ঢাকা: ‘মলয়পবনবিদ্ধঃ কোকিলেনাভিরম্যো/সুরভিমধুনিষেকাল্লগন্ধপ্রবন্ধঃ। /বিবিধমধূপযূথৈর্বেষ্ট্যমানঃ সমন্তাদ্/ভবতু তব বসন্তঃশ্রেষ্ঠকালঃ সুখায়॥’
ঋতুসংহার কাব্যে কবি কালিদাস বসন্তের রূপে এভাবেই সুখ খুঁজতে বলেছেন।
ফাল্গুনী মাতাল হাওয়ায় উদাস বসন্ত প্রেম-প্রকৃতিকে ভাবায়, তাড়িত করে। সংস্কৃত ভাষার সবচেয়ে শক্তিশালী এ কবি সেই খ্রিষ্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকের দিকে অদ্ভুতভাবে অনুভব করেছেন বসন্তকে। এরপর বিভিন্ন কালে প্রকৃতির মতো কবিতায়ও রূপ বদলেছে বসন্ত।
রবীন্দ্রনাথের রোদনভরা বসন্ত নজরুলে এসে হয়েছে ‘আসিবে তুমি জানি প্রিয়/ আনন্দে বনে বসন্ত এলো/ ভুবন হল সরসা, প্রিয়-দরশা, মনোহর। ’ বলা যায় এখন ধরায় প্রেম ও প্রকৃতির কবি নজরুলের এই গানের সুর ছড়িয়ে দুয়ারে আবার এসেছে ফুলেল, মধুময় যৌবনের বসন্ত।
শনিবার। পহেলা ফাল্গুন, ১৪২২ বঙ্গাব্দ। ঋতুরাজের প্রথম দিন। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অমর পঙক্তিতে, ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক/আজ বসন্ত। ’
শীত বুড়ির বিদায়ঘণ্টায় প্রকৃতিতে এখন বসন্তের দোল। দখিনা হাওয়া। শুকনো পাতার নূপুরের নিক্কন। গাছে গাছে আলোঝরা কচি পাতার উঁকি। নীলাকাশে সাদা মেঘ, আমের বনে মুকুলের মৌ মৌ গন্ধ, মৌমাছিদের গুঞ্জরণ। কোকিলের কুহুতান আর শিমুল-পলাশের ডালে আগুন রঙের খেলা।
কবি লিখেছেন...
হিম কুহেলির অন্তর তলে আজিকে পুলক জাগে
রাঙিয়া উঠেছে পলাশ-কলিকা মধু রঙ্গিন রাগে
আসিবে ফাল্গুন বাজাইবে বেনু বেদনারে যাবে ভুলি
বিকচ কুসুম গন্ধ ঢালিবে গান গেয়ে যাবে অলি......
রবীন্দ্রনাথের উচ্ছ্বাস যেমন, “আহা, আজি এ বসন্তে এত ফুল ফুটে,/ এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়,/...”। তেমন স্বাগত বার্তা নজরুলেরও, “বসন্ত এলো এলো এলোরে/পঞ্চম স্বরে কোকিল কুহুরে/মুহু মুহু কুহু কুহু তানে/ মাধবী নিকুঞ্জে পুঞ্জে পুঞ্জে/ভ্রমর গুঞ্জে গুঞ্জে গুনগুন গানে/...”
কালিদাস, রবীন্দ্র-নজরুল মাড়িয়ে বিশ শতকের আধুনিক কবিতায় ফের নতুন রূপ বসন্তের ‘হয়তো ফুটেনি ফুল রবীন্দ্রসঙ্গীতে যত আছে,/হয়তো গাহেনি পাখি অন্তর উদাস করা সুরে/বনের কুসুমগুলি ঘিরে। আকাশে মেলিয়া আঁখি/তবুও ফুটেছে জবা, দূরন্ত শিমুল গাছে গাছে,/তার তলে ভালোবেসে বসে আছে বসন্ত পথিক। ’ (নির্মলেন্দু গুণ)
ক্ষণে রূপ বদলেছে সুক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে। তবু বসন্ত রয়ে গেছে সেই উদাসী, মাতাল করা বিরহী শয্যায়।
প্রকৃতির চাদরে মোড়ানো সবুজ গ্রাম থেকে শুরু করে ইট-পাথরের নগরী, কুঁড়েঘর থেকে আকাশ ঢেকে রাখা উঁচু দালান, রাজপথ থেকে উদ্যান- সবখানেই এই বসন্তের ছোঁয়া।
বাসন্তী রঙে নিজেদের সাজিয়ে ফাগুনের আগুনে উচ্ছ্বলতা ও উন্মাদনায় ভাসবে বাঙালি। হরেক ফুলের রঙে বসন্ত সাজলেও এ ঋতুকে বরণে গাঁদা ফুলের রঙের পোশাকে নিজেদের সাজাবে তরুণ-তরুণীরা। বাহারি ফুলের মালাও শোভা পাবে তরুণীদের মাথায়।
চিরায়ত সুন্দর ভালোবাসা আর নব যৌবনের প্রতীক এই বসন্তকে স্বাগত জানাতে তরুণ-তরুণীসহ সর্বস্তরের জনতার ঢল নামবে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে শুরু করে রাজপথ-উদ্যান সবখানে।
প্রকৃতিজুড়েও চলবে নিজস্ব উদযাপন। ভরদুপুরে শুকনো পাতার হৃদয়ভাঙা মর্মর ধ্বনি, পাতা ওড়ানো বিরহী ফাল্গুনী বাতাস, ন্যাড়া ডালের হৃদয় খুঁড়ে সবুজ প্রাণের উঁকি, শিমুল, পলাশের রক্তিম আভা, কোকিলের অবিরাম সঙ্গীসন্ধান ধরায় জানান দেবে, বসন্ত এসে গেছে।
বাংলাদেশ সময়: ০০০১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৬
এইচএ/এএ