ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

বাঁশ-বেত পণ্যের গ্রাম বরিশালের বাঘদা

মুশফিক সৌরভ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৪৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৬
বাঁশ-বেত পণ্যের গ্রাম বরিশালের বাঘদা ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বরিশাল: বাইরে থেকে প্রথমবার এ গ্রামে ঢুকে হকচকিত হয়ে পড়বেন যে কেউই। গ্রামের ছেলে-বুড়ো থেকে শুরু করে কিশোরী-গৃহিণীরা সবাই ব্যস্ত বাঁশ ও বেতের তৈরি বিভিন্ন সাংসারিক সরঞ্জাম ও তৈজসপত্র তৈরিতে।



কি বাড়ির উঠান, কি পুকুরের ধার, বাড়ি লাগোয়া রাস্তা সবখানেই বাঁশ ও বেত নিয়ে কারিকুরি চলছে সবার। অবস্থা এমনই যে, বাঁশ-বেত পণ্যের গ্রাম বলে অনায়াসের পরিচয় গড়ে তোলা যায় বরিশালের আগৈলঝাড়ার উপজেলার বাঘদা গ্রামকে।

তবে খোঁজ নিয়ে ও সরেজমিনে গিয়ে জানা গেলো আরো চমকপ্রদ তথ্য। একসময় এই গ্রামের বাঁশ-বেত তৈরির কাজ ছিল আরো ব্যাপকহারে। জড়িত ছিলেন আরো বেশি মানুষ।

কালের আবর্তে, দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থা আর কাঁচামালের দুঃষ্প্রাপ্যতা আর প্রযুক্তির উৎকর্ষে কিছুটা থেমে গেছে এ শিল্পের গতি। কমে গেছে এ পেশায় থাকা মানুষের সংখ্যাও। কিন্তু রীতিমতো এখনো সমান খ্যাতি-যশ রয়েছে বাঁশ-বেত পণ্যের বাঘদা গ্রামের হাতে তৈরি জিনিসের। এ পেশাধারীদের থেকে আয়-উপার্জন কমে গেছে ঠিকই, তবে কমেনি তাদের জিনিষের জৌলুস ও চাহিদা।

বাহারি নঁকশা আর সুক্ষ্ম কারুকাজে বাঘদা গ্রামের তৈরি বাঁশ ও বেতজাত পণ্য নিয়ে তাই নতুন করে পুরোনো সুদিন ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখছেন, প্রজন্মকে দেখাচ্ছেন বাপ-দাদার পেশা ধরে রাখা বর্তমানের শিল্পীরা।

ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের মাহিলাড়া বাজার থেকে বাম দিকে পিচঢালা পথ ধরে কিছুটা পথ গেলেই বাঘদা গ্রামের শুরু। গ্রামের শুরু থেকে যতো ভেতরে যাওয়া যায়, দেখা মিলবে শিশু থেকে বয়স্ক নারী-পুরুষরা বাঁশ, কঞ্চি বা বেত ধারালো দা দিয়ে নানা আকৃতির করা হচ্ছে। কোনো বাড়ির আঙিনায় ও রাস্তায় বাঁশ ও বেতের টুকরো শুকানো হচ্ছে। সারাগ্রামে প্রায় সব জায়গাতেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বিভিন্ন জন এসব কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

বাঘদা গ্রামে ঘুরে জানো গেলো, গ্রামের ৩ শতাধিক পরিবারের মধ্যে প্রায় দেড় শতাধিক পরিবার হিন্দু সম্প্রদায়ের। এদেরই বেশিরভাগ সবাই কমবেশি বাঁশ-বেতের পণ্য তৈরির সঙ্গে জড়িত।

কথা হয় পঞ্চাশোর্ধ্ব সুশীল চন্দ্র বিশ্বাসের সঙ্গে। তিনি জানান, গ্রামের কমবেশি সবাই এ কাজ করেন। কাজের মধ্যে একটি হচ্ছে ভারি (মোটা ও বড়) আর একটি হচ্ছে সুক্ষ্ম (চিকন ও ছোট)। বেত এ কাজে সহায়ক ভূমিকা রাখে।

তবে বাপ-দাদার এ কাজে তেমন আয় নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভালো পারিশ্রমিক পাওয়ায় গতো ৪/৫ মাস ধরে অনেকেই স্থানীয় পানের বরজে কাজ করছেন। তাছাড়া বাঁশের পণ্য তৈরিতে কাঁচামাল সংকটের কারণেও অনেকে এ কাজে আগ্রন দেখান না। তবে বেশিরভাগই প্রয়োজনে ও অবসর সময়ে এ কাজ করেন।

গ্রামের দীঘির পাড় এলাকার বাসিন্দা ও সুক্ষ্ম বাঁশ-বেত পণ্যের কারিগর বিনয় ভূষণ বেপারী জানান, তার বাপ-দাদারা এ কাজ করতেন। বাবার কাজের সহযোগিতা করার মাধ্যমেই তিনি ১৯৭৫ সাল থেকে এ কাজে জড়িয়ে পড়েন। এরপর বাঁশের সুক্ষ্ম কাজের জন্য তিনি বিভিন্ন এনজিও থেকে প্রশিক্ষন নিয়েছেন। পরে নিজেই তা অনেককে শিখিয়েছেন।

বাবার মৃত্যুর পরে এ কাজই করেই ছোট ভাই-বোনদের নিয়ে সংসার চালিয়েছেন। তাদের বিয়ে দিয়েছেন। বর্তমানে তিনি ও তার ছোট ভাই বিপুল ভূষণ বেপারী এ কাজ করছেন। পরিবারের সদস্যরা তাদের কাজে সাহায্য করেন।

বিনয় ভূষণ জানান, চা ছাঁকনি, কলমদানি, কানের দুল, চুলের কাঁটা, ব্যান্ড, বাক্স, চুরি, সলার ডালা, ফ্রুট বাস্কেটসহ প্রায় ২ হাজারের মতো পণ্য নিয়ে তার কাজ। এসব পণ্যের মূল্য  ৩০ টাকা থেকে শুরু করে ১২০০ টাকা পর্যন্ত। এসব পণ্য প্রভাতি ও এমসিসি নামে সংগঠনের মাধ্যমে আমেরিকা, কানাডা ও ফিলিপাইনে রপ্তানি হয়।

তিনি আরো বলেন, তিনি ওই সংগঠন থেকে কাজের অর্ডার পেলে গ্রামের আরো ৩০ নারী-পুরুষকে নিয়ে করে থাকেন। ফলে প্রায় ২০টির মতো পরিবার তার এ কাজে সরাসরি যুক্ত।

তবে কাঁচামালের সংকট ও ঊর্ধ্বমূল্যের কারণে তাদের সাম্প্রতিক ব্যবসা মন্দা যাচ্ছে বলে মন্তব্য এ বিশেষজ্ঞ শিল্পীর।

গ্রামের আরেক বাসিন্দা লক্ষ্মণ বেপারী করেন ভারি পণ্য তৈরির কাজ। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে ফুলের ডালা, সাজি, ডালা, কুলা, ঝুড়ি প্রভৃতি।

তিনি জানান, দিনের বেশিরভাগ সময় পানের বরজে কাজ করেন, আর অবসর সময়ে এ কাজ করেন। তবে বর্তমানে বাড়ির নারীরাও এ কাজে তাদের সহায়তা করেন।

গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গ্রামের মধ্যে যারা এ কাজ করেন তাদের বেশিরভাগ স্থানীয় পাইকারদের কাছ থেকে অর্ডার নিয়ে থাকেন। আর পাইকারদের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ পণ্য চলে যায়। অর্ডার অনুযায়ী কাজ করে দিলেই পয়সা হাতে আসে। তবে অনেকে রয়েছেন যারা নিজ উদ্যোগে এ কাজ করেন এবং হাটের দিনে স্থানীয়ভাবে এসব পণ্য বিক্রি করেন। এসব কাজের মজুরি হিসেবে (ভারি পণ্য ২০ পিস) ২০০ থেকে হাজার টাকা পর্যন্ত।

রেনু বেপারী জানান, এ কাজের প্রধান কাঁচামাল বাঁশ। কিন্তু তাদের গ্রামে নরম বাঁশ পাওয়া যায় না। তাই আশপাশের গ্রাম থেকে বাঁশ কিনে আনতে হয়।

বাঁশজাত পণ্য তৈরির প্রক্রিয়া সম্পর্কে গৃহবধূ মায়া বেপারী বলেন, বাঁশ কিনে এনে বেশিদিন ফেলে রেখে যায় না। যেন শুকিয়ে না ‍যায় এজন্য পানিতে বেশ কিছুদিন ভিজিয়ে রাখতে হয়। ভিজে নরম হলে বাঁশ টুকরো টুকরো করে বেতি (পাতলা করে কাটা) করে শুকানো হয়। পরে ‍তা দিয়ে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করা হয়।

গ্রামের একেকটি পরিবার এ কাজ করে সহজেই মাসে ৮-১০ হাজার টাকা আয় করছেন বলে জানান সমীর বেপরী নামে এক যুবক। তিনি বলেন, যদি ভালোভাবে প্রতিদিন কাজ করা যায় তবে এর চেয়েও বেশি আয় করা যায়।

তবে কালের বিবর্তনে ও পর্যাপ্ত সহায়তার অভাবে এ পেশা থেকে অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন বলেও আক্ষেপ এ যুবকের।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৪৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৬
এসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।