২০২৬ ফিফা বিশ্বকাপকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘দমনমূলক’ অভিবাসন নীতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ৯০টিরও বেশি মানবাধিকার ও নাগরিক সমাজের সংগঠন।
ফিফার সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনোর কাছে পাঠানো এক যৌথ চিঠিতে তারা আহ্বান জানিয়েছে—যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ওপর প্রভাব খাটিয়ে যেন বিশ্বকাপে অংশ নিতে ও খেলা দেখতে আগত দর্শক এবং দেশটির অভিবাসীদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা হয়।
চিঠিতে বলা হয়েছে, ইনফান্তিনোর হোয়াইট হাউসে ঘনঘন উপস্থিতি, মধ্যপ্রাচ্যের বিনিয়োগ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে তার সফর ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রমাণ করে যে, ফিফা চাইলে এই ইস্যুতে কার্যকর কূটনৈতিক ভূমিকা রাখতে পারে।
চিঠির ভাষ্য— ‘ফিফা যদি এই পরিস্থিতিতে নীরব থাকে, তাহলে তাদের ব্র্যান্ডকে ব্যবহার করা হবে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কর্তৃত্ববাদী ভাবমূর্তি ধোয়ার হাতিয়ার হিসেবে। ’
এই চিঠিতে স্বাক্ষর করেছে আন্তর্জাতিক ও মার্কিন নাগরিক অধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, বর্ণবৈষম্যবিরোধী মার্কিন সংগঠন 'এএনএএসিপি' (NAACP – National Association for the Advancement of Colored People) এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক নাগরিক অধিকার সংস্থা 'এসিএলইউ' (ACLU – American Civil Liberties Union)।
এছাড়া নিউইয়র্ক, ফ্লোরিডা, ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাসসহ যেসব অঙ্গরাজ্যে বিশ্বকাপ ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে, সেখানকার অসংখ্য স্থানীয় সংগঠনও এতে যুক্ত হয়েছে। চিঠিটি সমন্বয় করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার গ্রুপ ‘ফেয়ার স্কয়ার’।
চিঠির অনুলিপি পাঠানো হয়েছে ফিফার শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে—২০২৫ সালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর যুক্তরাষ্ট্রে একের পর এক নির্বাহী আদেশ ও অভিবাসনসংক্রান্ত নীতিমালা কার্যকর হয়েছে, যেগুলোর ফলে গোটা দেশে আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
বিশ্বকাপের জন্য প্রাক্কলিত ২৬ লাখ দর্শকের জন্য এ নীতিগুলো বড় বাধা হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে সংগঠনগুলো।
তাদের ভাষায়, “অভিবাসন ও কাস্টমস প্রয়োগ সংস্থা 'আইসিই' (ICE – Immigration and Customs Enforcement) ও শুল্ক ও সীমান্ত সুরক্ষা সংস্থা 'সিবিপি' (CBP – Customs and Border Protection)-এর ধরপাকড় ও অভিযানে সাধারণ মানুষ ভয়ের মধ্যে রয়েছে। কয়েকটি সরকার ইতোমধ্যে তাদের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণে সতর্কতা জারি করেছে। ”
বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা—যা এখন পর্যন্ত ১২টি দেশের নাগরিকদের ওপর আরোপিত হয়েছে। এর ফলে বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা ইরানের সমর্থকরা ম্যাচ দেখতে যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে না-ও পারেন।
এছাড়া আরও সাতটি দেশের ওপর আংশিক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ভেনেজুয়েলা। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস–এর প্রতিবেদন অনুসারে, ৩৬টি নতুন দেশ (বেশিরভাগ আফ্রিকান) নিষেধাজ্ঞার তালিকায় যুক্ত হতে পারে।
সংগঠনগুলোর দাবি, ‘রাজনৈতিক বা ধর্মীয় মতাদর্শের ভিত্তিতে অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশাধিকার হারাতে পারেন। ’
চিঠিতে ফিফার মানবাধিকার নীতিমালার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘ফিফার ইভেন্টে অংশগ্রহণকারীদের নিরাপত্তা, চলাফেরার স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার এবং সমাবেশের স্বাধীনতা—সবই অন্যতম প্রধান মানবাধিকার ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত। ’
অভিযোগ করা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন আটককেন্দ্রগুলোতে ‘নিষ্ঠুর, অমানবিক ও অপমানজনক আচরণ’ চলছে এবং আইনগত বিচারপ্রক্রিয়া উপেক্ষিত হচ্ছে।
চলতি বছরের ক্লাব বিশ্বকাপ ঘিরেও নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত সুরক্ষা সংস্থা 'সিবিপি' এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছিল, ‘আমরা স্যুট পরা, বুট পরা অবস্থায় নিরাপত্তা দিতে প্রস্তুত। ’
পরে ফিফার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে পোস্টটি সরানো হয়। তবে ঠিক কী কারণে পোস্ট সরানো হয়েছে, তা স্পষ্ট নয়।
এদিকে ‘এনবিসি মায়ামি’ জানায়, আইসিই বিশ্বকাপের ম্যাচগুলোতেও নিরাপত্তা বাহিনী হিসেবে উপস্থিত থাকবে এবং বিদেশি নাগরিকদের আইনগত প্রমাণপত্র সঙ্গে রাখার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।
গত দুই পুরুষ বিশ্বকাপ এমন দেশে আয়োজন করা হয়েছে—কাতার ও রাশিয়া—যেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ দীর্ঘদিনের, এবং এতে ফিফার নৈতিক অবস্থান নিয়ে আগেই প্রশ্ন উঠেছিল। এবার ২০৩৪ আসরের আয়োজক সৌদি আরব হওয়ায় সেই সমালোচনার মাত্রা আরও বেড়েছে।
সম্প্রতি ফিফা একটি ৩৯ পৃষ্ঠার মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যা প্রস্তুত করেছিল সৌদি আরবের পক্ষে ‘ক্লিফর্ড চান্স’ নামের একটি বৈশ্বিক আইন সংস্থা। কিন্তু ১১টি শীর্ষ মানবাধিকার সংগঠন দাবি করেছে—এই প্রতিবেদন ছিল ‘ত্রুটিপূর্ণ’ ও পক্ষপাতদুষ্ট।
ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো সম্প্রতি প্যারাগুয়েতে ফিফা কংগ্রেসে বলেন, ‘বিশ্বকাপে কেবল খেলোয়াড় নয়, বিশ্বের সব দর্শককেও আমরা স্বাগত জানাই। ’
মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স বলেছেন, ‘আমরা চাই সবাই আসুক, উদযাপন করুক, খেলা উপভোগ করুক। তবে খেলা শেষে সবাই যেন নিজ নিজ দেশে ফিরে যায়। তা না হলে তাদের হোমল্যান্ড সিকিউরিটির সচিব ক্রিস্টি নোয়েমের সঙ্গে কথা বলতে হবে। ’
ফেয়ার স্কয়ার ও অন্যান্য সংগঠনের ভাষায়, বিশ্বকাপ সফল করতে কেবল অবকাঠামো নয়, জরুরি, ‘সব জাতি, মত ও পরিচয়ের মানুষের জন্য একটি নিরাপদ, উন্মুক্ত ও মর্যাদাপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করা। ’
এমএইচএম