ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১০ ঘণ্টা, জুলাই ২, ২০২১
সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম মাওনালা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

টাঙ্গাইল: টাঙ্গাইলের মাওনালা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত ও ভাইস-চ্যান্সেলর এবং পাঁচজন শিক্ষককে অবরুদ্ধ করে রাখার অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের কয়েকজন শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে।  

এছাড়া পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসলাইন বিচ্ছিন্ন করারও হুমকি দেয় ওই সিন্ডিকেটের সদস্যরা।

এ নিয়ে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে চলছে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়।

আর সিন্ডিকেটের মূল হোতা হচ্ছেন ক্রিমিনোলজি আন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক এবং ইনফরমেশন আন্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ শাহীন উদ্দিন।

বর্তমান ভাইস-চ্যান্সেলর (ভিসি) প্রফেসর ড. মো. আলাউদ্দিনের মেয়াদ শেষ হবে চলতি বছরের ২৮ জুলাই। আর এই সুযোগে পরবর্তী ভিসি আসার আগেই নিজেদের ক্ষমতা দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছেন সিন্ডিকেটের সদস্যরা। গত ৯ জুন অবরুদ্ধ অবস্থায় এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. শামীম আল মামুন তার নিজ ফেসবুক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির ফেসবুক পেজে স্ট্যাটাস দিয়ে এর জন্য প্রফেসর ড. শাহীন উদ্দিন, প্রফেসর ড. মাহবুবুল হক এবং ডেপুটি রেজিস্ট্রার মফিজুল ইসলাম ওরফে মজনুকে দায়ী করেন।
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সমিতির কোনো কমিটি না থাকলেও প্রফেসর ড. শাহীন উদ্দিন নিজেকে শিক্ষক সমিতির সভাপতি পরিচয় দিয়ে বঙ্গবন্ধু পরিষদ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি প্রফেসর ড. মো. সিরাজুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর ড. মো. খাদেমুল ইসলাম এবং কার্যনির্বাহী সদস্য প্রফেসর ড. পিনাকী দের নামে বিভিন্ন অপপ্রচার চালাচ্ছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।  

শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর ড. মাসুদার রহমান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় এক বছর ধরে কার্যত কোনো শিক্ষক সমিতি নেই এবং শাহীন উদ্দিন এখন সভাপতিও নন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস-চ্যান্সেলরের পদ শূন্য হওয়া, খালি থাকা ট্রেজারারের পদ দখল এবং সম্প্রতি নিযুক্ত উপ-উপাচার্যকে নিজেদের কব্জায় রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছে বিএনপি-জামায়াতপন্থী এসব শিক্ষক।

২০১৬ সালের নির্বাচনে উমর ফারুক বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি ব্যবহার করে ভাইয়ের পক্ষে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনী প্রচারণা চালান। পরে মতিয়া চৌধুরী (সাবেক কৃষিমন্ত্রী) ও জেলা প্রশাসককে বিষয়টি মৌখিকভাবে জানালে জেলা প্রশাসকের হস্তক্ষেপে উমর ফারুক নির্বাচনী এলাকা ত্যাগ করেন।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, মুহাম্মদ উমর ফারুক ভারতে হরিয়ানার ও পি জিনদাল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নেওয়ার জন্য ছুটি গ্রহণ করলেও বেশিরভাগ সময়ই তিনি বাংলাদেশে অবস্থান করতেন। শিক্ষা ছুটি নেওয়া অবস্থায় ২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সেমিনার কক্ষে ডাটা সংগ্রহের কর্মশালা করেন যা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম পরিপন্থী।  

এছাড়া শিক্ষা ছুটিতে থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা, সরকারি-বেসরকারি অর্থায়নে বিভিন্ন প্রকল্প পরিচালনা করতেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো শিক্ষকের সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপকে আপগ্রেডেশনের জন্য ২ বছরের রেয়াতি সুবিধার জন্য সর্বনিম্ন ৬টি পাবলিকেশন প্রয়োজন এবং কোনোভাবেই অ্যাকসেপটেন্স লেটার গ্রহণযোগ্য নয়। অথচ মুহাম্মদ উমর ফারুকের সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপকের আপগ্রেডেশনের ব্যাপারে জানা যায়, তিনি ৩টি পাবলিকেশন ও ৫টি অ্যাকসেপটেন্স লেটার জমা দিয়ে তার পদোন্নতি নিয়ে নেন।

২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রক্টর থাকাকালীন ক্ষমতার দাপটে নিয়োগ বাণিজ্য, শিক্ষার্থীদের সাময়িক বহিষ্কারসহ নানা অভিযোগ রয়েছে উমর ফারুকের বিরুদ্ধে। তিনি তার নিজ বিভাগের সিনিয়র শিক্ষক মো. আজিজুর রহমানের সহযোগী অধ্যাপক পদের আবেদন (যা তিনি বিদেশে শিক্ষা ছুটি থাকাকালীন অবস্থায় করেছিলেন) দু'বার গায়েব করেন নিজে আজিজুর রহমান থেকে সিনিয়র হবার জন্য। এছাড়া তৎকালীন ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মো. নুরুল ইসলামকে বাধ্য করে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ নাম দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদন ছাড়াই বিভাগ খুলে অনুষদের ডিন হন। এমন কি উমর ফারুক তার ভাগ্নী মাহমুদা বিনতে লতিফকে প্রভাব খাটিয়ে এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দিতে তৎকালীন ভাইস-চ্যান্সেলরকে বাধ্য করেন।  

মাহমুদা বিনতে লতিফ মানবিক বিভাগ নিয়ে এসএসসি এবং এইচএসসি পাস করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন, যা মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এম পি কিউ এর পরিপন্থী।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এম পি কিউ অনুযায়ী শিক্ষা জীবনের সব পর্যায়ে বিজ্ঞান বিভাগে পাস থাকা আবশ্যকীয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন এক শিক্ষার্থী জানান, উমর ফারুক প্রক্টর থাকাকালীন শিক্ষার্থীদের প্রায়ই সাময়িক বহিষ্কার করতেন। তার এসব অপকর্মের বিরোধিতা করায় ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের একজন শিক্ষার্থীর নামে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে শাস্তি দেওয়া হয়। পরে আইন করেন, শাস্তিপ্রাপ্ত ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আবেদন করতে পারবে না। ওই শিক্ষার্থী যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক না হতে পারে সে জন্য উমর ফারুক এবং সিন্ডিকেটের সদস্যরা অপততপরতা চালায়। ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের প্রথম ব্যাচের সেই ছাত্র এখন জন প্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা।

ক্যাম্পাসের কয়েকজন কর্মকর্তা জানায়, শাহীন উদ্দিন নিয়ম বহির্ভূতভাবে সহযোগী অধ্যাপক পদে আপগ্রেডেশন পাবার পর ওই পদে যোগদানের পর পরই বিদেশে গমন করেন ও শিক্ষা ছুটিতে অবস্থান করেন। যা নিয়ম অনুযায়ী তার আগের শিক্ষা ছুটির পূর্ন সময়কাল সক্রিয়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিতে থাকার পর পুনরায় শিক্ষাছুটি প্রাপ্য হন।  

এছাড়া তার স্ত্রী একই বিভাগের শিক্ষক মোসা. নার্গিস আক্তার এডহক ভিত্তিতে নিযুক্ত থাকা অবস্থায় বিদেশে অবস্থান করেন এবং তৎকালীন ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. নুরুল ইসলামের সহযোগিতায় নিয়ম বহির্ভূতভাবে নার্গিস আক্তার দেশে এসে স্থায়ী পদে যোগদান করেন।
শাহীন উদ্দিনের ঘনিষ্ট সহযোগী মফিজুল ইসলাম মজনু ছিলেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের কর্মী এবং টাঙ্গাইল শাখা ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি উজ্জ্বলের ভাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন বিভাগ খোলা, প্রয়োজনীয় জনবল সৃষ্টিসহ শিক্ষা ও ভৌত অবকাঠামোর ব্যাপ্তির জন্য অর্গানোগ্রাম অত্যাবশ্যক। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়কে দ্রুত অর্গানোগ্রাম জমা দেওয়ার তাগিদ দিলেও কমিটির সদস্য শাহীন উদ্দিন নানা টালবাহানায় সংশোধন, পুনঃসংশোধনের কারণ দেখিয়ে কয়েক বছর ধরে এটি যেন পাস না হয় এ ব্যবস্থা করছেন। ফলে অদ্যবধি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন চাহিদামত অর্গানোগ্রাম জমা দেওয়া সম্ভব হয়নি।

ওমর ফারুক ভারতে হরিয়ানার ও পি জিনদাল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নেওয়ার জন্য ছুটির বিষয়ে জানান, বিশেষ করে তাকে ভারতেই থাকতে হবে। কিন্তু তার ফিল্ড ছিল বাংলাদেশে তাই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কর্মশালায় অংশ নিয়েছেন। আর অ্যাকসেপটেন্স লেটারের বিষয় নেই। আর অ্যাকসেপটেন্স লেটার গ্রহণযোগ্য। কিন্তু তিন মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কপি জমা দিতে হয়। সেটি সময় মতোই জমা দেওয়া হয়েছিল।

এ বিষয়ে মুহাম্মদ শাহীন উদ্দিন বলেন, আমি আবেদন করেই শিক্ষা ছুটি নিয়েছিলাম। স্ত্রী সম্পর্কে বলেন, এডহক ভিত্তিতে চাকরি থাকাকালে দেশের বাইরে যাননি তিনি। তখন তিনি স্থায়ীই ছিলেন। এছাড়া আমি কোনো শিক্ষককে আটকে রাখিনি।

বাংলাদেশ সময়: ২১০৬ ঘণ্টা, জুলাই ০২, ২০২১
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

শিক্ষা এর সর্বশেষ