ভারতের বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোয় বাংলাভাষী শ্রমিকদের হেনস্তা করা হচ্ছে। বাংলায় কথা বললেই ‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে আটক করা হচ্ছে।
বুধবার (১৬ জুলাই) কলকাতার বইপাড়া নামখ্যাত কলেজ স্কয়ার থেকে এসপ্ল্যানেডের টিপু সুলতান মসজিদ সংলগ্ন ডোরিনা ক্রসিং পর্যন্ত দুই কিলোমিটার পথ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে মিছিল করেন মুখ্যমন্ত্রী। তার সঙ্গে ছিলেন ভাতিজা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, মন্ত্রীরা, দলীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা। হাঁটেন মুসলিম ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মগুরুরাও।
মিছিল শেষে বক্তব্য রাখেন মুখ্যমন্ত্রী। শুরুতেই বলেন, ‘বিজেপি যে বাঙালি বিদ্বেষী, তা তারা বারবার প্রমাণ দিচ্ছে। ’
তিনি বলেন, ‘বেশ কিছুদিন ধরে আমি লক্ষ্য করছি ভারত সরকার ও বিজেপি পার্টির আচরণ। তাদের আচরণে আমি অত্যন্ত লজ্জিত, ব্যথিত, দুঃখিত, মর্মাহত। কিছুদিন আগে ভারত সরকার গোপনে একটি নোটিশ জারি করেছে এবং সেগুলি বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোকে পাঠিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট রাজ্যে কোনো বাংলাভাষীর ওপর সন্দেহ হলে তাকে তৎক্ষণাৎ গ্রেপ্তার করে ডিটেনশন ক্যাম্প বা হোল্ডিং এরিয়ায় রাখতে হবে। কেন? তাদের দিয়ে কাজ করাবেন আর বাংলা ভাষায় কথা বললেই জেলে নিয়ে যাবেন? কোন অধিকারে এসব করছেন আপনারা?’
ক্ষোভ প্রকাশ করে মমতা বলেন, ‘এটা তো দেখছি ভারতে আরেক ইমার্জেন্সি চলছে। ইন্দিরা গান্ধীর সময়ের ইমার্জেন্সি নিয়ে আপনারা গালাগালি দেন, অথচ আপনারা যা করছেন, তা ইমার্জেন্সির থেকেও ভয়ানক। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এখন থেকে আরও বেশি করে বাংলা ভাষায় কথা বলব। সাহস থাকলে আমাকে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠান। ’
তিনি আরও বলেন, ‘মলা মাছ যেমন বেছে নেওয়া হয়, তেমনভাবে মুসলিম বেছে এনআরসি করলেন আসামে। কিন্তু বাদ পড়েছেন ১২ লাখ হিন্দু। লজ্জা করে না আপনাদের? এখন বিজেপির নেতারা বলছেন, পশ্চিমবঙ্গ নাকি বাংলাদেশ হয়ে যাবে! বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, আর পশ্চিমবঙ্গ একটি ভারতীয় রাজ্য। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের বাঁচাতে গেলে বাংলাদেশি হতে হবে কেন? পশ্চিমবঙ্গ কি ভারতের অংশ নয়?’
মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, ‘বাংলার বাঙালিদের আপনারা গ্রেপ্তার করছেন। তারা ভারতীয় পরিচয়পত্র দেখালেও তাদের জেলে পাঠাচ্ছেন। তাদের অপরাধ কী? বাংলা ভাষায় কথা বলা? কতজনকে বাংলাদেশে পুশ-ইন করা হয়েছে, কতজন এখন জেলে? এসব প্রশ্নের উত্তর দিন আপনারা। আদালতে গিয়ে মামলা করতে হচ্ছে আমাদের। দিল্লিতে বাঙালিদের বস্তিতে পানি, বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দিয়েছেন। তাদের অন্ধকূপের মতো স্থানে রেখে দিয়েছেন। এভাবে দেশ চলতে পারে না। হিন্দু-মুসলিম দেখছেন আপনারা!’
মমতা বলেন, ‘ভারতে বাংলা ভাষায় একাধিক রাজ্যে কথা বলা হয়। তাহলে কি তারা সবাই বাংলাদেশি? ভারতে পাঞ্জাব আছে, পাকিস্তানেও আছে পাঞ্জাব—তাহলে কি এক ভাষায় কথা বললে ভারতীয় পাঞ্জাবিদেরও সন্দেহভাজন করা হবে? এটা কেমন যুক্তি?’
তিনি আরও জানান, ‘ভারতে ২২ লাখ বাংলাভাষী শ্রমিক কাজ করেন। পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে দেড় কোটির বেশি ভিনরাজ্যের শ্রমিক। আমি সবার প্রতি সম্মান দেখাই। কিন্তু আপনারা অপমান করছেন। মনে রাখবেন, এই বাংলা স্বাধীনতার জন্ম দিয়েছে, নবজাগরণের জন্ম দিয়েছে, এই বাংলাই রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বঙ্কিমের জন্মভূমি। সেই বাংলা আবার জেগে উঠবে। ’
তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘বাঙালিদের প্রতি এত রাগ কেন? তারা কী করেছে? যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাখি বন্ধনের উৎসব করেছিলেন, তার দুটি সৃষ্টি আজ ভারত ও বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। ১৯৭১ সালে বহু বাংলাদেশি ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তারা এখন নাগরিক—এই নাগরিকত্ব তো আপনারাই (কেন্দ্র সরকার) দিয়েছেন। তাহলে এখন কেন নির্যাতন করছেন? শুধুই রাজনীতির কারণে? লজ্জা করে না আপনাদের?’
তিনি বলেন, ‘বিজেপি এখন যাদের রোহিঙ্গা বা বাংলাদেশি বলছে, আমি চ্যালেঞ্জ করছি—তারা সবাই পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। বাংলাদেশিরা থাকে বাংলাদেশে, রোহিঙ্গারা থাকে মিয়ানমারে। সীমান্তে কারা নিয়োজিত? বিএসএফ। আর তারা কার অধীনে? কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের। তাহলে অনুপ্রবেশ যদি হয়, তার দায় কার? পশ্চিমবঙ্গের নয়। নির্বাচন এলেই এসব করা হয়!’
মমতা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘যদি বাংলার মানুষকে এভাবে ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখা হয়, তাহলে আসন্ন নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপিকে রাজনৈতিকভাবে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠাবে। বাঙালিকে দেখলেই বাংলাদেশি কিংবা রোহিঙ্গা বলার ফল ভালো হবে না। ’
তিনি বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে দেড় কোটি ভিন্ন ভাষাভাষী শ্রমিক রয়েছেন। তারা বিভিন্ন পেশায় কাজ করছেন। তাহলে কি আমাদের উচিত তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করা? আমি সতর্কবার্তা দিচ্ছি—আমরা মারবো না, কাটবো না। তবে এবারও যদি না থামেন, তাহলে কী করতে হবে, আমরা জানি। জবাব অবশ্যই দেব। ’
এদিকে, বিজেপির দাবি, ভোটের আগে বাঙালি সেন্টিমেন্টকে উসকে দিতে তৃণমূল কৌশলী। বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারীর অভিযোগ, ‘মমতাই আসলে বাঙালি বিদ্বেষী। ভিনরাজ্যে যাদের ধরা হচ্ছে, তাদের অনেকেই বাংলাদেশি কিংবা বাংলাদেশ থেকে আসা রোহিঙ্গা। তারা অবৈধভাবে বাংলায় এসে ভারতীয় নথি তৈরি করে ভিনরাজ্যে কাজ করছে। তাদের আটকাতে প্রশাসন কাজ করছে। এতে পশ্চিমবঙ্গের ভারতীয় বাঙালিদের কর্মক্ষেত্র পরিষ্কার হবে। ’
তিনি বলেন, ‘এদের জন্যই ভিনরাজ্যের বাসিন্দারা ভারতীয় বাঙালিদের সন্দেহের চোখে দেখে। আমরা চাই ভারত থেকে এদের বিদায় হোক—এতেই প্রকৃত বাঙালির মঙ্গল। মুখ্যমন্ত্রী এসব ঠেকিয়ে প্রমাণ করছেন, তিনি আসলেই বাঙালি বিদ্বেষী। ’ যদিও তিনি স্বীকার করেন, কিছু ভুল হতে পারে— ‘তবে সেটা অসম্ভব কিছু নয়। ’
এ বিষয়ে কলকাতার মেয়র ও মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেন, ‘দিল্লি, ওড়িশায় যতদিন অবিজেপি সরকার ছিল, ততদিন পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের সঙ্গে এমনটা হয়নি। এখন এসব রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় আসতেই বাঙালি বিদ্বেষ শুরু হয়েছে। এটা মেনে নেওয়া যায় না। ’
আগামী ১৮ জুলাই পশ্চিমবঙ্গে আসছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তার আগেই পথে নামলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বার্তা দিলেন—‘বিজেপি বাঙালি বিদ্বেষী’। সব মিলিয়ে বিধানসভা নির্বাচনের আগেই মুখোমুখি তৃণমূল ও বিজেপি।
ভিএস/আরএইচ