ফর্মালিনমুক্ত শাক সবজি, মাছ, মাংসের জন্য কত হাহাকারই না করি আমরা। নগরের বাসিন্দাদের বিষমুক্ত শাক সবজি ও মাছ, মাংসের যোগানে নানা রকম উদ্দ্যোগ নেওয়া হলেও পরবর্তীতে তা আর কার্যকর থাকেনি।
তবে এই নগরেই রয়েছে আদতেই বিষমুক্ত এক ফসলের বাজার। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কয়েকজন শিক্ষার্থী মিলে গড়ে তুলেছেন এই বাজার। ঢাকার লালমাটিয়ায় ‘প্রাকৃতিক কৃষি বিপণন কেন্দ্র’ নামের এই বিষমুক্ত ফসলের বাজারে কী নেই! মাছ, তরিতরকারি, ফলমুল থেকে শুরু করে মধু পর্যন্ত পাওয়া যায় এখানে। এসকল খাদ্য ফসল আসে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে।
আবার এসব কৃষকেরাও এখানকার তরুণ বিক্রেতাদের সার্বক্ষণিক নজরদারিতে থাকেন। কিভাবে তারা ফসল ফলাচ্ছেন, পূর্ণ নজরদারির মধ্য দিয়ে শতভাগ রাসায়নিক সারমুক্ত কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েই কেবল তাদের কাছ থেকে খাদ্যশস্য ক্রয় করা হয়। তারপর এসব রাসায়নিক সারমুক্ত খাদ্য তুলে দেওয়া হয় শহরের সেইসব ক্রেতাদের হাতে, যারা রাসায়নিক সারমুক্ত সবজি ও ফলমুল খেতে চান।
এখানকার ক্রেতাদের একটি বড় অংশ হচ্ছে গর্ভবতী মা ও শিশুরা। ‘প্রাকৃতিক কৃষি বিপণন কেন্দ্রে’র ক্রেতা কারা জানতে চাইলে এর প্রধান উদ্যোক্তা দেলোয়ার জাহান বলেন, “সব শ্রেণির ক্রেতাই আমাদের কাছ থেকে পণ্য কিনতে আসেন। এরমধ্যে গর্ভবতী মা ও শিশুদের জন্য বেশি পণ্য কিনে থাকেন অনেকে। ”
কারণ হিসেবে দেলোয়ার জানান, দেশে প্রতিবন্ধী শিশু জন্মের হার আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এর কারণ হিসেবে চিকিৎসকরা বাজারের রাসায়নিকযুক্ত খাদ্যশস্য ও ফলমুলককে দায়ী করেছেন। দেখা যায়, গর্ভবতী মা ও শিশুদের বিষমুক্ত শাক সবজি ও ফলমুল খেতে নির্দেশনা দিয়ে থাকেন তারা। আর সেই সূত্রেই, সচেতন মা বাবাদের অনেকে কষ্ট করে হলেও এখানে এসে শাক সবজি ও ফলমুল কিনে থাকেন।
দুই দিনে বিক্রি বেশি
সপ্তাহের শুক্র ও শনিবার প্রাকৃতিক কৃষি বিপণন কেন্দ্রে বিক্রিবাট্টা বেশি হয়। এদিন ক্রেতারা আগে থেকে দেওয়া অর্ডার অনুযায়ী পণ্য নিতে চলে আসেন। এমনিতে সপ্তাহের সাতদিনই খোলা থাকে কৃষি বিপণন কেন্দ্র। চাইলে এসময়ও ক্রেতারা রাসায়নিক সারমুক্ত খাদ্যশস্য কিনতে পারেন। সারমুক্ত ও প্রাকৃতিক উপায়ে উৎপাদিত জন্য এসব খাদ্যশস্যের দামও একটু বেশি বলে জানান দেলোয়ার। তিনি বলেন, “কোনো প্রকার রাসায়নিক প্রক্রিয়া ছাড়া এসব সবজি ফলানো হয়, আর তাতে সময় লাগে বেশি, পরিমাণে ফলনও হয় অপেক্ষাকৃত কম। ”
এর বাইরে উত্তরার একটি বাড়ির নিচে সপ্তাহে একদিন মেলে বিষমুক্ত এই বাজারের খাদ্যশস্য। এখন চাহিদার তুলনায় যোগান কিছুটা কম বলে জানালেন দেলোয়ার। “অথচ প্রথম প্রথম বিষমুক্ত এসব খাদ্যশস্য দেখতে ভালো দেখাত না বলে, চকচক করত না বলে কেউ কিনতেই চাইত না। পচে নষ্ট হবার আগে এতিম খানা ও ক্যাথলিক চার্চে দিয়ে আসতে হতো। ”—বলেন তিনি
ক্রেতা কারা
এখান থেকে সাধারণত অভিজাত শ্রেণির ক্রেতারাই শাক সবজি, মাছ ও ফলমুল কিনে থাকেন। তবে সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের সচেতন মায়েরাও আজকাল তাদের অনাগত শিশুর স্বার্থে এখান থেকে খাদ্যশস্য কেনা শুরু করেছেন। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীরের পরিবারের জন্য এখান থেকে বাজার করে নিয়ে যাওয়া হয় বলে জানান দেলোয়ার। তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকের স্ত্রী তার পরিবারের জন্য এখান থেকে নিয়মিত বাজার করেন।
এর বাইরে ডাক্তার, সেনাবাহিনীর অফিসার ও সাংবাদিকদের অনেকেই এখান থেকে নিয়মিত বাজার করেন। এখান থেকে নিয়মিত বাজার করেন ক্যাপ্টেন ফারুক ইফতেখার। তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “প্রতিটি ভোক্তাই চায় রাসায়নিক সারমুক্ত সবজি, মাছ ও ফলমুল কিনতে। কিন্তু দুর্মূল্যের এই বাজারে প্রায়ই তা সম্ভব হয়ে উঠে না। অধিকন্তু ফলে ফরমালিন যেন স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সেখানে শিক্ষিত কিছু ছেলেমেয়ে আমাদের হাতে রাসায়নিক সারমুক্ত সবজি তুলে দিচ্ছে। এ কারণেই আমি নিয়মিত এখান থেকে আমার পরিবারের জন্য বাজার করে থাকি। কোনো কিছু প্রয়োজন হলে আগে থেকে অর্ডার দিয়ে রাখি। নিদির্ষ্ট দিন এসে সেটা নিয়ে যাই। ”
এখন এই বাজারের নিয়মিত ক্রেতা আছেন শ’ দেড়েকের বেশি। তারা এখান থেকে নিয়মিত বাজার করেন। এর বাইরে বিভিন্ন উপায়ে খোঁজ খবর করে হরহামেশাই নতুন নতুন ক্রেতা এসে হাজির হন। প্রাকৃতিক কৃষি বিপণন কেন্দ্রের ফেসবুক গ্রুপে এই কেন্দ্রের নিয়মিত তথ্য আপডেট দেওয়া থাকে। এখান থেকে চাইলে যে কেউ সহজে এই কেন্দ্রের তথ্য জানতে পারেন। [facebook.com/groups/pkrishi2014]
শুরুর গল্প
দেলোয়ার জাহানের বাড়ি কুষ্টিয়ার গোপালপুর গ্রামে। চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগে পড়তে গিয়ে প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষার চিন্তা শুরু করেন। সাংবাদিকতার যোগাযোগের বিষয়টি পুরোটাই ইউরোপ-আমেরিকা কেন্দ্রিক। উপমহাদেশের সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। তাহলে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ কিভাবে যোগাযোগ করে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতা বাড়াবে। তার ওপর কোনো তথ্য-গবেষণা কোথাও নেই। শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেও আশার মুখ দেখতে পেলেন না দেলোয়ার। শেষে দেলোয়ার ও তার বন্ধুরা মিলে একটি দল গঠন করেন।
পাঠচক্র, নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের গ্রামগুলোতে ঘুরে সাধারণ মানুষের জীবনধারা বোঝার চেষ্টা করেন তারা। ২০০৯ সালে পড়াশোনার পাঠ শেষে জীবিকার টানে ঢাকায় আসেন দেলোয়ার। শুরু করেন সাংবাদিকতা। এর বছর কয়েকের মধ্যে তার দলের অন্য সদস্যরাও ঢাকায় চলে এলে চট্টগ্রামে তাদের অসমাপ্ত কাজ শুরু হয় রাজধানীর বুকে। কিন্তু কাগজে কলমে আর কতদিন? সাধারণ মানুষকে বুঝতে হলে যেতে হবে তাদের কাছে। মিশতে হবে একাত্ম হয়ে।
এই ভাবনায় ২০১৩ সালে মানিকগঞ্জের দৌলতপুরের আমতলা গ্রামে শুরু হয় দেলোয়ারদের বিষমুক্ত ফসলের আন্দোলন। নিজেদের তারা পরিচয় দেন প্রাকৃতিক কৃষক হিসেবে। কিন্তু প্রথমেই প্রকৃতির নিষ্ঠুরতার কাছে হার মানতে হয় তাদের। নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়ে হারিয়ে যায় তাদের জমি।
তবু দমে যাননি দেলোয়ার ও তার বন্ধুরা। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে কিছু জমি নিয়ে আবার তারা শুরু করেন বিষমুক্ত ফসলের লড়াই। তাদের দলের এক সদস্য ঢাকার চাকরি ছেড়ে চলে যান ঝিনাইদহে—নিজ এলাকায়। উদ্দেশ্য, এই আন্দোলনে কৃষকদের আরো কাছ থেকে সম্পৃক্ত করা। কিন্তু বিষমুক্ত ফসল ফলনেই তো সমস্যার শেষ নয়। এগুলোর সঠিক বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে না পারলে কৃষকেরা এর সঙ্গে থাকবেন কেন!
আর সেই চিন্তা থেকেই ২০১৪ সালের ২৪ অক্টোবর ঢাকার লালমাটিয়ায় প্রাকৃতিক কৃষি বিপণন কেন্দ্র নামে একটি বিক্রয় কেন্দ্র খুলে বসেন দেলোয়ার। সপ্তাহের দুই দিন (বর্তমানে সাতদিন) বসে রাসায়নিক সারমুক্ত শাক সবজি ও ফসলের হাট।
বর্তমানে দেশের চৌদ্দটি জেলা থেকে বিষমুক্ত ফসল আসে এই প্রাকৃতিক কৃষি বিপণন কেন্দ্রে। ঝিনাইদহ, নওগা, ঢাকা, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি জেলা থেকে এসব খাদ্যশস্য আসে। এরমধ্যে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার পাচবিবিতে ৭ বিঘা জমিতে গড়ে উঠেছে প্রাকৃতিক কৃষি বিপণন কেন্দ্রের নিজস্ব খামার। এখান থেকে নিয়মিত বিষমুক্ত খাদ্যশস্য উৎপাদিত হচ্ছে। মাছ, সবজি ও ফলমুলের পাশাপাশি ভবিষ্যতে এখান থেকে মাংসও প্রক্রিয়াজাত করে আনানো হবে বলে জানান দেলোয়ার।
তাদের এই আন্দোলনে সাড়া দিয়ে দেশের অন্য অনেক স্থানের কৃষকেরাও এগিয়ে এসেছেন। টাঙ্গাইলের ঘাটাইলের কৃষকরা নিজেরাই এই আন্দোলনে সাড়া দিয়ে গড়ে তুলেছেন ঘাটাইল কৃষক সমাজ। এই সমাজের কৃষকেরা হরমোন ফ্রি ফসল উৎপাদন করেন।
প্রাকৃতিক কৃষি বিপণনকেন্দ্রের আগামীর পথচলা নিয়ে দেলোয়ার বলেন, “এ ধরনের উদ্যোগকে বাণ্যিজিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে আমাদের নেই। আমরা চাই প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় প্রাকৃতিক কৃষির প্রতি সর্বসাধারণের অংশগ্রহণ বাড়াতে। আমরা সেই কৃষি চাই, যে কৃষি হবে প্রতিটি প্রাণীর জন্য মঙ্গলজনক। ”
যোগাযোগ : প্রাকৃতিক কৃষি বিপণন কেন্দ্র [রাসায়নিক সার ও বিষমুক্ত ফসল বিক্রয় কেন্দ্র], বিক্রয় কেন্দ্র ৬/৩ লালমাটিয়া, ঢাকা।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০১৫
এএফএ/টিকে