ঢাকা: ‘অযুত বৎসর আগে হে বসন্ত, প্রথম ফাল্গুনে
মত্ত কুতূহলী,
প্রথম যেদিন খুলি নন্দনের দক্ষিণ-দুয়ার
মর্তে এলে চলি,
অকস্মাৎ দাঁড়াইলে মানবের কুটিরপ্রাঙ্গণে
পীতাম্বর পরি,
উতলা উত্তরী হতে উড়াইয়া উন্মাদ পবনে
মন্দারমঞ্জরী,
দলে দলে নরনারী ছুটে এল গৃহদ্বার খুলি
লয়ে বীণা বেণু—
মাতিয়া পাগল নৃত্যে হাসিয়া করিল হানাহানি
ছুঁড়ি পুষ্পরেণু। ’ (বসন্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
বসন্ত নিয়ে বাঙালির উচ্ছ্বাস-আবেগ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও নাড়া দিয়েছিলো।
বসন্ত বাঙালিকে চিরকাল এমন উন্মাতাল করে দেয় বলে লোকে একে বলে ঋতুর রাজা। আর আমি বলি, হৃদয় উসকে দেওয়ার ঋতু। যে আসলে মনে মনে, নির্জনে আগুন ধরে যায়। যে আগুনে দাহ নেই, ঔজ্জ্বল্য আছে। আর তাতে অনুভূতি ডানা মেলে দেয় প্রেমের চাঞ্চল্যে। বয়সীরাও বয়স ভুলে তরুণ হয়ে ওঠেন। যেন কবিতার মতো ‘ফুল ফুটুক বা নাই ফুটুক’ পহেলা ফাল্গুন এলেই ভোরের বাতাস শ্রেণি-পেশা-বয়স নির্বিশেষে সবার হৃদয়ের দরজায় তুমুল কড়া নেড়ে বলে দেয় ‘আজ বসন্ত’।
গাছে গাছে ফুল না ফুটলেও হৃদয়ের সকল কলি মেলে দেয় পাপড়ির পরাণ। হৃদয় কী যেন চায়! কাকে যেন চায়! মনে হয়, ‘এমন দিনে তারে বলা যায়!’
কেন এমন হয়? মন এমন উচাটন হয়ে ওঠে কেন? চরম উদাস হৃদয়ও কেন আড়মোড় ভেঙে জেগে ওঠে, গেয়ে ওঠে, সেজে ওঠে? কোন সে যাদুর পাখি হৃদয়ে ঢুকে তোলপাড় করে চুপচাপ বাড়ির নীরবতা? তবে কি বসন্ত জাদুকর ঋতু? তাহলে সে কী যাদু দেখায়? তার যাদুর উপকরণটাইবা কী?
ডালে ডালে নতুন পাতার নবযৌবন, কৃষ্ণচূড়া, ডালিয়ার ডাল রক্তরঙিন হয়ে ওঠা, ভোরের বাতাসে ফুলের অহংকার, বাউল হাওয়ার মাতলামিই কি এ ঋতুকে যাদুকর করে তোলে? সব শরীর যার তীক্ষ্ম স্পর্শে নব ভাবাবেগ জেগে ওঠে। প্রেমের নৌকায় লাগে পাল। যে পালে বসন্ত বাতাস দেয় চঞ্চল গতির প্রবাহ।
আসলেই তাই। প্রকৃতির এই আমূল বদলে যাওয়াতো মূলত শীতের পৌঢ়াকে যুবতী বাতাসের তাড়ায় অলৌকিক নব যৌবনে উদ্ভাসিত করার ফলশ্রুতিই। আর পহেলা ফাল্গুনের সঙ্গে ভালোবাসার যোগ থাকবে নাইবা কেন, তারপরের দিনই যে ভালোবাসা দিবস! নব আবেশে ভালোবাসাবাসির দিন! তাই প্রকৃতিরও এই যুবতী হয়ে ওঠা। যেন বসন্ত ইন্দনের ঋতু, যে আসলে ফুঁ দিয়ে বাড়িয়ে দিতে আসে ভেতরের রঙিন আগুনের রূপ। তা-ই ‘ভেতর-বাহির’ হয় প্রকাশিত।
প্রেমিক-প্রেমিকারা এইদিন পরষ্পরের বাহুবন্ধনে রমনা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, টিএসসি, ধানমণ্ডি লেক কিংবা রবীন্দ্র সরোবরে নবআনন্দ ধারায় ঘুরবে- এতো পহেলা ফাল্গুনে এই শহরের কমন দৃশ্য। তরুণীদের পরনে থাকবে লালপাড় বাসন্তি রঙ শাড়ি, কব্জিতে বাজবে লাল বা রঙবেরঙের চুড়ি, পায়ে আলতা, করতলে আঁকা থাকবে মেহেদীর বাহারি নকশা, চুল বাঁধা লাল ফিতায়, খোঁপায় গোঁজা ফুল আর মুখে রংধনু হাসি। আর প্রেমিক যুবকতো ফতুয়া বা পাঞ্জাবি পড়া হাল আমলের কৃষ্ণ। সেও যেন একটু বাউল হয়ে ওঠে, হয়ত ভ্রাম্যমাণ আঁকিয়েদের দিয়ে হাতে আঁকিয়ে নেয় ফুলের নকশা, অন্যদিন হলে যা করতে সে লজ্জা পেত।
এই দিনে বয়সীদের বয়সও যেন উড়িয়ে নিয়ে যায় বসন্ত বাতাস। তারাও যেন একটু আড়াল খোঁজে সঙ্গীটিকে আরেকটু কাছে পাবার। হয়ত প্রথম হাত ধরার স্মৃতি পরষ্পরের হাতকে নিয়ে আসে হাতের উপরে। একটু বেশিই রোমাঞ্চ হয়ে যায়, লজ্জাটজ্জা ভুলে। যেন এমন দিনে সব আগল খোলা, আত্মভোলা হওয়াই নিয়ম।
গাছে গাছে নব পত্রপল্লব আর নতুন ফুলের সাম্রাজ্যে বাতাস বুক খুলে দিলে প্রকৃতির রূপও যেন এদিন ফেটে পড়তে চায়। আর নারীরাও হয়ে ওঠে প্রকৃতির প্রতিদ্বন্দ্বী! যেন তাদের মনের জিজ্ঞাসা, আমরাইবা রূপের বাহারে এমন দিনে পিছিয়ে থাকব কেন!
প্রেমে পড়া তরুণ বা তরুণীর যেন মনে হয় ‘এমনও দিনে তারে বলা যায়’। এমন দিনে ওই যে বাসন্তী রঙ শাড়ি পড়া তরুণী, মন-চোখ বারবার যার দিকে টেনে নেয়, তাকে বলাই উচিত! কিংবা বন্ধুদের আড্ডায় ওই যে সবুজ-লাল ফতুয়া পড়া শ্যাম ছেলেটা, যার মুষলধারার হাসি আছড়ে পড়ছে একা তরুণীর হৃদয়ে, তাকে দেখে যেন মনে হয়, ‘চোখে রাখি চোখ, চোখে চোখে কথা হোক’। আজ এমন কথা বলারইতো দিন!
হয়ত এভাবেই কোনো একা তরুণের পাঠানো চিরকুট কোনো একা তরুণীর হৃদয়ের দরজা খুলে দেয়। দু’জনের মনের উঠানে তখন লটারি জয়ী রোদ।
ফাল্গুনের আগমনে সবাই যেন সত্যি সত্যি বাউল। হয়ত কোনো প্রেমিকা পার্কের বেঞ্চিতে বসে ঝাঁঝাঁ দুপুরে তার প্রেমিকের আরেকটু কাছে ঘেঁষে বায়না ধরে বলে, ধরো না গানটা...। প্রেমিকও সংকোচ ভুলে পার্কের জনমানুষের ভিড়ে গলা ছেড়ে গেয়ে উঠে, ‘আহা, আজি বসন্তে কতো ফুল ফোটে, কতো পাখি গায়...’। তরুণীর মনে তখন হাজার পাখির কলকাকলি, চোখের কোনায় সুখের সামান্য নুন! সে নুন বলতে চায়, এমন সুখের দিন প্রতিদিন কেন যে আসে না প্রভু!
প্রেমিক-প্রেমিকা এভাবে হাত ধরে ঘুরতে ঘুরতে ফুচকা খায়, চটচটি খায়, একটু আড়াল পেলে দুয়েকটা সতর্ক চুমু...! হয়ত ফুচকা খেতে খেতে প্রকাশ্যে রোমান্টিক হয়ে ওঠে, নিজ হাতে প্রিয় মানুষটির মুখে একটা ফুচকা তুলে দেয়। ফুচকাওয়ালা আড়চোখে দেখে হাসে। মনে মনে হয়ত ভাবে, সন্ধ্যায় ফুসকা বিক্রি শেষে সেও বউকে নিয়ে যোগ দেবে বিকেলের বসন্তবরণ উৎসবে।
সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার পথে সে বউয়ের জন্য একটা বাসন্তি রঙ শাড়ি কেনে, লাল চুড়ি কেনে, একটা আলতাও কিনে নেয় সঙ্গে। যে প্রেমিক-প্রেমিকা দুপুরে তার দোকানে ফুচকা খেয়েছিল, হয়ত তাদের সঙ্গে ফুচকাওয়ালা দম্পতির বসন্তবরণ গানের অনুষ্ঠানে দেখা হয়ে যায়। ফুচকাওয়ালা একটু লজ্জা পায়। আহা! ফাল্গুনের সংক্রমিত প্রেম!
প্রকৃতির আমন্ত্রণে সামিল দম্পতিরা যেন বিয়ের প্রথমদিনের মতো একটু বেশিই রোমান্টিক হয়ে ওঠে। পার্কে বেড়াতে বেড়াতে স্বামীর কনিষ্ঠ আঙুল স্ত্রীর কনিষ্ঠায় চলে যায় নিজেদের অজান্তেই। এই দেখে ঈর্ষায় পোড়ে একা তরুণ বা একা তরুণী। হয়ত এমন দিনে কোনো ছেলে বন্ধু তার মেয়ে বন্ধুর সঙ্গে বা মেয়ে বন্ধু তার ছেলে বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুত্বের চেয়ে একটু বেশি রোমান্টিক হয়ে ওঠে আচরণে, যেন তারা প্রেমিক-প্রেমিকা।
আসলে এসবতো পহেলা ফাল্গুনের যাদুরকাঠির ছোঁয়ায় জেগে ওঠা প্রেমের কোরাস। যার ফলে ২০ বছর সংসার করা স্বামী-স্ত্রীরও মনে হয়, এইতো কেবল সেদিন শুরু হলো প্রণয়। একা তরুণ বা একা তরুণীর মনে হয় ‘অমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল’।
আবহমান কাল ধরে প্রত্যেক পহেলা ফাল্গুনে এমন নানান কাহিনী ঘটে থাকে। হয়ত কোনো একা তরুণী খুঁজে পায় তার আরাধ্য তরুণকে। আর একা তরুণ পায় স্বপ্নের তরুণীকে। আর হয়তইবা কেন, ওইতো গাছে গাছে গজিয়েছে নতুন পাতা, কৃষ্ণচূড়ার শাখায় লেগেছে আগুন, বাতাস নাড়ছে কড়া হৃদয় দুয়ারে, বাগানে ডেকে উঠছে বসন্তের কোকিল, হৃদয়ে হৃদয়ে বাজছে-
‘বসন্ত বাতাসে সইগো
বসন্ত বাতাসে,
বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ
আমার বাড়ি আসে সইগো
বসন্ত বাতাসে...’
বাংলাদেশ সময়: ১৬০০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৬
আরএম