ঢাকা: প্রতিটি দেশেরই রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি ও আচার-অনুষ্ঠান। ধর্মীয় ও সামাজিক বিশ্বাস, আচার-আচরণ, জীবন প্রণালী ও দৈনন্দিন চিত্তবিনোদনের সহজাত মাধ্যম ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা স্থানভিত্তিক অনুষ্ঠানকে লোকজ আচার-অনুষ্ঠান বলা হয়।
তবে সময়ের পালাবদল ও নগরায়নের ফলে চিরাচরিত বাঙালি ঘরণায় পালিত লোকজ আচার-অনুষ্ঠানগুলো বলতে গেলে প্রাণ হারিয়ে ফেলেছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে বিলুপ্তির পথে।
বলা হয়ে থাকে, বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। কারণ, এসব আচার-অনুষ্ঠানগুলো প্রধানত চন্দ্রতিথি, মাস, পেশা ও ঋতুভিত্তিক। এছাড়াও এসব আচার-অনুষ্ঠানের পেছনে রয়েছে ধর্মীয় বিশ্বাস, মঙ্গল কামনা, সাধুবাদ, ব্যাধি, ক্ষয়-ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রত্যাশা। শৌখিন জাতি হিসেবে বাঙালি যেসব উৎসব হরহামেশাই পালন করতো, বিংশ শতাব্দীতে তা আজ অনেকেরই অজানা। বাংলা নববর্ষে সেসব আচার-অনুষ্ঠানগুলো একবার ঘুরে আসা যাক।
নবান্ন
অগ্রহায়ণ মাসে নবান্ন উৎসবে নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধানের চাল থেকে তৈরি করা হয় পিঠা, পায়েস, ক্ষীরসহ হরেক রকমের খাবার। বাড়ির আঙিনা মেতে ওঠে নতুন ধানের গন্ধে। পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়স্বজনদের দেওয়া হয় এসব মজার পিঠেপুলি।
সনাতন রীতি অনুযায়ী, নবান্ন উৎসবে নতুন অন্ন পিতৃপুরুষ ও দেবতার প্রতি উৎসর্গের পাশাপাশি, কাক ও অন্যান্য প্রাণীর উদ্দেশ্যেও উৎসর্গ করার নিয়ম রয়েছে। লোকবিশ্বাস রয়েছে, কাকের মাধ্যমে ওই খাদ্য মৃতের আত্মার কাছে পৌঁছে যায়। এ নৈবেদ্যকে বলে ‘কাকবলী’।
নবান্ন উৎসবের সবচেয়ে আকর্ষণীয় আয়োজন হলো মেলা। এ মেলায় পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরনের পিঠা, মিষ্টি, সন্দেশ, মন্ডা-মিঠাই, পুতুল, মাটির জিনিসপত্র। এছাড়াও বসে বাউল গানের আসর।
পৌষ সংক্রান্তি
নবান্ন দিয়ে শুরু হয় শীতের আমেজ। আর পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি হলো, বাংলা পৌষ মাসের শেষের দিন। এ দিনে বাড়ির বাড়ির মেয়েরা সারাদিন ব্যস্ত থাকেন নানান রকমের পিঠা পায়েস তৈরিতে। সেসময় বাড়ির শিশু-কিশোররা ঘুড়ি উৎসবে মেতে উঠতো।
প্রাচীন কাল থেকেই দেবতার পূজায় পিঠার অর্ঘ্য দেওয়ার রীতি রয়েছে। মধ্যযুগে ধর্মপূজায় পিঠে নৈবেদ্য দেওয়া হতো। এ দিনটি হিন্দু পঞ্জিকায় ‘উত্তরায়ণ সংক্রান্তি’ নামেও পরিচিত। আগে হিন্দুরা এ দিনটিতে পিতৃপুরুষ অথবা গৃহদেবতার উদ্দেশ্যে তিল কিংবা খেজুড় গুড় দিয়ে তৈরি তিলুয়া এবং নতুন চাল থেকে তৈরি পিঠের অর্ঘ্য দিতেন। এ কারণে পৌষ সংক্রান্তির অপর নাম তিলুয়া সংক্রান্তি।
পুঁথিপাঠ
বাঙালি বরাবরই বিনোদন প্রিয়। সারাদিন ব্যস্ততা শেষে সূর্য ডোবার পর যখন সবাই ঘরে ফিরতো, তখন কুপি বা হারিকেন জ্বালিয়ে শুরু হতো পুঁথি পড়া। পুঁথি-পাঠককে ঘিরে সবাই জড়ো হতো। বাংলার গ্রাম জেগে থাকতো গল্পে ভরা রাজ্যে। পুঁথি-সাহিত্য আমাদের আদি ঐতিহ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এমন এক সময় ছিল, যখন ঘরে ঘরে পুঁথি রাখা হতো।
পালাগান
প্রাচীন বাংলার বিনোদনের আরেক জনপ্রিয় মাধ্যম ছিল পালাগান। পালাগান হলো কাহিনীমূলক লোকগীতি। ছন্দে ছন্দে রচিত দেবতার কথা বা ধর্মসঙ্গীতও পালা নামে পরিচিত। পালাগান প্রধানত পৌরাণিক ও লৌকিক কাহিনীর চরিত্র নিয়ে রচিত। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পৌরাণিক পালাকীর্তন হচ্ছে: মান, মাথুর, নৌকাবিলাস, কালীয়দমন, নিমাইসন্ন্যাস প্রভৃতি। চন্দ্রাবতী, মহুয়া, মলুয়া, কমলা, দেওয়ান মদিনা, দেওয়ান ভাবনা, রূপবতী ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য লৌকিক উপাখ্যানমূলক পালাগান। পালাগানের কবিকে বলা হয় অধিকারী। পালাগানে একজন মূল গায়েন বা বয়াতি থাকেন। তিনি দোহারদের সহযোগে গান পরিবেশন করেন।
যাত্রা
পালাগানের প্রসঙ্গ থেকে আরও একটি প্রসঙ্গ এসে যায় তা হলো যাত্রা। পালাগান যখন নাটকের আদলে মঞ্চে উপস্থাপিত হয় তখন তাকে বলা হয় যাত্রা। জয়দ্রথবধ পালা, রামযাত্রা, কৃষ্ণযাত্রা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য যাত্রাপালার নাম। এ ধরনের পালা সাধারণত রামায়ণ-মহাভারত থেকে নেওয়া হতো। এগুলোর জনপ্রিয়তাও ছিল ব্যাপক। এছাড়া চৈতন্যযাত্রা, বিদ্যাসুন্দরযাত্রা, চন্ডীযাত্রা, ভাসানযাত্রা এগুলিও বেশ জনপ্রিয়।
গম্ভীরা
এবার আসি লোকসংগীতের প্রসঙ্গে। অঞ্চলভেদে বাংলাদেশে প্রায় অর্ধশত প্রকার লোকসঙ্গীতের প্রচলন রয়েছে। এসব লোকসঙ্গীতের অন্যতম ধারা গম্ভীরা। শিবের অপর এক নাম ‘গম্ভীর’। শিবের বন্দনায় যে গান গাওয়া হতো, সেই গানের নামই সময়ের অববাহিকায় হয় ‘গম্ভীরা’। এতে দেবদেবীকে সম্বোধন করে গানের সুরে বলা হয় গ্রামীণ সমাজের মানুষের সুখ-দুঃখ।
পালা-গম্ভীরায় অভিনয়ের মাধ্যমে বিষয়বস্তু তুলে ধরা হয়। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর বিষয়গুলোও পরিবর্তিত হয়েছে। বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জে গম্ভীরার প্রচলন রয়েছে। চৈত্র সংক্রান্তিতে বছরের সালতামামি উপলক্ষে পালা-গম্ভীরা পরিবেশন করা হয়।
বিয়ের গীত
বরাবরই বাঙালি সংগীতপ্রিয় জাতি। বিভিন্ন অনুষ্ঠান ছাড়াও বিয়েতে বিয়ের গীত গাওয়া হতো। আজও গ্রামে এ প্রচলন রয়েছে।
অতীতে বিয়েতে মেয়েলি আচার-অনুষ্ঠানের একটি প্রধান অঙ্গ ছিল মঙ্গল গান। গ্রামের বিয়েতে বিশেষ করে গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে গান গাওয়া হতো। এখন যদিও বিয়ের গীতের এ ধারাটি কমে এসেছে, তবুও প্রত্যন্ত গ্রামে কোথাও কোথাও এখনও বিয়েতে গীত গাওয়ার প্রচলন রয়েছে। এসব গীত আঞ্চলিক ভাষায় রচিত ও বংশ পরম্পরায় মুখে মুখে প্রচলিত। নারী মনের আবেগ-উৎকণ্ঠা-আনন্দ-বেদনা-হাসি-কান্না-সুখ-আনন্দের প্রকাশ ঘটে বিয়ের গীতে। গানগুলো বিয়ের শুরু থেকে কন্যা সম্প্রদান পর্যন্ত ধাপে ধাপে শেষ হয়।
লোকজ এসব আচার-অনুষ্ঠান পালনে ধর্ম-বর্ণ ভেদ নেই। তবে বেশকিছু আচার-অনুষ্ঠান যেমন- টুসু, ভাদু, করম, বসুধারা প্রভৃতি ব্রত শুধু সনাতন ধর্মের নারীরাই পালন করে থাকেন।
বাংলাদেশ সময়: ০২৩৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৪, ২০১৫
এসএস
** লোকজ আচার-অনুষ্ঠানের সাতকাহন-১