ভুটানের প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণের অপেক্ষায় থাকা ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের (মমেক) ২৮তম ব্যাচের ছাত্র ডা. লোটে শেরিং’র কলেজ জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডা. মো. শফিকুল বারী তুহিন। স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘আমাদের ব্যাচের সব শিক্ষার্থীর সঙ্গেই সমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল লোটে।
লোটে শেরিং সম্পর্কে একই রকম তথ্য দেন এই কলেজেরই তার আরেক বন্ধু ডা. আসাদুজ্জামান রতন। এই চিকিৎসক বলেন, ‘লোটে শেরিং অনেক চুপচাপ থাকতেন। লেখাপড়াই ছিল তার একমাত্র ধ্যান। কঠিন অধ্যবসায়ই তাকে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দিয়েছে। আমাদের কলেজ জীবনের এই পরম বন্ধুর আকাশছোঁয়া সাফল্যে আমরা গর্বিত ও উচ্ছ্বসিত।
সোমবার (১৭ সেপ্টেম্বর) রাতে আলাদাভাবে তাদের সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের। নিজেদের বন্ধুর দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে যাওয়া জীবনের গল্প বলতে গিয়ে স্মৃতির জানালা খুলে দেন তারা।
এদিকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের (মমেক) প্রিন্সিপাল হিসেবে নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীর একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠার খবর রীতিমতো পুলকিত করেছে অধ্যাপক ডা. আনোয়ার হোসেনকেও।
প্রবীণ এ শিক্ষকের ভাষ্যমতে, লোটে শেরিং’র হাত ধরেই বিশ্ব পরিমণ্ডলে এই কলেজ পরিচিতি পাবে নতুনভাবে।
১৯৯১ সাল থেকে ২০০৩, দীর্ঘ প্রায় এক যুগ ময়মনসিংহ তথা বাংলাদেশে অবস্থানকালে কেমন ছিল ভুটানের ক্ষমতার মসনদে বসতে যাওয়া জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল ডিএনটি’র শীর্ষ নেতা ডা. লোটে শেরিং’র জীবনযাপন ও আনন্দ-বেদনার কাব্য, উঠে আসে তারই সহপাঠী ডা. মো. শফিকুল বারী তুহিনের বর্ণনাতে।
তিনি বলেন, ‘আমরা ১৯৯১ সালে মমেকে ভর্তি হই। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত একসঙ্গে পড়াশুনা করি। ১৯৯৮ সালে এমবিবিএস পাস করার পর লোটে শেরিং ঢাকায় সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজে চলে যায়। সেখানে অধ্যাপক খাদেমুল ইসলামের অধীনে এফসিপিএস সার্জারি কোর্সে ভর্তি হয়। ঢাকায় বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ান অ্যান্ড সার্জনস (বিসিপিএস) এফসিপিএস ডিগ্রি অর্জন করে। তারপর ২০০১ বা ২০০২ সালের দিকে ভুটান চলে যায়’।
‘আমার সঙ্গে খুব অন্তরঙ্গতা ছিল লোটে শেরিং’র। শহরের বাঘমারা মেডিক্যাল হোস্টেলে ওয়েস্ট ব্লকে ৮ বছর ছিল। তার বিল্ডিংয়ের পাশেই আমি থাকতাম। তাকে একবার ১৯৯২ সালের দিকে আমি ট্রেনে করে আমার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। দিনে গিয়ে দিনেই ফিরেছিলাম। সেই ট্রেন জার্নি সে ভীষণ উপভোগ করেছিল’।
তিনি বলেন, প্রকৃতির প্রতি টান ছিল লোটের। আমার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে সে অভিভূত হয়েছিল। ব্রক্ষপুত্র নদের উচ্ছলতা তাকে মুগ্ধ করেছিল।
‘মমেক কোনোদিন ভুলবে না তাকে। লন টেনিস খেলোয়াড় হিসেবেও তার একটি পরিচিতি ছিল। লন টেনিস যারা ভালো খেলত তাদের সঙ্গে সখ্য ছিল বেশি। তাকে আমরা মমেকে নিয়ে আসবো। আমরা বললে সে অবশ্যই কথা রাখবে’ গুণের পাশাপাশি বন্ধুকে নিয়ে এমন প্রত্যাশা এই সহপাঠীর।
মমেকের প্রিন্সিপাল অধ্যাপক ডা. আনোয়ার হোসেন গর্বভরা কণ্ঠে বলেন, ‘সাধারণত বিদেশি শিক্ষার্থীরা পাস করার পর নিজের দেশে ফিরে যায়। কিন্তু লোটে শেরিং আমাদের দেশে ইন্টার্নশিপ পাস করেই তা করেননি। এদেশেই সে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করে এবং তিন বছর ট্রেনিং করে এফসিপিএস সার্জারি ডিগ্রি অর্জন করেন। আর এই ডিগ্রি খুব প্রেস্টিজিয়াস। ’
তিনি বলেন, ‘২০০৩ সালে লোটে শেরিং ভুটানে ফিরে ল্যাপারোস্কোপিক সার্জন হিসেবে ওই দেশের জনগণের মন কেড়ে নিতে সক্ষম হন। তার আজকের অবস্থান মমেকের জন্য আনন্দ ও গর্বের। নিজের ব্যাচে মেধার দিক থেকে প্রথম দুই থেকে তিনজন শিক্ষার্থীর একজন ছিলেন লোটে শেরিং’।
বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে দেখা গেছে, বাংলাদেশ থেকে ভুটানে ফিরে সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন লোটে শেরিং। দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন জেডিডব্লিউএনআরএইচ অ্যান্ড মঙ্গার রিজিওনাল রেফারেল হসপিটালে কনসালট্যান্ট সার্জন হিসেবে। এরপর রাজনীতির পথে পা বাড়ান ২০১৩ সালের দিকে।
মাত্র ৫ বছরেই ডিএনটি দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেন। গত ১৫ সেপ্টেম্বর ভুটানে অনুষ্ঠিত প্রথম দফা নির্বাচনে বিস্ময়কর সাফল্য লাভ করে তার দল। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। আর এক মাসের মধ্যেই হয়তো তিনি অধিষ্ঠিত হবেন ভুটানের রাষ্ট্র ক্ষমতার সর্বোচ্চ পদে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩২৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৮
এমএএএম/এএটি/এনএইচটি