শনিবার (৪ এপ্রিল) বিভিন্ন সময়ে এসব এলাকা ঘুরে দেখা যায়, রাস্তার পাশে দিনের প্রায় অধিকাংশ সময়ই বিভিন্ন বয়সী ছিন্নমূল মানুষের জটলা। কাছে গিয়ে জানা যায়, কেউ হকার, কেউ দিনমজুর, কেউ ভিখারি।
এবিষয়ে সদরঘাট এলাকার ষাটোর্ধ ত্রাণপ্রার্থী মো. সেলিম বলেন, বয়স হইছে বাপ, সকলের সাথে দৌড় দিয়ে ত্রাণ নিতে পারি না। তাই দুই জায়গা থেকে ঘুইরা আইছি। আবার মেম্বার-চেয়াম্যানরা দেখতে চায় ভোটার কার্ড। ঢাকার বাসিন্দা না বলে ফিরায়েও দিতে চায় অনেকে। তারা তো বোঝে না, আমি বুড়া মানুষ, কাম-কাইজ নাই, তাই না খেয়ে থাকতে হয়।
তিনি যোগ করেন, যারা প্রাপ্ত বয়স্ক এবং শারীরিকভাবে একটু শক্তিশালী অথবা ছেলেমেয়ে আছে বেশ কয়েকজন, তারা প্রায়ই একটি ত্রাণের পরিবর্তে একাধিক ত্রাণ নিতে পারছে। আবার কেউ কেউ এক জায়গা থেকে নিয়ে আরেক জায়গায় ছুটে যাচ্ছে। গতকাল সারাদিন নিজে ত্রাণ না পেয়ে এমন একজনের কাছ থেকেই কম দামে কিছু চাল-ডাল আর আলু কিনছিলাম।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে কার্যত লকডাউনে ঢাকায় দিনমজুর মানুষজন হয়েছেন কর্মহীন। দৈনন্দিন রোজগার করতে না পেরে থমকে গেছে তাদের জীবনযাপন। কর্মহীন এই মানুষগুলো পেটের টানে সংক্রমণের ঝুঁকি সত্ত্বেও ত্রাণের খোঁজে ছুটছেন পথে পথে। তাইতো ত্রাণের তুলনায় এখন মানুষের সংখ্যা বেশি। দিন যত গড়াচ্ছে, দুর্ভোগ আরও বেশি হচ্ছে অসহায় এই মানুষদের।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ফুটপাতে এখন সাহায্যপ্রার্থীর সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়ে গেছে অনেকগুণ। প্রায় প্রতিটি সড়কেই একটু সাহায্যের আশায় বসে বসে ক্ষণ গুনছেন অসহায় মানুষগুলো।
ধানমন্ডির ১৫ নম্বরে ত্রাণের অপেক্ষায় বসে থাকা খলিলুর রহমান নামে এক রিকশাচালক বলেন, রিকশা নিয়ে এখন পুলিশ বের হতে দিতে চায় না। আর বেরুলেও ইনকাম নাই। সারাদিন ঘুরে নিজের খাবারের টাকাও হয় না। অল্পকিছু টাকা জমানো ছিল, তাও গত দশদিনে প্রায় শেষ হয়ে গেছে। বাধ্য হয়েই এখন ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
গুলিস্তানের মিল্লাত হোসেন মূলত বঙ্গবাজারের বিভিন্ন দোকানে মালপত্র বহনের কাজ করেন। টানা বন্ধে কাজ না থাকায় থমকে গেছে তার চার সদস্যের পরিবার। ইচ্ছে থাকলেও ছেলের অসুস্থতার জন্য ফিরতে পারেননি গ্রামে। তাই তিনিও অনেকটা বাধ্য হয়েই এখন অপেক্ষা করছেন ত্রাণের জন্য।
কথা হলে মিল্লাত হোসেন বলেন, করোনায় মরবো কি না জানিনা ভাই, কিন্তু অসুস্থ ছেলেটা আমার একদম ক্ষুধা সহ্য করতে পারে না। আমরা স্বামী-স্ত্রী গত দু'দিন ধরে ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করি, কিছু পেলে সংগ্রহ করি। একেতো আমার কাজ নেই, তার ওপর করোনার জন্য বউটাকেও কাজে যেতে মানা করেছে মালিকপক্ষ। কি যে বাজে অবস্থা চলছে সংসারে!
এদিকে সরেজমিন ঘুরে এবং খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব অসহায় মানুষদের অধিকাংশই খোঁজ জানেনা সরকারি ত্রাণের। একইসঙ্গে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের উদ্যোগে শহরের বিভিন্ন স্থানে যেসব ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে, সেটিও প্রয়োজনের তুলানায় অপ্রতুল। তবে রাজধানীর বিভিন্ন ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানিয়েছেন, এলাকা ভিত্তিক তালিকা তৈরির কাজ চলছে। খেটে খাওয়া অভাবী মানুষ এলাকায় যারা আছে, পর্যায়ক্রমে সবাইকে সাহায্য দেওয়া হবে।
এদিকে এই সংকটের সময়ে ত্রাণের সুষ্ঠু এবং সমন্বিত বন্টন প্রয়োজন বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে বাংলানিউজরে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড রিসার্স ইন আর্টস অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সের রিসার্স ফেলো হাসান নিটোলের সঙ্গে।
তিনি বলেন, কেউ কেউ অনেক ত্রাণ পাচ্ছে, আবার কেউ কেউ একদমই পাচ্ছে না। যারা শারীরিকভাবে সক্ষম, ছেলে মেয়ে রয়েছে, তরা বেশি পাচ্ছে। তবে এই ব্যাপারটা থেকে বের হয়ে আসা উচিত। প্রয়োজন ত্রাণের সুষম ও সুষ্ঠ বন্টন। ভোটার আইডি কার্ড দেখে শুধু রাজধানীর ভোটারদের ত্রাণ দেওয়া বা নেতাকর্মীদের পছন্দের লোক বাছাই না করে ত্রাণ দিতে হবে সুষ্ঠুভাবে। আর সেটি যেন এক জন একবারই পায়। এছাড়া ত্রাণের ক্ষেত্রে টাকার পরিবর্তে সামগ্রী দেওয়াটা বেশি সুবিধাজনক। এতে করে প্রকৃত গরিব মানুষগুলোরই সাহায্য হয়। কিন্তু ত্রাণ হিসেবে টাকা দিলে দেখা যায়, যারা সামর্থবান, অর্থাৎ যাদের ত্রাণের দরকার নেই, তারাও ভিড় করে। ফলে হতদরিদ্ররা বঞ্চিত হয়।
তিনি বলেন, জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী দরিদ্রের অনেক স্তর আছে। সবচেয়ে গরিব যারা, তাদের বলে হতদরিদ্র। যারা কোনমতে একমাস চলতে পারবে তাদের ত্রাণ দেওয়ার পরিবর্তে যারা একদমই হতদরিদ্র, ত্রাণটা এখন তাদের জন্য বেশি জরুরি।
এছাড়া ত্রাণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় স্যোসাল ডিসটেন্সও মেইনটেইন করা হচ্ছে না বলে এসময় উল্লেখ করেন তিনি। এ বিষয়ে এই গবেষক বলেন, এখন করোনার প্রাদুর্ভাব বাড়তে শুরু করেছে। এখন একটা গুরুত্বপূর্ণ সময় আমরা পার করছি। তাই এই সময়টা খুব হিসেব করেই আমাদের পার করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে উপকার করতে গিয়ে যেন পুরো বাংলাদেশের জন্য অপকার না করে ফেলি। এ বিষয়ে সরকারের নির্দেশনা মেনে চলা গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ সময়: ০৬৩০ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৫, ২০২০
এইচএমএস/এসআইএস