সম্প্রতি ঢাকায় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) যৌথ উদ্যোগে ‘আনলকিং বাংলাদেশ বন্ড অ্যান্ড সুকুক মার্কেট; ফিসক্যাল স্পেস, ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেলিভারি এবং ইসলামিক মানি মার্কেট ডেভেলপমেন্ট’ শীর্ষক একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেমিনারে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির সমন্বয়ে গঠিত একটি টাস্কফোর্স দেশের আর্থিক খাতে সেকেন্ডারি বন্ড মার্কেট স্থাপনের জন্য কাজ করে যাচ্ছে এবং এরই মধ্যে কিছু সুনির্দিষ্ট সুপারিশ সরকারের কাছে পেশ করেছে।
এই শতকের শুরুর দিকে দেশে সেকেন্ডারি বন্ড মার্কেট স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল এবং প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গিয়েছিল। দেশে বন্ড মার্কেট স্থাপনে সহযোগিতা করার জন্য বিদেশি পরামর্শক নিয়োগের উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক টেন্ডার পর্যন্ত আহবান করা হয়েছিল, যেখানে কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আগ্রহ দেখিয়ে প্রস্তাব জমা দিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের আর্থিক খাতে বন্ড মার্কেট স্থাপনের বিষয়টি আলোচনার মধ্যেই রয়ে গেছে।
দেশে কার্যকর এবং টেকসই আর্থিক খাত গড়ে তুলতে হলে একটি স্বতন্ত্র সেকেন্ডারি বন্ড মার্কেটের কোনো বিকল্প নেই।
একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে এগিয়ে নিতে হলে যে মাত্রার সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ প্রয়োজন, তার জোগান শুধু ব্যাংকঋণ এবং পুঁজিবাজার থেকে আসতে পারে না। কার্যকর বন্ড মার্কেট শুধু ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থই রক্ষা করে না, সেই সঙ্গে পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতাও রক্ষা করে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা এবং সেই সঙ্গে পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার সুবিধার্থে পোর্টফোলিও বিনিয়োগ সুযোগ চালু করা হয়, যেখানে থাকে কম ঝুঁকির পোর্টফোলিও, মধ্যম ঝুঁকির পোর্টফোলিও এবং অত্যাধিক ঝুঁকির পোর্টফোলিও। যেসব বিনিয়োগকারীর পর্যাপ্ত বিনিয়োগযোগ্য অর্থ আছে এবং যাঁরা উচ্চমাত্রার ঝুঁকি নিতে সক্ষম, তাঁরা হয় নিজেরা বিনিয়োগ করবেন, অথবা উচ্চঝুঁকির পোর্টফোলিওতে বিনিয়োগ করবেন।
পক্ষান্তরে যাঁরা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী এবং যাঁরা একেবারেই ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত নন, তাঁরাই কম ঝুঁকির পোর্টফোলিওতে বিনিয়োগ করবেন। এ ধরনের ঝুঁকিভিত্তিক পোর্টফোলিও বিনিয়োগ তখনই গড়ে তোলা সম্ভব, যখন দেশে একটি কার্যকর সেকেন্ডারি বন্ড মার্কেট চালু থাকবে।
আমাদের দেশে বন্ড মার্কেটের ভালো সম্ভাবনা আছে। সরকার প্রতিবছরই ঘাটতি বাজেট গ্রহণ করে। বলা চলে, উন্নয়ন বাজেটের পুরোটাই ঘাটতি।
তা ছাড়া দেশে প্রতিনিয়তই উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে। এসব ঘাটতি বাজেট এবং উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বিশাল অঙ্কের অর্থ সংগ্রহ করতে হয়। সরকার এখন পর্যন্ত ব্যাংকঋণ ও সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে এই বিশাল অঙ্কের অর্থ সংগ্রহ করে থাকে, যা একদিকে সরকারের সুদ প্রদান বাবদ ব্যয় বাড়িয়ে দেয়, অন্যদিকে বেসরকারি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত করে। বন্ড মার্কেট চালু থাকলে সরকার এবং বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান ব্যাংকঋণ বা সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত কম সুদে বন্ড ইস্যু করে অর্থ সংগ্রহ করতে পারে। আমাদের দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যাংকঋণের ওপর নির্ভরশীল, যা কোনোভাবেই বাস্তবসম্মত নয়। কেননা বিনিয়োগের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নিতে হয়, যা ব্যাংক আমানত সংগ্রহের মাধ্যমে প্রদান করলে সব সময়ই ঝুঁকির মধ্যে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সেই সেমিনারে যথার্থই বলেছেন যে ব্যাংক কোনো অবস্থায়ই পাঁচ-ছয় বছরের বেশি সময়ের জন্য ঋণ দিতে পারে না। অথচ দেশে কার্যকর বন্ড মার্কেট থাকলে ব্যাংক খুব সহজেই দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিতে পারবে।
বন্ড মার্কেটকে ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগ মাধ্যম মনে করা হলেও এখানে কিছু ভিন্ন ধরনের ঝুঁকি বিদ্যমান। বলার অপেক্ষা রাখে না যে স্টক মার্কেট উচ্চঝুঁকির বিনিয়োগ স্থান, যাকে অনেকেই ফটকা বা স্পেকুলেটিভ ব্যবসা বলে থাকে। পক্ষান্তরে বন্ড মার্কেট ঝুঁকিমুক্ত বা কম ঝুঁকির বিনিয়োগ স্থান। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে বন্ড মার্কেটে বিনিয়োগে ঝুঁকি নেই। স্টক মার্কেটের মতো ঝুঁকি না থাকলেও এখানে ভিন্ন ধরনের বিনিয়োগ ঝুঁকি আছে। এই ঝুঁকির কারণে সাধারণ বা অল্প আয়ের বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। এ কারণেই বন্ড মার্কেটে বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, যাতে সাধারণ ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করা যায়।
প্রথমেই এ, বি ও সি সিরিজের তিন ধরনের বন্ড সেকেন্ডারি মার্কেটে লেনদেনের জন্য চালু করা যেতে পারে। এ সিরিজের বন্ডে অন্তর্ভুক্ত থাকবে সঞ্চয়পত্র এবং সরকার কর্তৃক ইস্যু করা বন্ড। এই ধরনের বন্ড লেনদেনের ক্ষেত্রে শর্ত থাকবে যে কোনো অবস্থায়ই বন্ডের ফেস ভ্যালু এবং অর্জিত সুদের মোট মূল্যের নিচে এই বন্ড ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে না।
যেমন-একটি সরকারি বন্ডের ফেস ভ্যালু এক লাখ টাকা এবং এই বন্ডের ওপর অর্জিত সুদের পরিমাণ যদি হয় ১০ হাজার টাকা, তাহলে এই বন্ড কোনো অবস্থায়ই এক লাখ ১০ হাজার টাকার কম মূল্যে বিক্রি করা যাবে না। বি সিরিজের বন্ডে অন্তর্ভুক্ত থাকবে বিভিন্ন সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান; যেমন-পাবলিক কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, সিটি করপোরেশন প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ইস্যুকৃত বন্ড। এসব বন্ড ফেস ভ্যালুর নিচে বিক্রি করা যাবে না। আর এই বন্ডের ওপর অর্জিত সুদ মার্কেটের ওপর ছেড়ে দেওয়া হবে। যেমন-এই ধরনের একটি বন্ডের ফেস ভ্যালু যদি হয় এক লাখ টাকা এবং অর্জিত সুদের পরিমাণ যদি হয় ১০ হাজার টাকা, তাহলে এই বন্ড এক লাখ টাকার নিচে বিক্রি করা যাবে না এবং অর্জিত ১০ হাজার টাকার সুদ মার্কেট ফোর্সের মাধ্যমে নির্ধারিত। সি সিরিজের বন্ডে অন্তর্ভুক্ত থাকবে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং সুপ্রতিষ্ঠিত বৃহৎ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃক ইস্যুকৃত বন্ড, যা প্রিমিয়াম বা ডিসকাউন্টে অর্থাৎ বন্ডের ফেস ভ্যালুর চেয়ে বেশি বা কম মূল্যে ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে। এগুলো কিছু উদাহরণ মাত্র। দেশের বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি গ্রহণের ক্ষমতা এবং বন্ড মার্কেটে বিনিয়োগযোগ্য অর্থের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে রিস্ক প্যারামিটার নির্ধারণ করতে হবে এবং সে অনুযায়ী ঝুঁকি লাঘবের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
দেশে বন্ড মার্কেট স্থাপনের ক্ষেত্রে আরো কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। প্রথমত, বন্ড মার্কেট স্থাপনে তাড়াহুড়া করার সুযোগ নেই। সব দিক বিবেচনা করে ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে হবে। বিনিয়োগকারী যেভাবে বিনিয়োগ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সচেতন হবেন এবং ঝুঁকি গ্রহণের সক্ষমতা অর্জন করবেন, সে অনুযায়ী বন্ড মার্কেটের ব্যাপ্তি বৃদ্ধি করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, উন্নত বিশ্ব বা অন্য কোনো দেশের সুপ্রতিষ্ঠিত বন্ড মার্কেটের ধারণা হুবহু গ্রহণ করা ঠিক হবে না। কেননা সেসব মার্কেট বেশি পরিপক্ব বা ম্যাচিউরড এবং সেখানকার বিনিয়োগকারী বেশি সচেতন ও অধিক ঝুঁকি গ্রহণে সক্ষম। তাই সেসব মার্কেটের ধারণা হুবহু গ্রহণ করলে খুব বেশি কাজে আসবে না। আমাদের মার্কেটের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নিজেদের মতো করে বন্ড মার্কেট গড়ে তুলতে হবে। এ রকম আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে; যেমন-মার্কেট প্লেয়ার নির্ধারণ পদ্ধতি, সম্পূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভর বন্ড মার্কেট, কমপ্লায়েন্সের মান, যা ব্যাখ্যা করতে গেলে এখানে স্থান সংকুলান হবে না। মোটকথা, আমাদের দেশে সেকেন্ডারি বন্ড মার্কেট খুব বেশি প্রয়োজন, কিন্তু এটিও ঠিক যে এই মার্কেট প্রতিষ্ঠায় তাড়াহুড়ার সুযোগ নেই, বরং এই মার্কেট প্রতিষ্ঠায় সর্বোচ্চ সতর্কতা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
লেখক: সার্টিফায়েড অ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা
এসআই