বরিশাল: হারিয়ে যেতে বসেছে মাটির তৈরি জিনিসপত্র। এ্যালুমিনিয়াম ও প্লাস্টিকের তৈরি জিনিসপত্রের ভীড়ে মাটির তৈরি জিনিসপত্রের কদর নেই বললেই চলে।
এক সময় মাটির তৈরি জিনিসপত্র ছিল বাঙালিদের একমাত্র ঐতিহ্য। আর এখন এটি শুধু দৈনন্দিন জীবনে শখের জোগান দিচ্ছে।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মতো দক্ষিণাঞ্চলে মৃৎ শিল্পীদের (পাল) অবস্থান কম নয়। তবে নানা প্রতিকূলতা ও কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে এক সময়ের জনপ্রিয় এ শিল্পকর্ম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে মৃৎ শিল্পীদের পেশাও। তারপরও কেউ কেউ শুধুই পূর্ব পুরুষের জন্যে এ শিল্পকে আঁকড়ে ধরে আছেন।
বরিশালের উজিরপুর, বানারীপাড়া, মেহেন্দীগঞ্জ ও বাকেরগঞ্জের বেশ কিছু এলাকায় মৃৎ শিল্পীদের অবস্থান ছিলো চোখে পড়ার মতো। এখনো এসব অঞ্চলে মৃৎ শিল্পীদের অবস্থান থাকলেও বাকেরগঞ্জ উপজেলার কলসকাঠী ইউনিয়নের পালপাড়া, নিয়ামতি ইউনিয়নের মহেশপুর, রামনগর, ডালমায়া গ্রামে তাদের অবস্থান যেন একটু বেশিই।
বর্তমানে যারা এ গ্রামগুলোতে বসবাস করছেন তাদের বেশির ভাগেরই পূর্ব পুরুষ মৃৎ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তবে এখনও অনেকে ঐতিহ্যের কারণে এ পেশাকে আঁকড়ে ধরে আছেন।
বর্তমানে মাটি সরবরাহ, শ্রম ও লোকবল দিয়ে এ কাজ চালাতে যে ব্যয় হয়, তৈরি জিনিস বিক্রি করেও সে ব্যয় উঠে আসছে না। ফলে পরিবার-পরিজন নিয়ে মৃৎ শিল্পীদের জীবন যাপন কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। এজন্য এ পেশা ছেড়ে অনেকেই পাড়ি জমিয়েছেন বিদেশে।
বাকেরগঞ্জের নেয়ামতিতে প্রায় সাড়ে ৩শ’ পরিবার এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত থাকলেও বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে দুইশ’র কাছাকাছি।
ওই ইউনিয়নের মহেশপুর গ্রামের বিমল চন্দ্র পাল (৩৫) জানান, যে পরিবারগুলো বর্তমানে তাদের পূর্ব পুরুষদের কর্মটি ধরে রেখেছেন তাদেরও দিন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো অবস্থা। সংসারে পাঁচ বছর বয়সী সন্তান থেকে শুরু করে ৮০ বছরের বৃদ্ধ (দাদা-দাদি) পর্যন্ত সারাদিন এ কাজে নিয়োজিত থাকেন। কারণ তাদের একমাত্র আয়ের উৎস এ মৃৎশিল্প।
তিনি জানান, দীর্ঘ বছর ধরে তিনি এ পেশার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। এর আগে তার পূর্ব পুরুষরা এ কাজ করতেন। আর তাই এ পেশাকে আঁকড়ে ধরেই বেঁচে আছেন। শিক্ষা-দীক্ষা না থাকায় এ পেশাতেই নিয়োজিত থাকতে হচ্ছে। কারণ ১১ সদস্যর পরিবার টিকিয়ে রাখতে এটাই তার একমাত্র সম্বল।
একই কথা জানালেন গ্রামের উষা রানী পাল (৮০)। তিনি জানান, ছোটবেলা থেকে এ কাজ করে আসছেন তিনি। প্রথমে বাবার ঘর, তারপরে স্বামীর ঘরে এসে এ কাজ করছেন। অন্যদের মতো এটাই তাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনের পথ। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় মানুষ এ শিল্পকর্ম থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় আয়ের পথ কমে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।
একদিকে মাটির জিনিসপত্রের দাম কম, অপরদিকে মাটি সংগ্রহ, জ্বালানি দ্রব্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন ও বিক্রয়ের সঙ্গে মিল না থাকায় প্রতি নিয়ত ঋণের বোঝা বৃদ্ধি পাচ্ছে পাল সম্প্রদায়ের। আবার সারা বছর এ মাটির তৈজসপত্রাদি তৈরির কাজ করা হলেও বর্ষার সময় কিছুদিন বন্ধ রাখা হয়, সবমিলিয়ে হতাশা আর কষ্ট যেন পিছু ছাড়ছেনা বলে জানালেন গ্রামের অপর বাসিন্দা সুশীল পাল (৬৮)।
নিয়ামতি ইউনিয়নের মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত স্বশিক্ষিত যুবক লিটন পাল জানান, প্লাস্টিক ও এ্যালুমিনিয়ামের জিনিসপত্র বাজারে আসায় মাটির তৈরি আসবাবপত্র তেমন একটা চলে না। তবে মাটির ব্যাংক, জলবিড়া, ঝুড়ি সড়া, টালি, পটারী, বিভিন্ন পুতুলসহ কিছু খেলনার চল এখনো রয়েছে।
প্রতি হাজার মাটির তৈরি মালসা বিক্রি করছে আট হাজার টাকা, কয়েল বক্স পিচ প্রতিটি পনের টাকা, সড়া প্রতিটি সোয়া তিন টাকা দরে এবং ফুলের টব ৩০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়াও মাটির ব্যাংক, জলবিড়া, ঝুড়ি সড়া, টালি, পটারীসহ বিভিন্ন পুতুল বিক্রি হচ্ছে আট থেকে সর্বোচ্চ ৪০ টাকার মধ্যে।
তবে চাহিদা থাকলে এর দামও বেড়ে যেতো, তাই বলা চলে চাহিদা না থাকায় প্রয়োজনীয় পুঁজির অভাবে মৃৎশিল্প বাঁচাতে হিমশিম থেতে হচ্ছে।
তিনি জানান, তবে এখনো এসব গ্রাম থেকে পিরোজপুর, ঢাকা, চাঁদপুর, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মাটির তৈরি জিনিসপত্র সরবরাহ করা হচ্ছে।
লিটন পাল আরও বলেন, পাল সম্প্রদায়ের কোনো সমবায় সমিতি না থাকার ফলে তাদের দুঃসময়ে সাহায্যের জন্য এনজিও ও ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর করতে হয়।
তিনি বলেন, মাটির তৈরি আসবাবপত্র বিক্রি করে মাসে আয় হয় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা কিন্তু এর পেছনে খরচ হয় প্রায় ১৩ থেকে ১৫ হাজার টাকা। পরবর্তীতে যাতায়াত ভাড়াসহ অন্যান্য খরচের পর যা থাকে তা দিয়ে পরিবার পরিচালনা করা দুরূহ। তাই ২০০ বছরের পুরনো এ অঞ্চলের মৃৎশিল্প টিকিয়ে রাখার জন্য উপর মহলের কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
এদিকে মৃৎ শিল্পীদের ব্যাপারে জেলা প্রশাসক ড. গাজী মো. সাইফুজ্জামান বলেন, মৃৎ শিল্পীদের সঙ্গে বিভিন্ন সেমিনার করে তাদের শিল্পকর্ম জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে তুলে ধরার জন্য সচেতনতামূলক কাজ করা হচ্ছে। কিছুদিন আগে মৃৎ শিল্পীদের নিয়ে সমাবেশ করা হয়েছে এছাড়াও ওই সব শিল্পীদের দেওয়া হয়েছে সম্মাননা। বর্তমান সরকারও এক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রণোদনা দিচ্ছে।
সরকার দরিদ্র জনগোষ্ঠির জন্য সামাজিক নিরাপত্তামূলক যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তার আওতাভুক্ত রয়েছে এ মৃৎ শিল্প। এছাড়াও এ শিল্পের জনপ্রিয়তাই তাদের বাঁচিয়ে রাখবে বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৫৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৬
আরএ