ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

হিমাচল থেকে মহিবুর রহমান

মুগ্ধতার ধর্মশালা...

মহিবুর রহমান, সিনিয়র করেসপনডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১২৮ ঘণ্টা, মার্চ ১৩, ২০১৬
মুগ্ধতার ধর্মশালা... ছবি: শোয়েব মিথুন/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ধর্মশালা থেকে: ধর্মশালার রূপের বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। শেষ করা যাবে না বলার চাইতে মনে হয়, করা যায় না এই শব্দটিই অনেক বেশি যুক্তিযুক্ত।

কেননা, সৃষ্টির শুরু থেকে আজ অব্দি রূপের যে ঝলক ধর্মশালা দেখিয়েছে বা দেখিয়ে আসছে তার বর্ণনা এখানে মাত্র কয়েকটি শব্দ দিয়ে কীভাব করা সম্ভব?

ধর্মশালার অবস্থান ভরতের হিমাচল প্রদেশের কাঙ্গরা জেলায়। হিমালয়ের পাদদেশের ধর্মশালা সবুজ বন আর সুউচ্চ পাহাড়ের অপার সৌন্দর্যে অনাদি কাল থেকেই বিশ্বের ভ্রমণ পিপাসুদের তৃষ্ণা মিটিয়ে যাচ্ছে। শুধু অপার সৌন্দর্যই নয়, ধর্মশালার আছে একটি সমৃদ্ধ রাজনৈতিক ইতিহাসও। ১৯৫৯ সালে তিব্বতের ধর্মগুরু দালাইলামা তিব্বত থেকে নির্বাসিত হওয়ার পর ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে তিনি ও তার ছাত্ররা এখানে এসে বসবাস শুরু করেন। দালাইলামা এখানে যে জায়গাটিতে থাকতেন তার নাম ম্যাকলিয়ডগঞ্জ। যা এক সময়ে ব্রিটিশদের পিকনিক স্পট ছিল।

ম্যাকলিয়ডগঞ্জ হলো ধর্মশালার সবচাইতে উঁচু পাহাড়। ভূপৃষ্ঠ থেকে ৬,৩৮১ ফুট উঁচু এই পাহাড়টিতে অবস্থান করেই তখন দালাইলামা ও তার শিষ্যরা বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের কাজ চালিয়ে গেছেন। সেখানকার সুরম্য বৌদ্ধাশ্রমটি সব সময়ই পর্যটকদের বিশেষভাবে আর্কষণ করে।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের এবারের আসরটি বসেছে ভারতে। যেখানকার মূল পর্বে খেলতে হলে বাংলাদেশকে পেরিয়ে আসতে হচ্ছে বাছাই পর্ব। আর সেই বাছাই পর্বের ম্যাচ খেলতে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল এখন এই ধর্মশালায়।

যা হোক বাংলাদেশর এই বাছাই পর্বের খেলা কভার করতে গেলো ৯ মার্চ রাত সাড়ে ১১টায় ঢাকা থেকে বাসযোগে আমি ও সহকর্মী শোয়েব মিথুন ধর্মশালার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি। আমাদের সঙ্গে আরও একজন ছিলেন তিনি দৈনিক কালের কণ্ঠের বিশেষ ফটোগ্রাফার মির ফরিদ আহমেদ। আমাদের ভ্রমণ পরিকল্পনা ছিল, ঢাকা থেকে বাসযোগে কলকাতা, কলকাতা থেকে প্লেনে দিল্লি আর দিল্লি থেকে বাসে হিমাচল।  

সেই হিসেবে ঢাকা থেকে আমরা কলকাতার উদ্দেশে রওনা দেই। আমাদের পরিকল্পনা ছিল ১০ মার্চ বিকেলের মধ্যেই হিমাচলে প্রবেশ করা। কিন্তু সেটি পারিনি কেননা আমরা যখন হিমাচলেরর ধর্মশালায় প্রবেশ করি তখন সময় সকাল ৯টা আর তারিখ হলো ১১ মার্চ। অর্থাৎ আমরা নির্ধারিত সময়ের চাইতে প্রায় ১ দিন পরে। গন্তব্যে সময় মতো পৌঁছাতে না পারার অভিজ্ঞতাটা আমার কাছ সব সময়ই তিক্ত।

কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, সময় মতো হিমাচলে পৌঁছানোর পর অভিজ্ঞতাটি আর তিক্ত থাকলো না! এখানকার প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে আমরা রীতি মতো বিমোহিত। হিমাচলের আাঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ, পাহাড়ের গায়ের বড় ও ছোট ছোট ঘর এবং পাহাড়ের ভেতর দিয়ে সাপের মতো বয়ে যাওয়া পথগুলো আমাদের অভিভূত করেছে।

মূলত পুরো হিমাচল প্রদেশটিই পাহাড়ে ঘেরা। আকাশ সমান উঁচু পাহাড়ের গায়ে পড়ে থাকা বরফগুলো আরও দৃষ্টি নন্দন। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, যেন সাদা রঙের কোনো সুউচ্চ বাড়ি ভূমি থেকে সোজা আসমানে গিয়ে ঠেকেছে।

এখানকার উপত্যকাগুলো আরও সুন্দর। পাহাড়ের মতো উপত্যকাগুলোতেও জনবসতি আছে। রাতের বেলায় প্রায় হাজার ফুট নিচের সেই জনবসতিতে যখন বিদ্যুতের আলো জ্বলে তখন সেদিকে তাকালে মনে হয় আগ্নেয় গিরির অগ্ন্যুতপাতের পর নিভু নিভু লাভার মতো।

আর দিনের বেলায় সবুজের মধ্যে উপত্যকার সুরম্য অট্টালিকাগুলো কী যে অপূর্ব তা কে বোঝাবে!

ধর্মশালাতে যে দৃশ্যটি সবচাইতে বেশি নজর কাড়ে সেটি হলো এখানকার পাহাড়ের গায়ে জমে থাকা বরফগুলো। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কয়েক হাজার ফুট সোজা উপরে উঠে যাওয়া পাহাড়গুলোর গায়ে আবৃত বরফগুলো কী যে নয়নাভিরাম, সেটি নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। ম্যাকলিয়ডগঞ্জ, বাসুনাগ, নাদি ও ধলাধার নামক পাহাড়ে এমন বরফ দিন-রাত স্থানীয় নাগরিকসহ পর্যটকদের বিশেষ আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।   

ধর্মশালার জনবসতি বেশ পরিকল্পিত। নির্দিষ্ট দূরত্বের প্রতিটি বাড়ি, স্কুল, কলেজ, অফিস, বাসস্টপ এমনকি চলার পথও অভিজাত রুচির পরিচয় বহন করে।

এখানকার জীবন-যাত্রার মান বেশ উন্নত। যতটুকু চেখে পড়েছে তাতে মন হয়েছে প্রতিটি নাগরিকই স্বচ্ছল জীবন-যাপন করছেন।

তবে, জায়গাটি পর্যটক অধ্যুষিত হওয়ায় দৈনন্দিন ব্যয় এখানে ভারতের অন্যান্য প্রদেশগুলোর চাইতে অনেক বেশি। একটি রুটি/পরোটার দাম ৪০ রুপি। অর্থাৎ আপনি যদি সব চাইতে কম খরচের খাবারটিও এখানে এক বেলা খেতে চান তাহলে নুন্যতম দেড়শো রুপি আপনার পকেটে থাকতেই হবে।

এখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থাও উল্লেখ করার মতো। রাস্তার প্রতিটি বাঁকে আছে নিরাপত্তারক্ষীদের সজাগ টহল। যে কোনো পর্যটের জন্যই সুখের বিষয় এটি।

শিক্ষা-দীক্ষায়ও পিছিয়ে নেই ধর্মশালা। স্থানীয় মানুষের শিক্ষার জন্য এখানে রয়েছে ১৫ থেকে ২০টি স্কুল, ১টি বেসরকারি কলেজ ও সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয়।

ধর্মশালার সিংহভাগ মানুষই হিন্দু ধর্মের। এই ধর্মটির পাশাপাশি বৌদ্ধ ও শিখরা এখানে আনেক আগে থেকে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করে আসছেন।    

ধর্মশালায় আসার পরই বৃষ্টির বাধা আমাদের পুরো টিমকে পেয়ে বসে। একথা ঠিক যে অব্যাহত বৃষ্টির কারণে আমাদের স্বাভাবিক কাজ-কর্মে বেশ জটিলতা পোহাতে হয়েছে, তবে কিছুই থেমে ছিল না। বৃষ্টির এমন ধারাবাহিক বর্ষণ কাজে যতটুকু না বাধার সৃষ্টি করেছে তার চেয়ে বেশি সৌন্দর্য আমাদের মুগ্ধ করেছে।

তবে দিনের চাইতে এখানকার রাতের বৃষ্টি অনেক বেশি মুগ্ধতার। রাতের বেলায় একটানা বৃষ্টিতে পুরো ধর্মশালায় নেমে আসে নিস্তব্ধতা। পাহাড়ি পথ বেয়ে বৃষ্টির পানি অবিরত বয়ে যায়। বৃষ্টিতে ভিজে গাছ নুইয়ে পড়া পানি দেখে মনে হয়, তারা অবিরাম প্রার্থনায় রতো। আর বৃষ্টিতে ভিজেও সুরম্য অট্টালিকাগুলোর ভেজা ভেজা অবয়ব পুরো ধর্মশালা মুগ্ধতা আরও বাড়িয়ে দেয়। যে মুগ্ধতার শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই।          

বাংলাদেশ সময়: ০১২৯ ঘণ্টা, মার্চ ১৩, ২০১৬
এইচএল/আইএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।