রাজশাহী: প্রকৃতিতে বিদায় ঘণ্টা বেজে গেছে শীত বুড়ির। সময়ের পালাবদলে শীত শেষে দুয়ারে কড়া নাড়ছে ঋতুরাজ বসন্ত।
নানা ফুলের সঙ্গে সৌরভ ছড়াচ্ছে আমের মুকুলও। আমের মুকুলের মিষ্টি ঘ্রাণে কেবলই মৌ মৌ করতে শুরু করেছে চারিদিক। মুকুলের সেই সুমিষ্ট সুবাস আন্দোলিত করে তুলছে মানুষের মন।
বনফুল থেকে মৌমাছির দল গুনগুন করে ভিড়তে শুরু করেছে আম্রমুকুলে। গাছের শাখা-প্রশাখায় স্বর্ণালী ফুলগুলো চারিদিকে যেনো ফাগুনের রূপের ব্যঞ্জনাময় উৎসবের জানান দিচ্ছে।
ঋতু বৈচিত্র্যে আমের শহর রাজশাহীর সবুজ প্রকৃতির আমেজ অনেকটা এমনই আবেগের। বসন্তের ফাগুন আর আমের মুকুল তাই যেন একই সুতোয় গাঁথা। বছরের নির্দিষ্ট এই সময়জুড়ে তাই চাষি তো বটেই চলতে-ফিরতে কমবেশি সব শ্রেণির মানুষেরও দৃষ্টি থাকে চির সবুজ আমগাছের মগডালে।
আমের গাছে সদ্য মুকুল ফোটার এ দৃশ্যে ছেয়ে গেছে রাজশাহীর শহর ও গ্রাম। উত্তরের বিভাগীয় শহর রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, দিনাজপুর, রংপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী জেলার প্রায় সব এলাকাতেই এখন রয়েছে বড় বড় আমবাগান। লাভজনক হওয়ায় প্রতিবছরই আমবাগানের সংখ্যা বাড়ছে। তবে গড়ে ওঠা নতুন আমবাগানগুলোর প্রায়ই বনেদি জাতের। বিশেষ করে নিয়মিত জাত ল্যাংড়া, গোপালভোগ, ক্ষিরসাপাত ও আশ্বিনা জাতেরই গাছ বেশি হচ্ছে।
রাজশাহীর ছোটবনগ্রাম এলাকার আমচাষি শেখ ফরিদ উদ্দিন জানান, এ বছরের আবহাওয়া আমের জন্য অনুকূলে ছিল অনেকটাই। টানা শীত ও কুয়াশার দাপট ছিল গত বছরের চেয়ে কম। গতবারের মতো মওসুমের শুরুতে শিলাবৃষ্টিও হয়নি। এরই মধ্যে অনেক গাছে মুকুল আসতে শুরু করেছে। আশা করা যাচ্ছে ভরা ফাল্গুনে এবার রাজশাহী ও আশপাশের জেলার আম গাছে পর্যাপ্ত মুকুল আসবে।
তবে মাঝে-মধ্যেই আকাশে মেঘ জমে উঠছে। এই মুহূর্তে শিলাবৃষ্টি হলে আমের মুকুলের ব্যাপক ক্ষতি হবে। এর উপর সামনে ঝড়-ঝঞ্ঝার সময়ও আসছে। তাই আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে যথেষ্ট শঙ্কাও কাজ করছে। তবে পরিস্থিতি অনূকূলে থাকলে এবারও বাম্পার ফলন হবে বলেও জানান তিনি।
অপর আমচাষি আবদুল মতিন জানান, আমের জন্য এখন আর অফ ইয়ার বা অন ইয়ার নেই। বছরজুড়ে গাছের পরিচর্যায় এখন প্রতিবছরই আমের ভালো ফলন পাওয়া যাচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের পরামর্শে গাছে মুকুল আসার ১৫ থেকে ২০ দিন আগেই তারা পুরো গাছ সাইপারম্যাক্সিন ও কার্বারিল গ্রুপের কীটনাশক দিয়ে ভালোভাবে স্প্রে করে ধুয়ে দিয়েছেন। এতে গাছে বাস করা হপার বা শোষকজাতীয় পোকাসহ অন্যান্য পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। যদি সঠিক সময়ে হপার বা শোষক পোকা দমন করা না যায় তাহলে আমের ফলন কমে যেত বলে জানান এই আমচাষি।
এদিকে, রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. আলিম উদ্দিন জানান, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার গাছে খুব একটা কীটনাশক প্রয়োগের প্রয়োজন নেই। তবে ছত্রাকজনিত রোগেও আমের মুকুল-ফুল-গুটি আক্রান্ত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ম্যানকোজেট গ্রুপের ছত্রাকনাশক দুই গ্রাম অথবা ইমাডোক্লোরিড গ্রুপের দানাদার প্রতিলিটার পানিতে দশমিক দুই গ্রাম, তরল দশমিক ২৫ মিলিলিটার ও সাইপারম্যাক্সিন গ্রুপের কীটনাশক প্রতিলিটার পানিতে এক মিলিলিটার মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
আবার মুকুল গুটিতে রূপান্তর হলে একই মাত্রায় দ্বিতীয়বার স্প্রে করতে হবে। এছাড়া পাউডারি মিলডিউ নামের এক প্রকার ছত্রাকজনিত রোগেও আমের ফলনের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। কখনও গাছে এ রোগের আক্রমণ দেখা দিলে অবশ্যই সালফার জাতীয় ছত্রাকনাশক প্রতিলিটার পানিতে দুই গ্রাম হারে মিশিয়ে সাত থেকে ১০ দিন পরপর দুইবার স্প্রে করতে হবে বলে জানান এই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক দেব দুলাল ঢালী জানান, ধান-চাল বা অন্য ফসলের মতো আম উৎপাদনের কোনো লক্ষ্যমাত্রা কৃষি অধিদফতরের কাছে থাকে না। তবে রাজশাহীর ১৬ হাজার ৫১৯ হেক্টর জমিতে আমগাছ রয়েছে। আগামী বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে কোনো প্রকৃতিক দুর্যোগ না হলে এখান থেকে প্রায় আড়াই লাখ টন আম উৎপাদন হবে বলে আশা করা করা যাচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৬
এসএস/এমজেএফ