌসুমে নগরীর হালিশহর, উত্তর কাট্টলী, পতেঙ্গা, বাকলিয়া, লালখান বাজার, শুলকবহর, আমানবাজার, আমবাগান, শেরশাহ, কালুরঘাট শিল্প এলাকা, চন্দনপুরাসহ বিভিন্ন এলাকায় পানি সরবরাহ বিঘ্নিত হয়। চলমান এই সংকটের সঙ্গে আছে পানির বর্ধিত চাহিদা।
চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম বাংলানিউজকে বলেন, দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হলে এবং কাপ্তাই হ্রদের পানি কম ছাড়লে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে যায়। লবণাক্ততার কারণে শেখ রাসেল পানি সরবরাহ প্রকল্প ও মদুনাঘাট পানি শোধনাগার থেকে পানি উৎপাদনে সমস্যা হয়। তবে বৃষ্টি এলেই লবণাক্ততার পরিমাণ পুরোপুরি কমে আসে।
প্রধান প্রকৌশলী আরও জানান, ২০৩২ সালে চট্টগ্রামে পানির দৈনিক চাহিদা বেড়ে দাঁড়াবে ৭৫ কোটি লিটার। ২০৪২ সালে চাহিদা হবে ১০০ কোটি লিটারের বেশি। লবণাক্ততার সমস্যা সমাধানে পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৪ ঘণ্টা, মার্চ ১৯, ২০২৫
এমআর/টিসি