ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

লাল-সাদা শিফটে বাঁধা নৌকায় জীবিকা

সজিব তৌহিদ, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৫২ ঘণ্টা, নভেম্বর ৭, ২০১৫
লাল-সাদা শিফটে বাঁধা নৌকায় জীবিকা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: কোনও এক কাক ডাকা ভোরে মোহাম্মদপুর থেকে মহাখালীর ওয়্যারলেস পার হয়ে গুলশান পৌঁছার আগেই রাস্তার ভ্রাম্যমাণ পুলিশ চেকপোস্টে নেমে গেলাম। হাতের বায়ে বিশাল এক জলাশয়।

ওপারে চোখে পড়লো অসংখ্য টিনের বাড়ি। ওটা কড়াইল বস্তি। ততক্ষণে জমে উঠেছে ডিঙি নৌকার আসা-যাওয়া।

রাজধানীর ভেতরে নৌকায় চলাচল বিস্ময় জাগাবে। তবে এপারে অভিজাত গুলশান এলাকার কিছু অংশ, ওপারে বনানীর একাংশে ‘কড়াইল’ বস্তিবাসীর মাঝে সেতুবন্ধনের এই নৌকা আর নৌকায় মিশে থাকা সংগ্রামী জীবন-জীবিকা মিলিয়ে দেখলে অনেক ব্যত্যয়ই ধরা পড়বে।

এপারে গুলশানের আগে রাস্তার পুলিশ চেকপোস্ট, ওপারে বৌবাজার নৌঘাট। আসা-যাওয়ার একমাত্র বাহন এই নৌকা। একেকটির দৈর্ঘ্য ১৫ থেকে ১৭ ফুট এবং প্রস্থ সাড়ে তিন থেকে চার ফুট। এসব নৌকায় ধারণ ক্ষমতা সর্বোচ্চ ১২ জন।   প্রতি পারাপারে ভাড়া দুই টাকা। এপার থেকে ওপারে যেতে সময় লাগে তিন মিনিট।

ভোর থেকে মধ্যরাত অবধি চলে মানুষের পারাপার। ঘাট দিয়ে শিক্ষার্থী, পোশাক কারখানার শ্রমিক, দিনমজুর, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশার প্রায় হাজার দশেক মানুষের নিত্যদিনের  চলাচল।

জলাশয়ের পানি গোসলের জন্য উৎকৃষ্ট নয় বটে, তবে বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যার মতো নিকৃষ্ট নয়। গ্রীষ্ম ও শীতকালে নোংরা-পচা উৎকট গন্ধ বিরক্তির উদ্রেক হলেও বর্ষাকালে অতটা অস্বস্তি হয় না।

তখন জলাশয়ের পরিধি বাড়ে। আর কেউ কেউ এখানে এসে নৌকায় ঘোরাঘুরিও আগ্রহ দেখান। তখন দর্শনার্থীরা দর-দাম করে ঘণ্টা প্রতি ২শ’ টাকা দিয়ে নৌকা ভ্রমণের খায়েশও মেটাতে পারেন।

কথা হলো নৌকার মাঝি মন্টু মিয়ার (৪২) সঙ্গে। তার বাড়ি বরিশাল। তার বড় ছেলে এসএসসি পরীক্ষার্থী, ছোট মেয়েটি পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে।

মন্টু মিয়া জানালেন আগে ব্যবসা করতেন। সুবিধা না করতে পেরে কড়াইল বস্তির এই নৌকা ঘাটের মাঝি হয়েছেন তাও চার বছর হয়ে গেছে।  

সারাবেলা কাজ করে চার থেকে পাঁচশ' টাকা আয় হয়, আর আধা বেলা কাজ করে হয় দুই থেকে আড়াইশ' টাকা। তবে পুরো বেলা নৌকা চালানোর সুযোগ মেলে একদিন পর পর।
 
এতে তার অর্থনৈতিক অবস্থা তুলনামূলক ভালোই হয়েছে। তবে অভাব কাটেনি।

খরচ কমাতেই স্ত্রী-সন্তানকে বাড়িতে রেখে নিজে ব্যাচেলরের জীবন কাটান কড়াইল বস্তিতেই।

ঘাটকে ঘিরে গড়ে উঠেছে অন্য ব্যবসারও সুযোগ। ওপারে বউবাজার ঘাটে তাই চোখে পড়লো কয়েকটি টঙ দোকান।

ঘাটের মাঝি লিটন, ফারুক, শায়ন, লিয়াকত ছাড়াও কথা হয় ওইসব দোকানিদের সঙ্গেও। গল্পে গল্পে আরও অনেক কথাই জানা যায়।

এই ঘাটে ৯০টি নৌকা চলে। যা লাল ও সাদা শিফটে বিভক্ত। একদিন লাল শিফটের নৌকা চললে পরের দিন চলে সাদা শিফটের নৌকা। অর্থাৎ প্রতিদিন ঘাটে ৪৫টি নৌকা সচল থাকে। মাঝি আছে প্রায় ১৩০ জন। দুই শিফটে নিয়মিত ৯০ জন কাজের সুযোগ পান, বাকিরা অনিয়মিত নৌকা চালান। মাঝিদের সাধ-আহ্লাদ, সুখ-দুঃখ, বিরহ-বেদনা, আশা-ভালোবাসা, আর চিত্ত-বিনোদন সবই নির্ভর করে ওই শিফটের ওপর।
 
এখানে বেশির ভাগ মাঝিকেই নৌকা ভাড়া নিয়ে চালাতে হয়। নৌকার মালিক নৌকা চালান এমন সংখ্যা খুবই কম। মাঝিদের পুরো বেলার জন্য নৌকার মালিককে ভাড়া দিতে হয় ১৪০ টাকা এবং সঙ্গে ঘাট নিয়ন্ত্রণকারীদের দিতে ২০ টাকা চাঁদা। আর আধা বেলা অর্থাৎ ফজর থেকে জোহর আজান পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয় ১০ টাকা এবং নৌকা ভাড়া গুণতে হয় ৭০ টাকা।

এই ঘাটের শতাধিক মাঝি, ঘাট পাড়ের দোকানদার, নৌকার মালিক অধিকাংশেরই বাড়িই বরিশালে। তবে ময়মনসিংহ, জামালপুর, গোপালগঞ্জ ও কুমিল্লারও রয়েছেন কয়েকজন ।

মাঝিদের একজন আশরাফ আলীর (৩৮) বাড়ি কুমিল্লায়। এক যুগ ধরে তিনি এই ঘাটের মাঝি। স্ত্রী ও এক সন্তান নিয়ে কড়াইল বস্তিতেই বাস আশরাফের। অভাব থাকলেও নেই কোনো অভিযোগ। এভাবেই দিন পার করতে চান তিনি।
 
রাজধানীর এই বৌবাজার নৌঘাটের যাবতীয় বিষয় দেখভাল করেন ৬০ বছর বয়সী এক ব্যক্তি। স্থানীয় সবাই তাকে ‘মুরুব্বি’ বলে ডাকেন। নাম কালাম ফকির। তিনিও বরিশালের বাসিন্দা। প্রায় দুই দশক আগে ১৯৯৬ সালে কড়াইল বস্তির জলাশয়ের কচুরিপানা পরিষ্কার করে এই ঘাট তার নেতৃত্বেই চালু হয়।

এই ঘাটকে কেন্দ্র করে শত-শত মানুষের জীবিকা তৈরি হয়। দু’বেলা দু’মুঠো ভাত খেয়ে শ্রমজীবী মানুষের স্বপ্ন তৈরি হয়। তাই এই ঘাটের মাঝি, দোকানি ও স্থানীয়রা কালাম ফকিরকে শ্রদ্ধার সঙ্গে মান্য করেন।

এ বিষয়ে কালাম ফকির বলেন, ‘জীবনে আর কি আছে মনু। হগলেই মোরে মানে, শনমান (সম্মান) করে। ’

ঘাটটির সঙ্গে লাগা ছোট্ট একটি টিনশেড মসজিদ আছে। শতাধিক মাঝি, দোকানি ও স্থানীয় মুসল্লিদের জন্য কালাম ফকির সরকারের কাছে মসজিদ সংস্কার ও উন্নয়নের জোর দাবি জানান।

এই ঘাটে একদিন ভোর থেকে দুপুর, আর একদিন বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত ঝিম লেগে বসে বসে লাল-সাদা শিফটে বাঁধা মাঝিদের জীবনের কর্ম চাঞ্চল্য দেখা হলো। মনে হলো -এই তো জীবন, নিত্য সচল, সারাক্ষণ পারাপার, তারপরেও নেই কোনও জীবনের আহ্বান।  

বাংলাদেশ সময়: ০০৫৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৭, ২০১৫
টিআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।