ঢাকা, রবিবার, ২৯ আষাঢ় ১৪৩২, ১৩ জুলাই ২০২৫, ১৭ মহররম ১৪৪৭

ফুটবল

ফুটবলের নিষিদ্ধ নাম ‘ফিলিস্তিন’

মূল: লায়লা হামেদ | অনুবাদ: মোয়াজ্জেম হোসেন মানিক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯:৪০, জুলাই ১১, ২০২৫
ফুটবলের নিষিদ্ধ নাম ‘ফিলিস্তিন’ সংগৃহীত ছবি

ফুটবল নাকি ‘দ্য বিউটিফুল গেম’—একটি বৈশ্বিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক খেলা যেখানে ব্রাজিল কিংবা ফ্রান্সের বস্তি থেকে উঠে আসা শিশুরাও প্রতিভা আর পরিশ্রম দিয়ে বদলে ফেলতে পারে নিজের, এমনকি গোটা পরিবার ও সমাজের ভাগ্য।

দাবি করা হয়— ফুটবল শ্রেণির ঊর্ধ্বে, একটি জনগণের খেলা।

খেলোয়াড়দের পায়ে পায়ে গড়ে ওঠে সমতা, প্রগতিশীলতা আর ন্যায়ের ভাষা। ফুটবল শুধু আয়না নয়, পরিবর্তনের এক শক্তিশালী ইঞ্জিন।

কিন্তু একটা বিষয়ে এলেই এই ফুটবল থমকে যায়। সেখানে তার নীতির মুখোশ খুলে পড়ে। সেই শব্দটি—‘ফিলিস্তিন’।

ন্যায়ের কথা বলা, বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার কথা বলা যেসব ক্লাবের মুখে রুটিন বিবৃতি থাকে—তারাই আবার গাজায় গণহত্যার বিরুদ্ধে কথা বলায় নিজস্ব সমর্থকদের মুখ বন্ধ করে দেয়।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বড় বড় ক্লাবগুলো একদিকে ফিলিস্তিন সংহতির প্রতীক নিষিদ্ধ করেছে, অন্যদিকে চুপ থেকেছে—যখন গ্যালারির সাধারণ সমর্থকেরা বুকে কিফায়া বেঁধে পতাকা উড়িয়েছে।

কয়েক সপ্তাহ আগে, ইসরায়েল যখন ইরানে বোমাবর্ষণ করে, তখন প্রিমিয়ার লিগ ক্লাব টটেনহ্যাম হটস্পার নিজেদের বহু বছরের অনুগত সমর্থকদের কয়েকজনকে ব্লক করে দেয়—শুধু তারা ইসরায়েলি খেলোয়াড় মানোর সোলোমনের ইসরায়েলি সেনাবাহিনী-সমর্থনের সমালোচনা করেছিলেন বলেই।

ক্লাবটি জানায়, এগুলো ‘মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত’ সম্পর্কিত পোস্ট ছিল। পরে ক্ষমা চাইলেও, সেটা ভুলের ক্ষমা মনে হয়নি—বরং যেন ছিল একটা হুঁশিয়ারি: ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলবে? চুপ করিয়ে দেব!

অথচ সেই মানোর সোলোমন নিজে প্রকাশ্যে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে সমর্থন করে পোস্ট দিয়ে যাচ্ছেন—যে বাহিনী প্রতিদিন গাজায় হাসপাতাল উড়িয়ে দিচ্ছে, দুর্ভিক্ষ চাপিয়ে দিচ্ছে, জাতিগত নির্মূল অভিযান চালাচ্ছে।

টটেনহ্যামের মিডিয়া টিমের কয়েকজন সদস্যের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট ঘেঁটে দেখা গেছে, তারা নেতানিয়াহু ও ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে সমর্থন করে পোস্ট করেছেন। যখন ক্লাবের বার্তা তৈরির দায়িত্বে থাকা মানুষগুলোই দখলদারিত্বের প্রতি সহানুভূতিশীল হন, তখন বোঝা যায়—কাদের কথা শুনবে ফুটবল, আর কাদের গলা কেটে দেবে।

এই তালিকায় শুধু টটেনহ্যাম নেই। আর্সেনাল—প্রগতিশীল ভাবমূর্তির জন্য পরিচিত ক্লাবটিও—ফিলিস্তিন নিয়ে কথা বলায় বরখাস্ত করেছে ৬১ বছর বয়সী কিটম্যান মার্ক বোননিককে, যিনি ২০ বছর ধরে ক্লাবের সঙ্গে কাজ করছিলেন। কারণ? তিনি অনলাইনে গাজায় ইসরায়েলি হামলাকে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ বলেছিলেন। এখন তিনি মামলা করছেন—যুক্তরাজ্যের আইনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা লঙ্ঘনের অভিযোগে।

অন্যদিকে, আর্সেনালের আর্সেনালের ইউক্রেনীয় মিডফিল্ডার ওলেকজান্ডার জিনচেঙ্কো বছরখানেক আগে ইসরায়েলপন্থী পোস্ট দিয়েছিলেন। পরে সেটি ডিলিট করে প্রাইভেট করে ফেলেন অ্যাকাউন্ট। ক্লাব কোনো তদন্ত করেনি, কিছু বলেনি। অথচ একজন মুসলিম সমর্থক গ্রুপের সহ-প্রতিষ্ঠাতার পুরনো টুইট নিয়ে ক্লাব তদন্ত শুরু করেছে।

যুক্তরাজ্যে এখন ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলা যেন অপরাধ। কিন্তু যে রাষ্ট্র শিশু হত্যা করছে, তাকে সমর্থন করা নির্বিঘ্ন।

যুক্তরাজ্যের ফুটবল কিংবদন্তি গ্যারি লিনেকার-ও এই খেসারত দিয়েছেন। শোনা যায়, তার ‘ম্যাচ অব দ্য ডে’র শেষ সাক্ষাৎকার যেটি লিভারপুল তারকা মোহামেদ সালাহকে নিয়ে হওয়ার কথা ছিল—বিবিসি বাতিল করেছে, যাতে গাজা প্রসঙ্গ না আসে। এরপর লিনেকার বিবিসি থেকে বিদায় নেন। কারণ? তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় জায়নবাদের সমালোচনা করেছিলেন।

পোস্ট নয়, সমস্যা ছিল—প্রাইমটাইমে ফিলিস্তিন নিয়ে কথা বলার সাহসে।

২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৩৭৫ জন ফুটবলার। সবমিলিয়ে মারা গেছেন ৭০০’র বেশি অ্যাথলেট। বোমায় গুঁড়িয়ে গেছে স্টেডিয়াম, মুছে গেছে জাতীয় ও যুব দলের প্রজন্ম।

একজন তরুণ ফুটবলারের কথা বলা যাক—লিভারপুলের ভক্ত, স্বপ্ন ছিল সালাহর মতো হয়ে ওঠা। এখন তার দুই পা নেই, এক বিমান হামলায়। মাঠের জীবন নয়, তাকে এখন লড়তে হচ্ছে বেঁচে থাকার জন্য।

ফিফা? নীরব। না কোনো শোকবার্তা, না শ্রদ্ধাঞ্জলি, না এক মিনিট নীরবতা।

এই নীরবতার পেছনে কেবল নিষ্ক্রিয়তা নয়, আছে এক পরিকল্পিত প্রতিক্রিয়া।

উদাহরণ? ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপে মিশরের খেলোয়াড় হুসেইন এল শাহাত ‘ফ্রি প্যালেস্টাইন’ লেখা ব্রেসলেট পরে মাঠে নামেন। পরের দিনই ফিফার প্রমোশনাল ছবি থেকে তাকে মুছে ফেলা হয়।

এই সময় ফিফার সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছিলেন এমন এক ব্যক্তি, যিনি ব্যক্তিগতভাবে ইসরায়েলি হামলার সময়ও ইসরায়েলকে সমর্থন করে পোস্ট দিয়েছিলেন। তিনিই একটি নারীবান্ধব ক্যাম্পেইনেরও সহ-প্রতিষ্ঠাতা। প্রশ্ন উঠলে তারা উত্তর দেয় না, বরং কমেন্ট সেকশন বন্ধ করে দেয়।

কিন্তু সমর্থকেরা চুপ নেই। যুক্তরাষ্ট্রে ফিফার ক্লাব বিশ্বকাপে, স্পেনের রায়ো ভায়েকানো, এসপানিওল, সেভিয়ার মাঠে ফিলিস্তিনের পতাকা আর কণ্ঠে প্রতিবাদ এখনও শোনা যাচ্ছে।

ফুটবল কর্তারা যত মুছে ফেলতে চান, ফিলিস্তিন তত দৃঢ় হয়ে ওঠে।

কিছুদিন আগে, ইসরায়েলি বাহিনী আল-মাওয়াসি এলাকায় এক বিমান হামলায় ফিলিস্তিনের জাতীয় দলের সাবেক গোলরক্ষক আবদুল্লাহ শাকফার স্ত্রীকে হত্যা করেছে। তিনি তখন একটি তাঁবুতে ছিলেন—যেখানে মানুষ আগের বোমা থেকে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছিল।

সেখানে কোনো সামরিক লক্ষ্য ছিল না। ছিল কেবল মানুষ আর তাদের বেঁচে থাকার লড়াই। এই মৃত্যু কোনো দুর্ঘটনা নয়—এটি ফিলিস্তিনকে মুছে দেওয়ার ধারাবাহিক চেষ্টার অংশ।

এটি যদি অন্য কোনো দেশের খেলোয়াড়ের পরিবারের ওপর ঘটত—তাহলে সারা ফুটবল বিশ্ব শোক জানাত, ক্লাব বিবৃতি দিত, অনুষ্ঠান বন্ধ হতো, ট্রিবিউট হতো।

ফুটবল যদি ন্যায়ের কথা বলে, তবে এভাবে চুপ থাকা চলে না।

এগুলো শুধু ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়—এগুলো স্বপ্ন ভাঙা, সমাজ ধ্বংস, এবং একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার রচনাপত্র।

যতদিন না ফুটবল এই প্রাণগুলোকে স্বীকৃতি দিতে শিখবে, ততদিন এর ‘বিউটিফুল গেম’ শব্দটাই একটা বড় ভণ্ডামি হয়ে থাকবে।

লেখক পরিচিতি: লায়লা হামেদ যুক্তরাজ্যভিত্তিক ফুটবল সাংবাদিক ও ক্রীড়া আইন বিশেষজ্ঞ। মরক্কো বংশোদ্ভূত এই লেখিকা জন্মেছেন স্পেনে। বর্তমানে তিনি জনপ্রিয় ক্রীড়া ম্যাগাজিন দ্য অ্যাথলেটিক–এ কাজ করছেন, যেখানে মূলত ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ নিয়ে লেখালেখি করেন। 'নিউ আরব'-এর মতামত বিভাগে তিনি এই লেখাটি লিখেছেন।

এমএইচএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।