ঢাকা: ‘সখি ভাবনা কাহারে বলে/ সখি যাতনা কাহারে বলে/ তোমরা যে বলো দিবস-রজনী ভালোবাসা ভালোবাসা/সখি ভালোবাসা কারে কয়?’
মানুষের আদ্যপান্ত লুকিয়ে থাকা সূক্ষ্ম-নিবিড় অনুভূতিগুলো যিনি সাহিত্যে, গানে বলে গেছেন অকপটে, সেই মানুষটিরও প্রশ্ন ‘ভালোবাসা কারে কয়?’ ভালোবাসা বিষয়টিই এরকম, অদ্ভুত সংবেদনশীল এক মানবিক অনুভূতি! এর অভিব্যক্তি-ব্যঞ্জনা মানুষ ভেদে, পরিবেশ-প্রতিবেশ ভেদে একেক রকম। তবে নিঃসন্দেহে সার্বজনীন।
সার্বজনীনতার কারণেই পাশ্চাত্যের গণ্ডি ছাড়িয়ে ‘ভালোবাসা দিবস’ আজ সবার কাছে অন্যরকম একটি দিন। তরুণ-তরুণীদের কাছে তো বটেই, বলা যায় সব বয়সীদের কাছে দিন দিন এ দিনটি বিশেষ দিন হয়ে উঠছে। তাইতো শাসন-অনুশাসনের ভয়-নিষেধ দূরে ঠেলে মন আজ মুক্ত বিহঙ্গ!
একেক জনের কাছে ভালোবাসার অর্থ একেক রকম। সে যে রকমেই হোক, জনারণ্যে রটে গেছে আজ ভালোবাসার দিন। লোকালয় জেনে গেছে আজ ভালোবাসার দিন।
ভালোবাসার মানুষটিকে আজ কেউ কেউ জানাবে মনের কথা। আর আগেই যাদের জানাজানি হয়ে গেছে তাদের কাছে দিনটি অন্যরকম হবে এটাই স্বাভাবিক। কারও কারও কাছে এই ভালোবাসা শুধু মনের মানুষটির জন্য নয়; সবার জন্য। এই ভালোবাসা হতে পারে বন্ধুর জন্য বন্ধুর, বাবা-মা-ভাই-বোন ও পরিবারের জন্য, রাস্তায় অসহায় বসে থাকা ছোট্ট পথশিশুটির জন্য, দেশের জন্য।
আঙুল কেটে রক্ত দিয়ে প্রেমপত্র লেখার দিন অনেক আগেই গত হয়েছে। গত হয়েছে একটি চিঠির জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষায় থাকার। এর বদলে তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে এসেছে মোবাইল বার্তা, ই-মেইল অথবা অনলাইন চ্যাটিং। এসবে যে আজ পুঞ্জ পুঞ্জ প্রেমকথার জোয়ার বইবে! বর্ণাঢ্য আনুষ্ঠানিকতা আর ভালোবাসার উৎসবে মুখর হবে জনপদ।
দিনটি পালনে শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্র সরোবরসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে থাকছে নানা উৎসব আয়োজন। বাদ যাবে না দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোও। গত গয়েক বছর দেশের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে চাপা শঙ্কায় কেটেছে ভালোবাসা দিবস।
এবার তা একেবারে নেই বললেই চলে।
আজ রাজধানী ঢাকারর শাহবাগেই কেবল নয়, ঢাকার প্রতিটি এলাকাতেই গত দু’দিন ধরে বসেছে অস্থায়ী ফুলের দোকান। পাড়া-মহল্লার অলিতে-গলিতে অস্থায়ী ফুলের দোকানগুলোতে বেশ দাম হাঁকাচ্ছেন দোকানীরা।
রোববার (১৪ ফেব্রুয়ারি) বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার কাঁটাবন, নীলক্ষেত, পলাশীতেও বসেছে অস্থায়ী ফুলের দোকান, বেচাকেনাও হচ্ছে মোটামুটি। নিরাপত্তার বাড়তি সতর্কতা রয়েছে পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেই।
শাহবাগে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। জাতীয় জাদুঘরের সামনে বেলা ১১টা ১৩ মিনিটে হৃদয় আকৃতির লালগুচ্ছ বেলুন উড়িয়ে ‘লাভ ফর ঢাকা’ শিরোনামের ই অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাইদ খোকন। এসময় দর্শক সারিতে থাকা প্রত্যেকের হাতে ধরা ছিল হৃদয় আকৃতির লাল বেলুন। শাহবাগ থেকে টিএসসির দিকে যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে এ অনুষ্ঠান উপলক্ষে।
উদ্বোধনী বক্তব্যে সাইদ খোকন বলেন, ২০১৬ সালকে আমরা পরিচ্ছন্ন বছর হিসেবে ঘোষণা করেছি। এ পরিচ্ছন্নতা কেবল একটি শহরের নয়, পরিচ্ছন্ন করতে আমাদের রুচি-অভ্যাস, চিন্তা, আদর্শ, মননকে। তবেই বাসযোগ্য শহর, দেশ গড়তে পারবো।
দুই বাংলার সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক বলেন, হিংসা-প্রতিহিংসা ঝেড়ে ফেলে নিঃশর্তে আমাদের ভালোবাসতে হবে। একটি শহরকে পরিচ্ছন্ন করার আগে চলুন আমরা নিজেদের পরিচ্ছন্ন করে তুলি।
উদ্বোধনী পর্বে আরও উপস্থিত ছিলেন, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, কৃষি গবেষক শাইখ সিরাজ, নাট্য অভিনেতা ড. এনামুল হক, আফজাল হোসেন, সামিট গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ফরিদ খান, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী প্রমুখ।
অনুষ্ঠান উপলক্ষে সকাল থেকেই রমনা, শাহবাগ, টিএসসি এলাকা ভালোবাসার রঙে বর্ণিল। প্রথম বসন্ত দিনের থেকে পার্থক্য সামান্য, একটু রঙের পরিবর্তন হয়েছে কেবল।
পহেলা ফাল্গুনের বাসন্তী রঙের পোশাক বদলে আজ অনেকেই অন্য রঙের পোশাক পরেছেন। এর মাঝে লাল রঙের আধিক্যই বেশি।
কুয়াশাচ্ছন্ন, মেঘলা সকালটা যেন বেলা বাড়ার সাথে সাথেই বর্ণিল হয়ে উঠছিল। যুগল পদচারণায় সামান্য সময়ের ব্যবধানে মুখর হয়ে ওঠে গোটা শাহবাগ, টিএসসি এলাকা। পরিবার-পরিজন নিয়েও এসেছেন অনেকে।
নীলক্ষেত এলাকায় ফুল কিনছিলেন ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী নীলা, নূসরাত, ফারিয়া, শাম্মীর। কথা হয় তাদের সঙ্গে। জানালেন, বন্ধুরা মিলে আজ সারা দিন অনেক ঘুরবেন।
সবাই মিলে একসঙ্গে উদযাপন করবেন ভালোবাসা দিবস। প্রত্যেকেই মাথায় পরেছেন ফুলের রিং। শনিবার বসন্ত উদযাপনও করেছেন একইভাবে।
ভালোবাসার মানে জানতে চাইলে নূসরাতের গম্ভীর উত্তর, যেখানে সব ভালোর অস্তিত্ব বিরাজ করে তাই ভালোবাসা। যে অস্তিত্বে কলুষতা থাকে না, প্রবঞ্চনা থাকে না, হীনমন্যতা থাকে না।
পুরান ঢাকার বাসিন্দা সজল পালের মতে ভালোবাসা মানে বিশ্বাস ও নির্ভরতা। হতে পারে সে বিশ্বাস অল্প সময়ের, হতে পারে সারা জীবনের। আর ভালোবাসা যেখানে নির্ভরতা তো সেখানেই।
কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে। তাদের কাছে
ভালোবাসা দিবসের পরিকল্পনা জানতে চাইলে ময়মনসিংহের ছেলে সিয়াম আদনান বাংলানিউজকে বলেন, কখনোই পরিকল্পনা করে ভালোবাসা দিবস পালন করা হয়নি।
বরাবরের মতো এবারও কোনো পরিকল্পনা নেই। সহপাঠী বন্ধুরা মিলে বের হয়েছি। ঘুরবো, আনন্দ করবো, একসাথে খাবো –এইতো।
অমিত মনে করেন ভালোবাসা মানেই বন্ধুত্ব। বন্ধুত্ব গড়ে না উঠলে কখনো ভালোবাসা হয় না। সে যে প্রকারের ভালোবাসাই হোক না কেন। তাছাড়া ভালোবাসার মানুষটিকে বন্ধু ভাবলে গতানুগতিক সম্পর্কের সাধারণ টানাপড়েনগুলো থাকে না বললেই চলে।
এই সাত-আটজন বন্ধুর মাঝে তার সেই ভালোবাসার মানুষটিও নাকি আছে।
স্ত্রী আর একমাত্র ছোট্ট সন্তানকে নিয়ে ঘুরতে আসা মাহফুজ রুবেল বলেন, বিশ্বাস ও সম্মানের একটি সম্পর্কের নাম ভালোবাসা।
ভালোবাসার মানুষটি কেমন হওয়া উচিত জানতে চাইলে রবীন্দ্রসঙ্গীতের শিল্পী শায়লা শারমিনের উত্তর ‘যে আমারে দেখিবারে পায় অসীম ক্ষমায়/ভার-মন্দ মিলায়ে সকলি। ’
ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন সংগঠন নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। নামকরা হোটেল ও রেস্টুরেন্ট বিশেষ লাঞ্চ ও ক্যান্ডেল-লাইট ডিনারের ব্যবস্থা করেছে। টেলিভিশনে আজ প্রচার হবে বিশেষ অনুষ্ঠান। রাজধানীর কয়েকটি স্থানে কনসার্টের আয়োজনও করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১২৩২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৬
এমএইচপি/এএ