হ্যাঁ, খুলনায় মোটেও ভালো নেই কর্মহীন নিম্ন আয়ের অসহায় মানুষ। কাজ নেই, রোজগার নেই, তাই ঘরে খাবারও নেই।
বস্তিবাসী বৃদ্ধ, অসুস্থ মানুষ আর নারীদের সঙ্গে শিশুরাও নেমে এসেছে রাস্তায়। সারাদিন অপেক্ষা করেও অনেকের ভাগ্যে খাবার জুটছে না। আবার যারা খাবার বিতরণ করছেন, তাদের সমন্বয় না থাকায় কেউ খাবার পাচ্ছেন, কেউ পাচ্ছেন না। আবার অনেকে একাধিকবারও ত্রাণ সংগ্রহ করতে পারছেন।
ত্রাণের অপেক্ষায় থাকা অধিকাংশই হতদরিদ্র রিকশা-ভ্যান চালক, দিনমজুর, হকার, অস্থায়ী পাটকল শ্রমিক, মাছ কোম্পানির কর্মচারী, রাজমিস্ত্রি, সবজি বিক্রেতা, দোকানদার। করোনার কারণে তাদের দৈনিক আয়ও বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকের ঘরেই চাল-ডাল শেষ।
ত্রাণের আশায় সড়কে নেমে আসা একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভীষণ ক্ষুধার্ত তারা। ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন। দু’বেলা দু’মুঠো খাবার কেউ দিলে তা শিশুদের খাওয়ানো হচ্ছে । বড়দের সেই না খেয়েই থাকতে হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন নগরীর ভাসমান মানুষেরা। এরা ফুটপাতে কিংবা বিভিন্ন ঝুপড়িতে থাকেন। এদের অনেকেই শহরের ভোটার না। যে কারণে ওয়ার্ড কাউন্সিলররা তাদের কোনো সহায়তা দিচ্ছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে।
অনেকেই জানিয়েছেন, তাদের কোনো কাজ নেই। তাই ঘরেও খাবার নেই। কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন থেকে কোনো সাহায্য পাননি তারা।
সোমবার (৬ এপ্রিল) সকালে আজাদ লন্ড্রির মোড় এলাকায় হতদরিদ্র সুফিয়া বলেন, আগে বাসায় কাম করতাম। এহন করতে পারি না। বুড়া মানুষ। আমাগে কেউ খোঁজ নেয় না। হুনছি বিভিন্ন পাড়ায় ঘরে ঘরে খাদ্য পৌঁছে দিচ্ছে। আমরা এহনো কোনো ধরনের সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ পাইনি। আমরা কেমন আছি, কীভাবে আছি কোনো নেতা খোঁজও নেয়নি।
তবে তিনি জানান, তিন দিন আগে বাসায় এসে এক ব্যক্তি ২ কেজি চাল, আধা কেজি ডাল, আধা কেজি লবণ, এক কেজি আলু ও একটি সাবান দিয়ে গেছেন।
রূপসার নতুন বাজার বস্তির বাসিন্দা দিন মজুর আব্দুল্লাহ বলেন, আমি দিন মজুরি কাজ করি। এখন কাজকর্ম নাই। খাওয়া-দাওয়া নাই বললেই চলে। ঘরে বসে ছিলাম। কিন্তু এখন সাহায্যের জন্য বাইরে নামা লাগছে। ত্রাণ সামগ্রী কিছু না পেলে করোনা আসার আগেই আমরা ক্ষুধায় মইরে যাব।
রেল স্টেশন এলাকায় ষাটোর্ধ্ব আসমা আকুতি মিনতি করে বলেন, আমাকে একটু সাহায্য করেন। আমি মেলা অসুস্থ। আমাকে একটু দান করেন। সব সময় নামাজ পড়ে দোয়া করবো। আমি কোথাও খাবার পাচ্ছি না।
তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অপর এক নারী জানান, তিনি স্টেশনে আগে চা বিক্রি করতেন। এখন পুলিশ চা বেচতে দেয় না। ঘরে চাল ডাল কিছুই নাই। আজকে রান্না হয়নি। একজনে কিছু খাবার দিয়েছেন তাই খেয়েছেন। তার ঘরে একটি প্রতিবন্ধী মেয়ে আছে। তার দুটো সন্তান রেখে স্বামী স্ট্রোক করে মরে গেছেন। বড় বিপদে আছেন। কেউ সহযোগিতা করেনি।
অনেকে অভিযোগ করেছেন, খাদ্য সহায়তার জন্য ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কাছে গেলে তারা আইডি কার্ড চান। কিন্তু সহায়তা চাওয়া ব্যক্তিদের প্রশ্ন হলো- যাদের আইডি কার্ড নেই তারা কি সাহায্য পাবে না আর যাদের আইডি কার্ড আছে কিন্তু থাকে অন্য ওয়ার্ডে তারা কীভাবে সাহ্যয্য পাবে?
এদিকে জনসমাগম এড়াতে তালিকা করে রাতের বেলায় বাড়ি বাড়ি খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকেও প্রতিটি ওয়ার্ডে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। তবে সাহায্যের তুলনায় হতদরিদ্রের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় সংকট দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সরকারি ছাড়াও ব্যক্তি এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে খুলনায় হতদরিদ্রদের মাঝে সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম সংগঠন হচ্ছে খুলনা ফুড ও ব্লাড ব্যাংক। তাদের একদল স্বেচ্ছাসেবী দিনরাত নগরীর বিভিন্ন এলাকায় অসহায় মানুষকে সাহায্য করছেন।
খুলনা ব্লাড ব্যাংকের সাধারণ সম্পাদক ফারদিন ইসলাম অনিক বলেন, সমাজের সেইসব মানুষ ত্রাণ সামগ্রী থেকে বঞ্চিত যারা কোনো মানুষের কাছে সহজেই চাইতে পারে না এবং কোনো কাজ ও করতে পারছে না। আমরা রাতের আঁধারে এমন পরিবারগুলোকে খুঁজে বের করে, তাদের কাছে আমরা খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দিয়ে আসি। দেশের এই মূহূর্তে আমরা আমাদের এ কার্যক্রম করতে গিয়ে জীবন দিতে প্রস্তুত, কিন্তু কাউকে অভুক্ত দেখতে আমরা প্রস্তুত নই।
খাদ্য সামগ্রী বিতরণ প্রসঙ্গে খুলনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেন সকাল ৯টা ৫১ মনিটে বাংলানিউজকে বলেন, সরকারিভাবে এ পর্যন্ত খুলনা সিটি করপোরেশনে ৯ হাজার ৩০০ মানুষকে খাদ্য সহয়তা বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া অনলাইনে এসএমএস, ই-মেইল ও মোবাইলে ফোন করে যারা যোগাযোগ করেছেন জেলা প্রশাসনের বেসরকারি তহবিল থেকে ১৩শ’ ৭০ জনকে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ৯ উপজেলাতে ৪৭ হাজার জনকে সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। আরও নতুন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
ভোটার আইডি ছাড়া সহায়তা পাওয়া যাবে না এমন কোনো নিয়ম আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাধারণত সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের যেসব বরাদ্দ দিয়েছি তারা এসব দেখেন। উপজেলাতে ইউনিয়ন চেয়ারম্যানরা তাদের নাগরিক কিনা দেখেন। আমরা নির্দেশ দিয়েছি ভাসমান, দিন মজুর ও ফেরিওয়ালাদের তালিকা করে দ্বিতীয় দফায় তাদেরকেও খাদ্য সহায়তা দেওয়ার জন্য।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৬, ২০২০
এমআরএম/এজে