নেত্রকোনা থেকে ফিরে: সাদা মাটির পাহাড়। পাহাড়ের আড়ালেই চিনামাটির পাহাড়।
এমন সবুজ পাহাড়ের বিশালতা আর নদীর হিম-শীতল জলে চোখ জুড়াতেই গিয়েছিলাম বিরিশিরিতে। নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর থানার একটি ছোট্ট ইউনিয়ন বিরিশিরি। সেখানে দাড়ালে মনে হয় উত্তর-দক্ষিণে যতদূর চোখ যায় শুধু মেঘালয়ের গারো পাহাড় আর সোমেশ্বরী নদীর জল।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) আমরা ক‘জন বন্ধু বেরিয়ে পড়লাম নদী আর পাহাড়ে ঘেরা দুর্গাপুরের ঐতিহাসিক স্থানগুলো দেখার উদ্দেশে।
সেদিন ছিল শুক্রবার। ভোর হতেই হল থেকে বেরিয়ে পড়লাম আমি, সবুর, যুবায়ের, ফয়সাল, সাইদ, শিবলী সায়েম, আব্দুর রহমান, আল আমিন আর শুভ। ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে সকাল সাড়ে ৬টার ট্রেন ধরলাম। ট্রেন যতই এগোতে থাকে ততই আমাদের আনন্দ আর উত্তেজনা বাড়তে থাকে। আমাদের গান, গল্প আর কৌতুকে জমে উঠল পুরো বগি।
ঘন্টাখানেকের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম জারিয়া স্টেশনে। স্টেশন থেকে নেমে সকালের নাস্তা সেরে আমরা নদী পার হলাম। নদী পার হয়ে একটা ‘মহীন্দ্র’ নিয়ে ঘন্টাখানেকের মধ্যে পৌছে গেলাম কংস নদীর তীরে।
নদী পার হয়ে শিবগঞ্জ থেকে আমরা একটা অটো রিক্সা রিজার্ভ করলাম। সবগুলো দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখাবে সে। পথচলার শুরুতেই পড়ল বহেরাতলীতে নির্মিত ‘হাজং মাতা রাশমণি স্মৃতিসৌধ’। ১৯৪৬ সালের ৩১ জানুয়ারি সংঘটিত কৃষক ও টঙ্ক আন্দোলনের প্রথম শহীদ ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের নেত্রী হাজং মাতা রাশমণি।
রাশমণি স্মৃতিসৌধ থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে বিজয়পুরে আছে সাদা মাটির পাহাড়। এই পাহাড়ের চূড়ায় উঠে মনে হল আমরা এভারেস্ট জয় করে ফেলেছি। পাহাড়ের চূড়া থেকে দেখা যায় শুধু সবুজ আর সবুজ এবং চীনা মাটির পাহাড়ের সেই নীলচে সবুজ পানির হৃদ।
এমন নীলচে-সবুজ হৃদের পানিতে গোসল করার লোভ আমরা কেউই সামলাতে পারলাম না। পানিতে সাঁতার কাটা আর হুটোপুটি করে কচি ডাবের পানি আর শসা খেলাম। নিমীষেই চাঙ্গা হয়ে আবার রওনা দিলাম সোমেশ্বরী নদী আর বিরিশিরি দেখতে।
বেলা এক টার দিকে আমরা সোমেশ্বরী নদীর তীরে পৌঁছুলাম। প্রচন্ড খরস্রোতা নদী। নদীর ওপারেই সবুজে ঢাকা বিরিশিরি। যেন সবুজের চাদরে ঢাকা ছোট্ট একটা গ্রাম। আর তার পরেই দাঁড়িয়ে আছে মেঘালয় পাহাড়গুলো।
পাহাড়গুলো যেনো আকাশের মেঘগুলোকে নিবিড়ভাবে ছুঁয়ে আছে। এ যেন এক অপরূপ সৌন্দর্যের আধার। পাহাড় আর সবুজের ছোঁয়ায় মনে হবে যেন বান্দরবান কিংবা রাঙ্গামাটিতে চলে এসেছি। পাহাড়ের চূড়ায় দেখা যাচ্ছিল ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত। এ যেনো অন্যরকম এক মাত্রা যোগ করেছে।
এর কাছেই ছিল কমলা বাগান। বাগান বলতে কিছু না পেলেও একটা শ ’ফুটেক উঁচু টিলা ছিল। টিলাতে উঠতেই আমাদের দম বন্ধ হয়ে আসছিল। এই টিলা থেকেই মেঘালয় পাহাড়গুলো আরও স্পষ্ট দেখাচ্ছিল।
ফেরার পথে দেখে এলাম সেন্ট যোসেফের গীর্জা। গীর্জাটা বেশ সাজানো গোছানো, নীরব আর খুব সুন্দর। গীর্জার বিভিন্ন জায়গায় ছিল অনেক সুন্দর সুন্দর ফুলের চারা। গীর্জা দেখা শেষে আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে রওনা দিলাম ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে।
শিবগঞ্জ থেকে ধোবাউড়া পর্যন্ত অটো রিক্সাতে আর ধোবাউরা থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত বাসে। প্রায় পুরো ভ্রমণজুড়েই সঙ্গী হয়ে ছিল মেঘালয় পাহাড়গুলো। তবে এত সুন্দর আর ঐতিহাসিক পর্যটন কেন্দ্রগুলোর সংরক্ষণ ও পর্যটকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করলে এবং যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নয়ন করা গেলে ধীরে ধীরে এই দুর্গাপুর একটি জাতীয় পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হবে বলে আশা করা যায়।
এক চিলতে সবুজের মাঝে হারিয়ে যাওয়ার মাঝে যে প্রশান্তি আছে তা বুঝি এ পৃথিবীর আর কোনো কিছুর মাঝেই খুঁজে পাওয়া যাবে না।
সবশেষে বলব, এই পাহাড়ি সবুজের মতো আমাদের বন্ধুত্বগুলোও বেঁচে থাকুক চিরকাল, অটুট থাকুক হৃদয়ের বন্ধন।
বাংলাদেশ সময়: ০১৫৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৬
জেএম