ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

যমুনার চরে মহিষের সঙ্গে ঘর-সংসার

স্বপন চন্দ্র দাস, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৬
যমুনার চরে মহিষের সঙ্গে ঘর-সংসার ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সিরাজগঞ্জ: যমুনার দুর্গম চরে আড়াই শতাধিক মহিষের একটি বাথান। আর পাশেই নদীঘেঁষা বালু চরে চাষি ও রাখালেরা কয়েকটি ঝুপড়ি ঘর তুলে পেতেছেন সংসার।



সংখ্যায় তারা প্রায় অর্ধশত। মহিষগুলো লালন-পালন করাই তাদের কাজ।   মহিষের সঙ্গেই যেন তাদের ঘর-সংসার। মহিষ পালনকে ঘিরেই চলছে তাদের জীবন-জীবিকা।

সম্প্রতি সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার দুর্গম শিমলা চরে গিয়ে দেখা যায় মহিষ ও রাখালদের মহাকর্মযজ্ঞ। যা শুরু হয় ভোর থেকে। মহিষের দুধ দোয়ানো, নৌকায় করে গ্রাহকদের কাছে দুধ পাঠানো, আর দুপুর পর্যন্ত মহিষগুলোকে মাঠে চড়ানো। এরপর মধ্যাহ্ন ভোজ। বিকেলে আবার মহিষ চড়ানো। রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করেই চলছে এসব। এ যেন প্রাকৃতিক শিল্প প্রতিষ্ঠান।

কারখানায় যেমন শ্রমিক-কর্মচারীর শ্রমের বিনিময়ে পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে, ঠিক তেমনই চাষি, রাখালের শ্রমে মহিষ থেকে উৎপাদিত হচ্ছে দুধ।

জীবন-জীবিকা, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না ও চরাঞ্চলে থাকার নানা অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা হয় রাখাল ও মহিষের মালিকদের সঙ্গে।

মোষের পেট থ্যাইক্যা দুধ বাইর অয়, সেই দুধ বেচি হামাগো বউ-ছাওয়ালর রিজিক যোগান অয়, সেজন্যি ওগোরেও নিজের ছাওয়ালের মতোই হামরা লালন হরি। -একরাশ হাসি ছড়িয়ে কথাগুলো বলছিলেন, এ বাথানের ১৮টি মহিষের মালিক বগুড়া জেলার গাবতলী থানার দুর্গাহাটার গোবিন্দ ঘোষ।

একই জেলার ধুনট থানার হাসুখালির কানু ঘোষ ২২টি মহিষ ও পাঁচটি গরু চড়ান এ বাথানে। তার অধিনে দু’জন রাখালও রয়েছে।

তিনি বলেন, বছরের আট মাস ম্যোষের সাতে (সাথে) যমুনার চরে কাটাই। এ্যাটিই (এখানেই) খাই, এ্যাটিই ঘুমাই, হগ্গলের সাতে গল্পগুজব হরে আনন্দেই সময় কাটে।   

সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার গটিয়ার চরের বাসিন্দা এ বাথানের প্রবীণ রাখাল আব্দুর রাজ্জাক বলেন, মাসে আট হাজার ট্যাহা বেতন পাই, খাওয়া-থাকার ব্যবস্থাও মোষের মহাজনরা দ্যায়। দুই/একমাস পর বাড়ি যাইয়া খরচ দিয়া আসি।

বাথানের অর্ধশত মহিষের মহাজন বিষু ঘোষ জানান,  সিরাজগঞ্জ, বগুড়া ও জামালপুরের ১০/১৫ জন চাষির মহিষ এক সঙ্গে করে এ বাথান করা হয়েছে। শুকনো মৌসুমের আট/নয় মাস যমুনার চরে মহিষ পালন করা হয়। বাকি তিন থেকে চার মাস চাষিদের বাড়িতেই মহিষ লালন-পালন করা হয়। বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে গাইবান্ধা ফুলছড়ি ঘাট পর্যন্ত এ ধরনের ২০/২৫টি মহিষ কিংবা গরুর বাথান রয়েছে।

চর খারুয়ার বাবু প্রামাণিক বলেন, এ বাথানে আমার ১৮টি মহিষ রয়েছে। এছাড়া গরুও আছে পাঁচটি। আমরা মহিষ চাষিরা একত্রিত হয়ে চরাঞ্চলের জমির পরিত্যক্ত ফসল প্রতি বিঘা দুই থেকে তিন হাজার টাকায় কিনে গরু ও মহিষগুলোকে খেতে দেই।

আরো কথা হয়, বগুড়ার গাবতলী থানার দুর্গাহাটা গ্রামের সুধীর ঘোষ, অধির ঘোষ, গোবিন্দ ঘোষ, লিটন ঘোষ, শ্রীদাম ঘোষ, বিপ্লব ঘোষ, রাম ঘোষ, জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ উপজেলার বালিয়াঝারী গ্রামের তোষা ঘোষ, সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার গটিয়ার চরের আব্দুর রাজ্জাক ও চর খারুয়ার বাবু প্রামাণিকের সঙ্গে।

তারা জানান, প্রতিটি মহিষ দুই বেলায় ছয় থেকে ১০ কেজি পর্যন্ত দুধ দেয়। প্রতি কেজি দুধ ফ্যাট অনুযায়ী ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি করা হয়। এখানে কর্মরত রাখালদের আট/১০ হাজার টাকা মাসিক বেতন দিতে হয়। এছাড়া গরু-মহিষের খাদ্যের জন্য পরিত্যক্ত ফসল কেনা ও রাখালদের খাবার বাবদ মাসে খরচ হয় আরো আট/১০ হাজার টাকা। প্রতিটি গরু/মহিষ থেকে মাসে দুইশ’ কেজি দুধ পাওয়া যায়। যার দাম প্রায় ১১ হাজার টাকা। সে হিসেবে আট/১০টি মহিষ থেকে খরচ বাদে মাসিক আয় থাকে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। বছরে প্রতিটি মহিষ একটি করে বাচ্চা দেয়। যা বাড়তি আয় হিসেবে ধরা হয়। মহিষ পালন করেই আমরা স্বাবলম্বী হয়েছি। এ বিষয়ে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আমরা আরও এগিয়ে যেতে পারবো।

বাংলাদেশ সময়: ১১৫২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৬
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।