ঋতু যায়, ঋতু আসে। গ্রীষ্ম যায়, শীত যায় আসে বসন্ত।
কিন্তু আমরা মানুষ। হারিয়ে যেতে চাই না সময়ের ফাঁদে। সময়ের গলিতে খুঁজে ফিরি জীবনের রং-রূপ-গন্ধ, হাসি-আনন্দ এমনকি বেদনাও। সৃষ্টির সবটুকু রসআস্বাদনেইতো জীবনের পূর্ণতা। অতঃপর ফিরে যেতে চাই সময়ের পথে...।
তাইতো গ্রীষ্মের দাবদাহেও গেয়ে যাই জীবনের গান। সদ্য বৃষ্টি-ভেজা তপ্ত মাটির গন্ধে খুঁজে পাই জীবন। অতঃপর দিগন্ত জোড়া কাশফুলের মেঘ-মিতালি, উঠানে নতুন ধান আর পুরোনো কাক। সেও চলে যায়। আসে শীত। টিনের চালে শিশিরের টিপ টিপ শব্দ। শিশিরভেজা নগ্ন পায়ে গ্রামের পথে দুরন্ত শৈশব। দরজার বাইরে নির্যাতিত বৃক্ষের দীর্ঘ অপেক্ষা, ফিরে যায় শীতও।
লুপ্ত শঙ্কা আর বিচ্ছিন্ন স্বপ্নের বাগানে ফোটে নতুন ফুল- শিমুল। বারান্দায় আশাজাগানিয়া একফালি রোদ্দুর। আসে ফাল্গুন। আসে বসন্ত। আসে প্রেম।
আজ বসন্তের দুই। জীবনের শুরু। দীর্ঘ বিরহ ও নীরবতার চাদর ভেঙে জেগে উঠেছে নতুন সূর্য। দীর্ঘ কুয়াশার চাদর ভেদ করে হেসেছে নতুন চাঁদ। বাগানে বাহারি গোলাপ, ঝরা পাতা।
যে বাগানে ঝড়া পাতা নেই সে বাগানের সৌন্দর্যতো হৃদয়ে প্রেম জাগায় না। বাগানেতো ফুল চিরদিনই থাকে। ঝরা পাতা-সেতো বসন্তেরই চিরন্তন শোভা।
দীর্ঘ বিরহ যাতনা ও প্রেমহীন জীবনের আড়মোড় ভেঙে কবি জেগে ওঠেন প্রেমের টানে। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘মন হতে প্রেম যেতেছে শুকায়ে,/ জীবন হতেছে শেষ। /শিথিল কপোল, মলিন নয়ন, তুষারধবল কেশ। ’
তুষারধবল শীতের শেষে যৌবনের গানে জেগে ওঠে তারুণ্য। আজ সেই জেগে ওঠার দিন। জীবনের জন্য ভালোবাসা। সৃষ্টির জন্য ভালোবাসা। সৃষ্টিকে ভালোবাসা।
ভালোবাসার স্বার্থকতা কোথায়? প্রাপ্তিতে না অপ্রাপ্তিতে? প্রেমে না বিরহে? যিনি প্রেমিক তিনিই জানেন। ভালোবাসা জীবনকে জয় করে। এমনকি প্রকৃত ভালোবাসা মৃত্যুঞ্জয়ী। প্রেমিক চলে যায় জীবনের ওপারে কিন্তু চিরন্তন প্রেম চিরজাগরুক জীবন ও মরনে।
মমতাজ নেই। নেই শাহজাহানও। এমনকি নেই আওরঙ্গজেবের তরবারি। কিন্তু প্রেমের অনবদ্য কবিতা আজো উচ্চারিত। রয়ে গেছে তাজমহল। মমতাজ বেঁচে থাকতে তিলে তিলে শাহজাহানের হৃদয়ে গড়েছিলেন এক প্রেমের সৌধ। তাইতো মৃত্যুর পরও তিনি বেঁচে ছিলেন সেখানেই। ভালোবাসা এভাবেই বেঁচে থাকে যুগে যুগে। ভালোবাসাই ভালোবাসার জীবন। মমতাজের ভালোবাসা শাহজাহান হৃদয়ে বেঁচে ছিল অতৃপ্ত প্রেমের প্রতিভূ হয়ে। সে ভালোবাসা অমর করে রাখতেই তাজের সৃষ্টি। প্রেম যে অস্তিত্বহীন কোনো অলীক কল্পনা নয়, চির জাগরুক এক সত্ত্বা-তাজমহলেই তার প্রকাশ।
কবি পুর্ণেন্দু পত্রী বয়ান করেন,
সর্বান্তঃকরণ প্রেম সমস্ত ধ্বংসের পরও পৃথিবীতে ঠিক রয়ে যায়। /ঠিকমতো গাঁথা হলে ভালোবাসা স্থির শিল্পকলা’।
পৃথিবীতে প্রেম হয় প্রতিনিয়ত। সব প্রেম পৃথিবী মনে রাখে না। মুঘল সাম্রাজ্যের সব প্রেম কাহিনী পৃথিবী মনে রাখেনি। এমনকি পৃথিবী মনে রাখেনি গ্রিক ও রোমান সাম্রাজ্যের সব প্রেমও।
যুবরাজ সেলিম ও আনার কলির প্রেম আমরা ভুলতে বসেছি। যে প্রেমের জন্য আনারকলিকে জীবন দিতে হয়েছে। সম্রাট আকবর সাম্রাজ্যের শান-শওকত রক্ষার জন্য, মুঘল খানদানের মর্যাদা জন্য জীবন্ত কবর দিয়েছেন আনার কলিকে। হায় আনারকলি! প্রেমের জন্য এমন বলিদান বিশ্বে বিরল। কিন্তু নিয়তি বড় নিষ্ঠুর। মুঘল সাম্রাজ্য এমনকি বিশ্ব মনে রাখেনি আনারকলিকে। মনে রেখেছে শাহজাহান-মমতাজকে।
এদিকে মির্জা গিয়াসউদ্দিন বেগের কন্যা নূরজাহান, তাকেও মনে রাখেনি প্রেমিক হৃদয়। মুঘল সাম্রাজ্যের সবচেয়ে প্রেমিক পুরুষ কে? জাহাঙ্গীর না শাহজাহান। জাহাঙ্গীরের প্রেমের তরিতে নাও ভাসিয়েছেন আনারকলি আর নূরজাহান। কিন্তু শ্রেষ্ঠ প্রেম কাহিনীর রচয়িতা বুঝি শাহজাহানই। আনারকলি অথবা নূরজাহানের সমাধিতে রচিত হয়নি কোনো কবিতা। কিন্তু মমতাজের সমাধিতে রচিত হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রেমের কবিতা-তাজমহল।
এখানে প্রেমের শেষ নয়। বিরহ আর প্রেমের মাঝে কোনো বিরোধ নেই। বিরহের মাঝেই প্রেমের বসবাস। মজনুর বাবা লাইলীর পায়ের ধুলো এনে যখন মজনুর চোখে লাগিয়ে দিলেন তখন মজনু কান্না বন্ধ করে দিল। থেমে গেলো তার বিরহ ক্রন্দন। কাদঁলে যদি লাইলীর পায়ের ধুলো মুছে যায় তাই মজনু কানা বন্ধ করে দিল। প্রেমিকার পায়ে চলা পথের ধারে প্রেমিকের অপেক্ষা-যদি তার দেখা পাই। এভাবেই কেটে যায় যুগ যুগান্তর। তবুও আশা জেগে থাকে। জেগে থাকে প্রেম।
এদিকে ফরহাদের কাছে নায়িকা শিরিঁর আবদার, 'তুমি যদি ওই নদীতে বাঁধ তৈরি করতে পার তবেই আমাকে পাবে। নদীতে বাঁধ নির্মান, সেও কি মানুষের কম্ম? কিন্তু প্রেমিক তা পারেন। শিরিঁকে পাওয়ার জন্য এ অসম্ভবকে সম্ভব করতেই হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে বাঁধ ভেঙে জলের তোড়ে মারা যায় ফরহাদ। আর তার দুঃখে শিরিঁও পানিতে ঝাঁপ দিয়ে আত্দহত্যা করে। অন্য রকম বর্ণনাও আছে। কিন্তু বর্ণনা যাই হোক-প্রেম যে সত্যি। চির জাগরুক।
সৃষ্টিকর্তা ভালোবাসতে ভালোবাসেন। তাইতো এ মহাসৃষ্টি। প্রকৃত প্রেমের মাঝেই সৃষ্টিকর্তার জীবন ও মরণ। সৃষ্টি ও প্রেমের মাঝেই তার বসবাস। প্রেম আছে বলেই সৃষ্টির এ মহাযজ্ঞ। প্রেমের বিপরীত ঘৃণা। ঘৃণা ধ্বংসের উৎস আর প্রেম সৃষ্টির।
যে হৃদয়ে ঘৃণার বসবাস সে হৃদয়ে ঈশ্বর বসবাস করেন না। প্রেমিক হৃদয়েই ঈশ্বরের আনাগোনা। সে প্রেম শুধু মানব মানবীর প্রেম নয়। সৃষ্টির সব জীব ও অজীবের জন্য যে প্রেম ঈশ্বর সে প্রেমের প্রেমিক। যারা সব সৃষ্টিকে ভালোবাসেন তারাই প্রকৃত প্রেমিক-প্রেমিকা।
কিন্তু আমরা অধম। ভালোবাসি শুধু শরীরকে। আত্মাকে নয়। নর-নারীকে, মানুষকে নয়। কিন্তু ভালোবাসার শুরু ও শেষ যে আত্মার অন্তরে। ওখান থেকেই ভালোবাসা উৎসারিত হয়। ভালোবাসার কত রূপ, কত বাহার। সেকি আমরা জানি, বুঝি। মহাসমুদ্রের উৎস থেকে ভালোবাসার কতটুকু সুধা পান করতে পারছি? ভালোবাসা মহান, সৃষ্টি মহান। কবি বলেন, তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি/শত রূপে শত বার/ জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার...’
বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৬
এএ