চট্টগ্রাম: প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আমরা যে ধরনের বিশ্ব গড়তে চাই, সেই বিশ্ব গড়ার ক্ষমতা আমাদের আছে, সব মানুষেরই আছে। কিন্তু আমরা গৎবাঁধা পথে চলে যাই বলে নতুন পৃথিবীর কথা চিন্তা করি না।
বুধবার (১৪ মে) বিকেলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তার বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, এ পৃথিবীর ভবিষ্যৎ আমাদের প্রত্যেকের হাতে। আমরা যেভাবে বিশ্বকে গড়তে চাই সেভাবেই বিশ্ব গড়তে পারি। আমি যেভাবে বলেছি সেভাবে গড়তে হবে এমন কোনো কথা নেই। আমি আমার কথাটা বলে যাচ্ছি। অন্যরা তাদেরটা বলবে। কিন্তু নিজের মনের একটা স্বপ্ন থাকতে হবে এটাই আমার আবেদন। আমি কী ধরনের বিশ্ব চাই, কী ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চাই, কী ধরনের সমাজ চাই, কী ধরনের দেশ চাই-সবকিছু নিয়ে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে একটা স্বপ্ন থাকতে হবে। কিন্তু স্বপ্ন না দেখে গর্তের মধ্যে ঢুকে গেলাম, যা আছে মেনে নিলাম, তাহলে কিছুই পালটাবে না, কিছুই পরিবর্তন হবে না।
দুটি নোবেল পুরস্কার পাবার জন্য চবি গর্ববোধ করতে পারে উল্লেখ করে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ড. ইউনূস বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় যখন নিজের পরিচয় দেয়, হয়তো নোবেলের জন্য গৌরববোধ করে। কিন্তু চবির গৌরববোধ করার কারণ দুইটা আছে। পুরো কর্মসূচি, যার জন্য নোবেল পুরস্কার, এর গোড়াপত্তন হয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। একটি তো আমি ব্যক্তিগতভাবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছি। তারপর যে গ্রামীণ ব্যাংক সৃষ্টি হলো, এ ব্যাংকের গোড়াতেও চবি। গ্রামীণ ব্যাংকের আইনে এটা পরিষ্কার লেখা আছে যে, এটা কোথা থেকে আসল? ব্যাংকের জন্ম হয়েছে চবিতে অর্থনীতি বিভাগে, এটা স্পষ্ট উল্লেখ আছে। এ ব্যাংকও নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান। কাজেই দুটি নোবেল পুরস্কারের বিষয় চবি তার ছাত্রছাত্রীদের এর ইতিহাস জানাতে পারে। তাহলে ছাত্রছাত্রীরা ঠিক করবে যে তারা কী ধরনের ভবিষ্যৎ গড়তে চায়।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ৭৪ সালে বিরাট দুর্ভিক্ষ হলো। সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল। মনের মধ্যে বহু জিজ্ঞাসার সৃষ্টি হলো। মনে মনে ভাবলাম, সারা বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ ঠেকানোর ক্ষমতা আমার নেই, আমি চেষ্টা করতে পারি, এ বাংলাদেশের একটি ক্ষুদ্র অংশের, কয়েকটি পরিবারের যদি দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে পারি, তাহলে সেটা আমার জন্য তৃপ্তির বিষয় হবে যে আমি একটা কিছু করেছি। সে কারণে নজর পড়ল পাশের গ্রাম জোবরার ওপর। কী করবে জোবরাতে, সারাদেশে হাহাকার। জোবরাতে কেউ তখনও মারা যায়নি, কিন্তু অবস্থা কাহিল। মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগল, এ চবি আর জোবরা গ্রামের মাঝামাঝি বিশাল জমি পড়ে আছে, এখানে তো অনেক ফসল হওয়ার কথা, তাতে তো তাদের সারাবছরের খাবার সংস্থান হওয়ার কথা। জিজ্ঞেস করলাম, বলে- এখানে ফসল হয় না। কেন হয় না- বলে বৃষ্টি না হলে তো ফসল হবে না। আমি তখন রাউজানের উদাহরণ দিলাম, রাউজানে তখন সবেমাত্র ইরিধানের চাষ শুরু হয়েছে। বলে- আমরা তো জানি না এগুলো।
বিশ্ববিদ্যালয়কে জিজ্ঞেস করলাম। বিশ্ববিদ্যালয় যদি জ্ঞানের ভাণ্ডার হয়, এ জ্ঞান পাশের গ্রামে উপচে পড়ে না কেন, তারা জানে না কেন? কেউ কোনো সদুত্তর দিল না বা দেওয়ার চেষ্টাও করলো না। তখন আমি চেষ্টা করলাম এদের চাষের দিকে আগ্রহী করা যায় কিনা, তখন বলে যে- পানি তো নেই, রাউজানে পানি আছে, এখানে তো পানি নেই। ডিপটিউবওয়েল তখন সবে এসেছে দেশে, ওদের ডিপটিউবওয়েল আছে, আমাদের নেই। বহু চেষ্টা তদবির করে একটা ডিপটিউবওয়েল বসালাম। কী হবে- এখানে শীতকালে চাষ হবে, অবিশ্বাস্য একটা কাণ্ড, শীতকালে চাষ হয়, এটা মানুষের ধারণার মধ্যেও নেই। তাদের ধারণা ছিল, শীতকালে যদি চাষের বিষয় থাকতো, তাহলে আল্লাহ শীতকালে বৃষ্টি দিতেন। যেহেতু আল্লাহ শীতকালে বৃষ্টি দেননি, তাহলে শীতকালে ফসল চাষের বিষয় নেই, আপনি জোর করে আল্লাহর হুকুম উলটে দিয়েন না।
ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির আগে তেভাগা খামার তৈরির ইতিহাস স্মরণ করে তিনি বলেন, আমি বলতে থাকলাম, ডিপটিউবওয়েলের ব্যবস্থাও করা হলো, ফসলও হলো। পরের বছর ছড়া থেকে পানি নিয়ে চাষ করবে বলল। ছড়ায় বাঁধ দেওয়া হলো। বাঁধে যে পানি আসল, সেটা ডিপটিউবওয়েল থেকে অনেক বেশি পানি। নতুন একটা শিক্ষা হলো। বুঝলাম, ইচ্ছা না থাকলে, গরজ না থাকলে সবকিছু থাকা স্বত্ত্বেও অভাব থেকে যায়। পানি আছে, জমি আছে, চাষ করা যায়, কিন্তু কেউ করেনি কোনোদিন, আমরা কেন করব? একটা শিক্ষা লাভ হলো। এর ফলে জন্মলাভ করল তেভাগা খামার, সেটা দিয়ে যাত্রা শুরু। তেভাগা খামারে চাষ করতে গিয়ে আবার সমস্যা হলো। ইরি ধান চাষ করতে গেলে লাইন ধরে রোপা লাগাতে হয়, এমনিতে তো ধান ছিটিয়ে দিলে ফসল হয়ে যায়। কিন্তু ইরিতে কষ্ট করতে হয়। তো, আমি বললাম খাবেন যখন কষ্ট তো করতে হবে। বলে- না, বেশি কষ্ট। তখন আমি ছাত্রদের সঙ্গে বসলাম। তারা দলে দলে মাঠে নামল, লাইন ধরে ইরি ধানের রোপা লাগালো। পরে অন্যান্য গ্রামেও নজর পড়ল।
আমি এসেছিলাম এখানে শিক্ষক হিসেবে, কিন্তু ক্রমে যত দিন গেল, দেখলাম আমি ছাত্র হয়ে গেছি। তখন আমি ক্রমাগত শিখছি। ক্রমে ক্রমে জোবরার নারীরা আমার শিক্ষক হয়ে গেল। তাদের কাছ থেকে অনেককিছু শিখলাম। আমার ছাত্রছাত্রীরা অনেকে আমার সঙ্গে ছিল। অবাক হয়ে গেলাম, যা ক্লাসরুমে পড়াই তার সঙ্গে কিছুই মিল নেই।
এরপর নারীদের ঋণদানের কাহিনী তুলে ধরে ড. ইউনূস বলেন, এরপর যে কাজ শুরু করলাম, সেটা নারীদের খুব পছন্দ হলো। নারীদের হাতে ঋণ দিলাম, ৫ টাকা, ১০ টাকা, ২০ টাকা। ৫ টাকা, ১০টাকায় মানুষ যে এত খুশি হতে পারে জানা ছিল না, কোনোদিন ভাবিওনি। আমি যে মাগনা টাকা দিয়েছি তা না, তাদের বললাম- কাজ করে রোজগার করে টাকা ফেরত দিতে হবে। তাতেই তারা খুশি। অনেক কাহিনী শুনলাম। তাদের অনেকে তাদের নিজের নাম পর্যন্ত বলতে পারে না। আমাদের সমাজ এমন, তাদের নাম জানারও সুযোগ করে দেয় না। ছোটবেলায় অমুকের মেয়ে, বিয়ে হলে অমুকের বউ, মা হলে অমুকের মা, সে যে কে সে নিজেও জানে না। আমরা প্রথম চেষ্টা করলাম, আমাদের ছাত্রীদের দিয়ে কোনোভাবে তার নামটা বের করার জন্য, হয়তো কোনো একসময় তার নাম একটা ছিল অথবা মনে না পড়লে একটা নতুন নাম দেওয়া যাতে করে সেটা সে লিখতে পারে। এভাবে লেখা শেখানো। এ লেখা শেখাতে গিয়ে তার জীবনের অনেক কাহিনি আসলো। প্রতি কাহিনি একটার চাইতে একটা চমৎকার।
এর থেকে আমি একটা সিদ্ধান্তে আসলাম, সভা-সমিতিতে বললাম, লেখালেখিতে বললাম- ঋণ মানুষের মানবিক অধিকার। মানুষ হাসাহাসি করল। আপনি ঋণের কথা বলেন, অধিকারের কথাও বলেন- এটা কী ধরনের কথা! অর্থনীতিতে তো অধিকারের বিষয় নেই। অনেক খটকা, তা-ও আবার মানবিক অধিকার, একটা খটকার পর আরেকটা খটকা। তারপর বললাম, আমরা দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠাবো। বলে- আপনি কে জাদুঘরে পাঠাবেন। আমি বললাম- আমি আপনার মতোই একজন মানুষ। তখন বলল- এটা আপনার কাজ না, এটা সরকারের কাজ। আমি বললাম- আমি আমার কাজ করি, সরকার আমাকে বাধা দিলে দেখা যাবে।
ব্যবসাকেন্দ্রিক নয়, অর্থনীতি হবে মানুষের জন্য–এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, এর মধ্য দিয়ে জোবরার নারীদের কাছ থেকে নতুন অর্থনীতি শিখলাম। জোবরা গ্রাম আমার জন্য নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে দাঁড়িয়ে গেল। আজ পর্যন্ত যা করে যাচ্ছি, তা জোবরা থেকে যা শিখেছি তার বহিঃপ্রকাশ। আজ অর্থনীতি যা পড়াচ্ছি, সেটা ব্যবসার অর্থনীতি, মানুষের অর্থনীতি না। আমাদের মানুষের অর্থনীতি গড়তে হবে। আমাদের অর্থনীতি যদি শুরু করতে হয়, মানুষকে দিয়ে শুরু করতে হবে, ব্যবসাকে দিয়ে নয়। অথচ আমরা ব্যবসাকেন্দ্রিক সভ্যতা গড়ে তুললাম, এটা আত্মঘাতী সভ্যতা, এটা টিকবে না।
ওই যে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি লেখাপড়া শুরু করলাম, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ই আমাকে বলল- এ বিদ্যায় পৃথিবী ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে, এর থেকে রেহাই পাওয়ার কোনো উপায় নেই। তখন আরও বড় আকারের জিনিসের মধ্যে ঢুকলাম। বললাম আমাদের নতুন সভ্যতা গড়তে হবে। আমার সহকর্মী যারা আছেন, অর্থনীতির পাঠদান করেন, লেখালেখি করেন তারা তো আগেই আমাকে ত্যাজ্য করেছেন, তারা এটা নিয়ে কথা বললে একেবারেই শেষ করে দেবেন কথাবার্তা।
তিনি বলেন, কিন্তু আমার মাথায় সেটা রয়ে গেল যে আমাদের আবার নতুন সূত্রে যাত্রা শুরু করতে হবে, যে অর্থনীতির ভিত্তি হবে মানুষ, তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, কীভাবে নিজেকে আবিষ্কার করার প্রবণতা এবং যেদিকে তাকে ছুটিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেখান থেকে বের করে আনা। এগুলো সবকিছুর বীজ বপন হয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে, পাশের নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে (জোবরা)। এজন্য আমি চবি ও জোবরার কাছে কৃতজ্ঞ। এটা করে যে কোনোদিন একটা নোবেল পুরস্কার পাওয়া যাবে, কখনও মনে আসেনি। তবে লোকজন বলাবলি করেছিল মাঝে মাঝে।
সমাবর্তীদের উদ্দেশে ড. ইউনূস বলেন, সমাবর্তন একজন মানুষের জীবনে একটি মস্তবড় ঘটনা। সনদ নেবে, ছবিটি সংরক্ষণ করবে, সেটা সবাইকে দেখায়, সেই বিশেষ দিনটি আজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়টা কত তাড়াতাড়ি চলে যায়, কেটে যায় বোঝা যায় না। যখন শেষ হয়ে যায়, তখন মনে বড় কষ্ট লাগে। জীবনের একটা বড় অধ্যায় শেষ হলো, নতুন অধ্যায়ের শুরু।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. ইয়াহ্ইয়া আখতারের সভাপতিত্বে এতে শিক্ষা উপদেষ্টা সি. আর আবরার ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান এস এম ফয়েজ বক্তব্য দেন।
বিই/টিসি/জেএইচ