ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

যে শিল্পের ভাঁজ ভেজা শিল্পীর অশ্রুতে

সাজেদা সুইটি, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৪৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৯, ২০১৬
যে শিল্পের ভাঁজ ভেজা শিল্পীর অশ্রুতে ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বেলকুচি (শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ) ঘুরে: সারাদিন খেটেখুটে একটি শিল্পকর্ম। কোনো শিল্পীর কাজ শুরু সকাল সাতটায়, আর কারও আটটা থেকে।

বিকেল নাগাদ সেই শিল্পকর্মটি অনন্য রূপ পায়। এ হাত থেকে সে হাত, গুণগত মান, স্থান, কাল, পাত্রভেদে নানা দামে বিকোয় সেগুলো।

 

সৌন্দর্য, আভিজাত্য, আব্রু রক্ষার এ উপকরণ সভ্যতা ও সংস্কৃতির অংশ হিসেবে মিশে থাকলেও অনেকেই উদাসীন বা জানেন না, শিল্পটির সঙ্গে জড়িতদের বিষণ্ণতার গল্প। শিল্পকর্মের ঝলমলানিতে মুগ্ধ ব্যবহারকারীরাও অনেকেই জানেন না, প্রতিটি কর্মের ভাঁজ কতখানি ভেজা শিল্পীরই অশ্রু-ঘামে।

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর ও বেলকুচির তাঁতশিল্প সম্পর্কে তাই অনেকের অজানাই রয়ে গেছে। এখানকার তৈরি শাড়ি, লুঙ্গিসহ পরিধেয় বস্ত্রের সুনাম দেশ-দেশান্তরে। কিন্তু তাঁতিদের বুকে আজও চাপা কান্না। স্থানীয় বসুন্ধরার চন্দনগাতি এলাকার তাঁতশিল্পী আবুল কালাম (৩৪)। কাঠের ঘের দেওয়া ঘরটিতে উঁকি দিতেই চোখে পড়ে কালামের তেলতেলে চেহারাটি, প্রচণ্ড গরমে লুঙ্গি-গেঞ্জি পরা শরীর ঘামে ভেজা, চিবুক বেয়েও ঘাম গড়াচ্ছে।
 
হাতে বুনন চালিয়েই আলাপে সাড়া দিলেন। বাংলানিউজকে জানালেন, সকাল সাতটা থেকে কাজ শুরু করেছেন তিনি। সারাদিন ধরে একটি শাড়ি বুনে শেষ করবেন। প্রতি শাড়িতে তার মজুরি সাড়ে তিনশ টাকা।
 
তিনি জানান, মজুরি যাই হোক, এ কাজই তার রক্তে পেশা। আর কোনো কাজে যেতে মন চায় না। সংসার চলে টেনেটুনে, তবু মন ভরে যায় একটি দৃশ্য দেখে, যখন পুরো কাজ সেরে তাঁত থেকে নামে নতুন শাড়ি। এই হস্ততাঁত শিশ্পের প্রতি নেশা থাকা সত্ত্বেও কেউ কেউ পেশা বদলের চিন্তা করছেন। আবু খালিদ (৩৭) তাদের একজন। তার আয় প্রতি শাড়িতে ৪৩০ টাকা।
 
অনেকদিন ধরেই ভাবছেন, চলে যাবেন অন্য পেশায়। তার অনেক সহকর্মী পেশা বদল করেছেন। দু’জন ঢাকায় এসে রিকশা চালান বলে শুনেছেন তিনি। কিন্তু প্রতিদিনই ছাড়ার চিন্তা করেও ছাড়তে পারছেন না।

‘একখান কামই শিখছি জীবনে, ছাড়ি-ছাড়ি কইরাও মনটারে মানাইতে পারি না। প্যাট কয়, ছাইড়া দেও, মন কয়, ছাইড়ো না’- এই বলে হেসে দিলে ক্লান্ত খালিদ।
 
এখানকার শাড়ির বেশির ভাগই শাহজাদপুরের হাটে বিক্রি হয় বলে বাংলানিউজকে জানান চন্দনগাতির তাঁতমালিক পরিমল চন্দ্র প্রামা‍ণিক। যে কোনো উপলক্ষ কেন্দ্রিক কাজ বাড়ে। সম্প্রতি পহেলা বৈশাখের আগের সপ্তাহ পর্যন্ত লাল-সাদার প্রাধান্য রেখে শাড়ি বানিয়েছেন তারা।

ঢাকার বেইলী রোডসহ বিভিন্ন মার্কেটর শো-রুমে যায় তাদের শাড়ি। তবে পরিমলের শাড়ি বেশি যায় হাট থেকে। প্রতি মঙ্গলবার দুপুরের পর শাহজাদপুরে এ কাপড়ের হাট জমে। বিকেল, সন্ধ্যা, রাত পেরিয়ে পরদিন (বুধবার) সকাল ১০টার মধ্যে কার্যক্রম শেষ হয়।

পরিমল জানালেন, এক সময় এ এলাকাটিতে অনেক তাঁতঘর ছিলো। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সবাই এ কাজে নিয়োজিত ছিলেন। কিন্তু ভারত ও পাকিস্তানের কাপড়ের সহজলভ্যতার বাড়াবাড়িতে অনেকেই লোকসান গুনছেন, তাঁত বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন।

এদিক-সেদিক মিলিয়ে এখন এলাকার ৫০/৬০টি পরিবার এ পেশায় রয়েছে বলে জানান পরিমল। অনেকেরই তাঁত নষ্ট হওয়ার পর আর সেটি মেরামতের খরচও যোগাতে পারেননি। এভাবে ক্রমশ কমছে এ শিল্পের বিস্তার।

বিস্তার তো কমছেই, প্রায় বিলুপ্ত হস্ততাঁত। বেশিরভাগই স্বয়ংক্রিয় মেশিনে ঝুঁকেছেন মালিকরা। তাই শ্রমিকের চাহিদাও কমে গেছে। চাহিদা কম বলেই, এ শিল্পীদের মজুরি বাড়ার বিষয়টি গণ্য করা হচ্ছে না-জানালেন সংশ্লিষ্টরা।
 
এলাকায় একটি অভিজাত শো-রুমও দেখা গেলো। স্থানীয়রা জানান, ঢাকা থেকে এসে কেউ কেউ এসব শো-রুমের কাপড় কেনেন। পাইকারি হিসেবে কম দামে কেনা এসব শাড়ি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বেশি দামে বিক্রি হয়।

‘বড় লাভটি হয় ব্যবসায়ীর, তারপরে বিনিময়ের সঙ্গে জড়িত মাঝের ব্যক্তিদের (দালাল), খুব সামান্যই পান প্রান্তিক তাঁত মালিক, আর শ্রমিকের লাভ এটুকুই যে, তিনি পেশায় জড়িত থেকে দু’মুঠো খেতে পারছেন।

শ্রমিকের মজুরি দিতে না পেরে তাঁত বন্ধ করেছেন এমন একজন বাংলানিউজকে বলেন, ‘চেষ্টা করছিলাম, পারলাম না। বিদেশি কাপড় বেশি পিন্দে মানুষ। আটজন মানুষ ছিলো আমার, বেতনই দিতে পারি নাই তিনমাস। একদিন ডাইকা মাফ চায়া বিদায় চক্ষের পানি দিয়া। ’

শিশুদের জন্য ছাপা শাড়ি তৈরি করে ‘সনি এন্টারপ্রাইজ’। মেয়ের নামে কোম্পানি খুলেছেন শখ করে বলে জানান সালেহা বেগম। কষ্ট তারও, বাংলানিউজকে বলেন, ‘শাড়ির রঙ ও সুতার দাম বাড়ছে, ভালো জিনিস বানাইতে গেলে দামটাও বেশি। এলাকার পাবলিক বেশি দামেরগুলা নিবো না। তাই কমদামেই শাড়ি বানাইসি বৈশাখে। ছয় হাত, সাত হাত আর আট হাতের শাড়ি বেশি বেচা গেসে। ’

কর্মীদের মজুরি প্রসঙ্গে সালেহার ভাষ্য, ‘আইনা কাজ শেখাই, পরে অন্য জায়গায় চইলা যায়। নতুনডারে নিয়ে আবার কাজ শেখাই। মজুরি আর কেমনে বাড়াই। লাভতো নিজেরই বেশি অয়-টয় না। ’

পরিমলের পাশের বাড়িরই অপর মালিক বলেন, কম সময় ও খরচে বেশি সংখ্যায় শাড়ি তৈরির চেষ্টায় থাকতে হয়। গুণগত মানের বিষয়টি জরুরি, কিন্তু কোনো কোনো পার্টি সে বিষয়টি বুঝতে চান না। অন্যদের সঙ্গে তুলনা করে কম দামে পেলে সেদিকে চলে যায়। এজন্য চাইলেও সব সময় নিজের মর্জি মতো নিখুঁত শাড়ি বানানো যায় না। তবে কোনো কোনো ‘পার্টি’ ভালো পণ্যের কদর করেন বলে তাদের জন্য উন্নতমানের শাড়ি তৈরি করেন তিনি। তার তাঁতের কয়েক নকশার জামদানি ইতোমধ্যে একাধিক পার্টির পছন্দের বলেও জানান তিনি।

যে জামদানি ঢাকায় পাঁচ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়, সেটি পরিমলরা হাটে বিক্রি করছেন জোড়া দুই হাজার (প্রতিটি এক হাজার) টাকায়। আর শ্রমিক পাচ্ছে সাড়ে তিনশ থেকে পাঁচশ টাকা।

সব ভোগান্তি সয়েও এ শিল্পটিকে উজ্জ্বল দেখার আশা ছাড়েননি এসব তাঁতশিল্পী। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ও মনোযোগ প্রত্যাশা তাদের। শিল্পটিকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারি আরও উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানান।

তারা বলছেন, ভারতের শাড়ির দৌরাত্ম এখনই নিয়ন্ত্রণে না নিলে অদূর ভবিষ্যতে দেশীয় ঐতিহ্যবাহী শিল্পটি বিলুপ্ত হবে। প্রান্তিক মালিকদের কিছু প্রণোদনার ব্যবস্থাও চান তারা।

বাংলাদেশ সময়: ০৫৪২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৯, ২০১৬
এসকেএস/টিআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।