ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

ডিমে তা দেওয়ার সময় পালকহীন হয় পাকরা ধনেশ

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন, ডিভিশনাল সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬১৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২, ২০১৬
ডিমে তা দেওয়ার সময় পালকহীন হয় পাকরা ধনেশ ছবি: ইনাম আল হক

শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার): ডিমে তা দিতে গিয়ে নিজের শরীরের পালকগুলো একটা একটা করে খসিয়ে পুরোপুরি পালকহীন হয়ে যায় স্ত্রী পাকরা ধনেশ। এছাড়াও গাছের খোড়ল বা গর্তটিকে অর্থাৎ যেখানে সে অবস্থান করছে, সেটির ছিদ্রটি মাটি দিয়ে ছোট করে রাখে।

 

ধনেশের প্রজনন মৌসুমে এই অদ্ভুত দু’টো বিষয় ঘটে। এভাবেই চলে আসছে অনাদিকাল ধরে।

অতিকায় দীর্ঘ ও তীক্ষ্ণ ঠোঁট এবং ঠোঁটের উপরের উঁচু শিং এর জন্য পাখিরাজ্যে শত শত পাখিদের মধ্যে ধনেশ পাখিকে আলাদাভাবে চিনে নিতে কোনো অসুবিধে হয় না। সিলেটের বিভিন্ন বনে একাধিকবার হঠাৎ করে ধনেশের দেখা পেয়ে এবং তার কর্কশ গলার ডাকাডাকি শুনে দারুণ উৎফুল্ল হয়ে ওঠে মন।  

উদয়ী-পাকরা ধনেশ এর ইংরেজি নাম Oriental Pied Hornbill এবং বৈজ্ঞানিক নাম Anthracoceros albirostris। এছাড়া কাউ ধনেশও বলা হয় তাকে। এরা বিশালাকৃতির পাখি। উচ্চতা প্রায় ৫০ সেন্টিমিটার থেকে ৬০ সেন্টিমিটার। বৃহত্তর সিলেট এবং বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল ছাড়া বাংলাদেশের কোথাও ধনেশ পাখি দেখা যায় না।  

প্রখ্যাত পাখি বিশেষজ্ঞ, লেখক এবং বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ইনাম আল হক বাংলানিউজকে এ প্রসঙ্গে বলেন, ডিমে তা দিতে গিয়ে পাকরা ধনেশ নিজের শরীরের পালক খসিয়ে ফেলার কারণ হলো, গর্তের অতিরিক্ত তাপমাত্রা থেকে নিজেকে রক্ষা করা। ধনেশ অনেক বড় আকারের পাখি। বড় পাখি বলে তার প্রয়োজন বাসা। কিন্তু বড় খোড়ল হলে ভেতরে সাপ ঢুকে যেতে পারে। বড় সাপ পাখির ডিম, বাচ্চা এবং পাখিকেও গিলে খেতে পারে। সাপের শিকার থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতেই মূলত এই পদ্ধতি রপ্ত করেছে ওরা।       

তিনি বলেন, প্রজননের সময় স্ত্রী ধনেশকে বিশাল গাছের খোড়ল বা গর্তের ভেতরে আড়াই থেকে প্রায় তিন মাস একটানা থাকতে হয়। ফলে ওদের সেই গর্তের ভেতর তাপমাত্রা প্রচণ্ড বেড়ে যায়। এ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে নিজের শরীরের পালক খসিয়ে ওরা একেবারে পালকহীন হয়ে পড়ে। পুরুষ ধনেশটি তখন দিনের পর দিন স্ত্রী ধনেশকে দূর থেকে খাবার সংগ্রহ করে এনে মুখে তুলে খাওয়ানোর কাজটি ধারাবাহিকভাবে করে যায়।  

পাকরা ধনেশ সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, কয়েক মাস আগে চট্টগ্রামের দুধপুকুরিয়া অঞ্চলে আমরা গিয়েছিলাম পাখি গণনার কাজে। আমার সঙ্গে ছিলেন তারেক অণু। স্থানীয় একজনের মুখে ধনেশের এমন বাসার কথা জানতে পেরে ভীষণভাবে আনন্দিত ও কৌতুহলী হয়ে উঠি। পাখি গণনার কাজ শেষ করে সেই স্থানে ছুটে যাই। দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে আমি দেখি, ওটা ধনেশেরই বাসা। কয়েক ঘণ্টা এখানে কাটানোর সিদ্ধান্তের খবর অণুকে জানাই। মিনিট পাঁচেক বসার পর অণু হতাশ হয়ে বলেন, এটি পুরাতন বাসা।  

তখন আমি অণুকে বলি, আমি পরিষ্কার দেখতে পেয়েছি বাসাটি মাটি দিয়ে বন্ধ করা হয়েছে। পুরাতন বাসা হলে ওরা মাটির আবরণটি ভেঙে ফেলতো। কারণ, স্ত্রী ধনেশ গর্ত থেকে বের হওয়ার সময় মাটির আবরণটি ভেঙে বের হয়। বাসাটি যেহেতু রয়েছে, তাই পুরুষ ধনেশটিকে এখানে আসতেই হবে।  

‘গাছের কয়েকটি বড় বড় পাতাযুক্ত ডাল কেটে এনে নিজেদের শরীরের উপর দিয়ে আড়াল হয়ে পুরুষ ধনেশটির জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। কিছুক্ষণের মধ্যেই অপেক্ষার পালা শেষ হয়। ’ 

জীবনে প্রথম এ দৃশ্যটি দেখার অভিজ্ঞতার বিষয়ে ইনাম আল হক বলেন, পুরুষ ধনেশ পাখিটি মুখে করে খাবার এনে মাটির ছোট্ট গর্তের ভেতর দিয়ে স্ত্রী ধনেশকে অনেকক্ষণ খাওয়ালো। এমন মনোমুগ্ধকর বিরল একটি দৃশ্য জীবনে সেদিন প্রথম আমি দেখলাম। এটি আসলে বর্ণনার অতীত। নিজ চোখে না দেখলে সেরকম অনুভূতি তৈরি হয় না। নানা বইয়ে-প্রবন্ধে ধনেশের এমন কাহিনি অনেকবার পড়েছি। কিন্তু সেদিনই নিজ চোখে সরাসরি দেখলাম। অভিভূত হয়ে ছবি তুললাম।  

পৃথিবীতে বহু জিনিসই আমরা পড়ি, জানি কিন্তু সেসব আমাদের দেখা হয় না। বই পড়ে জানা আর দেখার মধ্যে অনেক পার্থক্য। ‘দেখা’ মানে, এই ঘটনার সঙ্গে আপনি সরাসরি সংযুক্ত হয়ে গেলেন। এটা আপনার একেবারে নিজস্ব উপলব্ধির বিষয় হয়ে গেলো। নিজ চোখে দেখে গভীরভাবে অনুভব করলেন, যোগ করেন বরেণ্য এই পাখিবিদ।  

ধনেশ পাখির বিলুপ্তি প্রসঙ্গে ইনাম আল হক বলেন, পাকরা ধনেশকে  আমাদের পাহাড়ি অঞ্চলে এখনও দেখা যায়। তবে বড় আকারের রাজ ধনেশকে (Great Hornbill) এখন আর তেমনভাবে দেখাই যায় না। ওরা একেবারে বিলুপ্তির পথে বলা চলে গেছে। বড় গাছ এবং বড় গর্ত না হলে রাজ ধনেশরা বেঁচে থাকতে পারে না। বনের বড় বড় গাছপালাগুলো উজাড় হওয়ার ফলে ওদের অবস্থা এখন একেবারে গভীর সংকটাপন্ন।  

বাংলাদেশ সময়: ১৬১০ ঘন্টা, নভেম্বর ০২, ২০১৬ 
বিবিবি/এসএনএস
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।