ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

সুঘ্রাণের হাট

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২৮ ঘণ্টা, জুলাই ১৪, ২০১৮
সুঘ্রাণের হাট হাটে বিক্রির জন্য আনারস নিয়ে এসেছেন এক চাষি। ছবি: মনিরুল ইসলাম

টাঙ্গাইল: বাঙ‍ালির ফল বিলাসের তালিকায় অন্যতম আনারস। শুধু ফল বললে ভুল হবে, আনারসের রয়েছে বিবিধ ব্যবহার। রোগীর পথ্য, মাছের নানা পদে, সালাদ বা জুস কতোভাবেই না আনারস খাওয়া যায়। আনারস দিয়ে ইলিশ মাছ, জ্বীবে জল আসার মতো রান্নার একটি পদ।  

আনারস একটি অর্থকরী ফসলও বটে। পুষ্টিগুণের দিক থেকেও আনারস অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

কারণ এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’। একটা সময় ছিল যখন পাইন অ্যাপেল ফ্লেভারড বিস্কুট ছিল বাঙালির অন্যতম প্রধান স্নাক্স। ছোট বেলায় পাইন অ্যাপেল বিস্কুট বাজি রেখে কতো যে ফুটবল খেলা হয়েছে তা হিসেব করে বলতে হতো আমরা অনেকেই পারবো না।

আমাদের দেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট, মৌলভীবাজার, টাঙ্গাইল, ঢাকা, কুমিল্লা, দিনাজপুর, নরসিংদী জেলায় প্রচুর পরিমাণে আনারসের চাষ হলেও মধুপুরের আনারসের স্বাদের সুনাম দেশজুড়ে।  

মধুপুর অঞ্চলে জন্মানো আনারস বিক্রির জন্য বেশকিছু হাট বা বাজার রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম জলছত্র হাট। এ হাটে ঢুকার সঙ্গে সঙ্গে মিষ্টি একটি সুঘ্রাণ আপনাকে মোহিত করে দেবে। অন্যান্য হাটের মতো এটা বৈকালিক হাট নয়, এটা সাত সকালের হাট। সঠিক করে বলতে আনারসের সব হাটই সকাল বেলার হাট। হাটে বিক্রির জন্য আনারস নিয়ে এসেছেন চাষিরাপ্রত্যুষে হাটুরের দল তাদের ফলানো আনারস নিয়ে জলছত্র হাটে হাজির হয়ে সরগরম করে ফেলে। সকাল ৮টাতেই কিলবিল করে মানুষ ঢাকা মহাসড়ক বা প্রধান সড়কের দু’পাশের এ হাটে। কেউ বাইসাইকেলে ঝুলিয়ে, কেউ ঘোড়ার গাড়িতে, কেউ পিকআপ ভ্যানে করে নিয়ে আসেন আনারস।

মধুপুরের জাঙ্গালিয়া, অরুণখোলা, ষোলাকুঁড়ি ও আউশনাড়াসহ আশপাশের এলাকা থেকে বাইসাইকেলের দু’পাশে, ঘোড়ার গাড়িতে, রিকশা ভ্যানে অথবা পিকআপে করে আনারস নিয়ে আসছে এ হাটে। সপ্তাহে শুক্র ও মঙ্গলবার হাট বসে জলছত্রে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ক্রেতা আসেন আনারস কিনতে। রাস্তার দু’পাশে এখানে-ওখানে স্তুপ করে রাখা হয় আনারস। সেখান থেকে দরদাম করে দূর-দূরান্তের পাইকাররা কিনে ট্রাক বা পিকআপে বোঝাই করেন। এভাবে আনারস চলে যায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে।

মধুপুরের আনারসের স্বাদে প্রাণভরে তৃপ্ত হন সারাদেশের মানুষ। দেশজুড়ে মধুপুরের জলডুগি, হানিকুইন ও জায়ান্টকিউ আনারসের আছে সুখ্যাতি। আনারস বাগানমধুপুরের অরুণখোলা, ষোলাকুঁড়ি, আউশনাড়া ইউনিয়নে আনারসের ফলন সবচেয়ে ভালো হলেও সারা মধুপুরেই আনারসের ফলন হয়। প্রাকৃতিকভাবে আষাঢ়ের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত আনারস পাকার মৌসুম। তবে সারা বছরই অল্প-স্বল্প আনারস বাজারে পাওয়া যায়। গারো বাজার, মধুপুর বাজার ও ২৫ মাইল বাজারে আনারসের বেচাকেনা হলেও জলছত্র বাজারের পাশ ঘেঁষে ঢাকা মহাসড়কের দু’পাশে বসে আনারসের সবচেয়ে বড় হাট।

জলছত্র বাজারে বাইসাইকেলে করে আনারস নিয়ে বিক্রির অপেক্ষায় থাকা কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলে জানা যায়, সাইকেলে বা ভ্যানে করে আনারস বিক্রি করেন তাদের সবাই চাষি বা বাগানি নন। মূলত তারা চাষির বাগান থেকে আনারস কেটে তা হাটে এনে বিক্রি করেন। এজন্য প্রতি ১০০ আনারস বিক্রির জন্য ভ্যান বা সাইকেলওয়ালা পান ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। অনেক চাষি বা বাগানি নিজেরাই সাইকেল বা ভ্যানে করে এনে বিক্রি করেন।

সাইকেল করে আনা আনারস বিক্রেতা আনোয়ার বলেন, প্রতি ভ্যানে ১০৩টি আনারস থাকে। কিন্তু বিক্রি হয় ১০০টি হিসেবে। আনারাস বিক্রি হয় আকার ও জাত ভেদে। সাধারণত এ হাটে বড় আকারের আনারস প্রতিটি পাইকারি বিক্রি হয় ২৫ থেকে ৩০ টাকায়, মাঝারিগুলো ১৬ থকে ২০ টাকায়। আবার একটু ছোট আকারের প্রতিটি বিক্রি হয় ১২ থেকে ১৫ টাকায়।

টাঙ্গাইলের মধুপুরের বিস্তীর্ণ এলাকার জমিতে আনারসের চাষ হয়। সাধারণত ফাল্গুন-চৈত্র মাসে আনারসের চারা রোপণ করা হয়। পার্শ্ব চারা, বোঁটার চারা, মুকুট চারা ও গুঁড়ি চারা দিয়ে আনারসের বংশ বিস্তার করা হয়। পার্শ্ব চারা বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য বেশি উপযোগী। চাষিরা সাধারণত দুই রকমের চারা রোপণ করে থাকেন। একটি ছোট আকারের, আরেকটি বড় আকারের। বড় আকারের চারা থেকে ফল আসতে ১৮ মাস সময় লাগে। আর ছোট আকারের চারা থেকে ফল আসতে লাগে ৩৬ মাস। আষাঢ় থেকে শ্রাবণ মাসে ফল সংগ্রহের পূর্ণ মৌসুম হলেও বছরের বাকি সময় চাষিরা বাগানে আনারসের পাশাপাশি আদা বা হলুদ চাষ করে থাকেন।

সারাদেশের রসনা বিলাস মেটানোর পাশাপাশি মধুপুর অঞ্চলের অর্থনীতির চাকা আবর্তিত হয় এ জলছত্র হাটকে ঘিরে। ঢাকা থেকে সরাসরি মধুপুরে বাসে করে অথবা ব্যক্তিগত গাড়িতে গেলে মির্জাপুর-সখীপুর হয়ে বা ঢাকা-ময়মনসিংহের ভালুকা হয়ে বা ত্রিশাল হয়ে যাওয়া যায় এ সুঘ্রাণের হাটে।

বাংলাদেশ সময়: ২০১৮ ঘণ্টা, জুলাই ১৪, ২০১৮
আরবি/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।