ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তথ্যপ্রযুক্তি

উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা

জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ নির্মাণে ‘ডিজিটাল সেন্টার’

শেখ তানজির আহমেদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৫
জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ নির্মাণে ‘ডিজিটাল সেন্টার’ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সাতক্ষীরা: ‘আগে চাকরির আবেদন করতে ট্রেজারি চালানের জন্য শ্যামনগর উপজেলা সদরে গিয়ে সোনালী ব্যাংকে বিশাল লাইনে দাঁড়াতে হতো। আবার সব কাগজপত্র দিয়ে চাকরির আবেদন করলেও অনেক সময় ডাকপিয়ন প্রবেশপত্র দিয়ে যেতো পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পর।

কিন্তু এখন অনলাইনে চাকরির আবেদন করতে পারায় যথাসময়ে প্রবেশপত্র পাই। আর ব্যাংকেও ট্রেজারি চালানের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না। এসএমএস’র মাধ্যমে টাকা দেওয়া যায়। আমাদের যাদের কম্পিউটার কেনার সামর্থ্য নেই তাদের ভরসা ডিজিটাল সেন্টার। ’ 
 
উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার সুন্দরবন সংলগ্ন শ্যামনগর উপজেলার কৈখালী ইউনিয়ন পরিষদে ব্যক্তিগত কাজে এসে এভাবেই ডিজিটাল সেন্টারের সুফল তুলে ধরেন ওই এলাকার আব্দুল জলিল গাজীর মেয়ে খুরশিদা খাতুন।  
 
মাস্টার্সের শিক্ষার্থী খুরশিদা খাতুন আরো বলেন, সরকারের সব দপ্তর যদি অনলাইনে চাকরির আবেদনের ব্যবস্থা করে তাহলে আর দুর্ভোগ থাকবে না। সম্প্রতি শুনেছি, সরকার চাকরির আবেদনে কাগজপত্র সত্যায়িত করে দিতে হবে না বলেও প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। আমরা সব ক্ষেত্রে অনলাইনে আবেদন করতে চাই। হতে চাই ডিজিটাল বাংলাদেশের যোগ্য নাগরিক।  
 
আগে অনেকে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বলে উপহাস করতো। কিন্তু এখন সুফল পেয়ে আর মুখ খোলে না, যোগ করেন তিনি।  
 
ঠিক একইভাবে জমির পর্চা উত্তোলনের আবেদন করতে এসে পশ্চিম কৈখালী গ্রামের আব্দুল হান্নান গাজী বলেন, আগে জমির পর্চা তুলতে ডিসি অফিসে মাসের পর মাস হাটা লাগতো, তাও হতো না। ডিজিটাল সেন্টার হওয়ার পর পর্চা তোলা কোনো ব্যাপারই না। অনলাইনে আবেদন করলে সাত দিনে, ইমারজেন্সি হলে চার দিনেই পর্চা পাওয়া যায়। আবেদনের প্রেক্ষিতে পর্চা প্রস্তুত হলে মোবাইলে ম্যাসেজ দিয়ে জানিয়ে দেয়, সংগ্রহের জন্য। আবার ডাকযোগে প্রেরণের ফি দিলে ডাকেও পাঠিয়ে দেয়, ডিসি অফিসে না গেলেও চলে।  
 
শুধু সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা নয়, গোটা দেশে প্রত্যেকটি ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপিত ডিজিটাল সেন্টার এভাবেই জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ নির্মাণের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষ পাচ্ছে প্রয়োজনীয় সব সেবা। ডিজিটাল সেন্টারের ওপর ভর করে ইউনিয়ন পরিষদ পরিণত হয়েছে কার্যকর ও জনবান্ধব প্রতিষ্ঠানে।  
 
ইউনিয়ন পরিষদের ডিজিটাল সেন্টার থেকেই স্থানীয়রা করতে পারছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি ও চাকরির আবেদন। পাচ্ছে অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন, স্কাইপে কথা বলা, ছবি তোলা, স্ক্যানিং, ই-মেইলিংসহ প্রয়োজনীয় সব সেবা। কোথাও কোথাও শুরু হয়েছে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কর্মসূচি।  

সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন করে জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ নির্মাণে সারাদেশের ন্যায় সাতক্ষীরা জেলার সাতটি উপজেলার ৭৮টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভায় ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। এসব সেন্টারে ১৬০ জন উদ্যোক্তা তৃণমূল মানুষকে দিচ্ছে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সেবা। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন সময়, খরচ ও দুর্ভোগ কমছে, তেমনি কমছে ঘুষ-দুর্নীতি।  
 
এছাড়া, ডিজিটাল বাংলাদেশের কার্যক্রম এগিয়ে নিতে জেলার সরকারি হাসপাতালগুলোতে চালু করা হয়েছে টেলি-মেডিসিন। দ্রুত টাকা আনা-নেওয়ার লক্ষ্যে প্রত্যেক ডাকঘরেই রয়েছে মোবাইল মানি অর্ডারের ব্যবস্থা। স্কুল-কলেজে শুরু হয়েছে ডিজিটাল কনটেন্টের মাধ্যমে শ্রেণি কার্যক্রম। জেলা ইনোভেশন সার্কেলের সদস্যরা সেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে নতুন নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবনে নিয়োজিত রয়েছে।   
 
অনলাইনে জেলার যেকোন স্থান থেকে আবেদন করলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে সাত দিনে, জরুরি ক্ষেত্রে চার দিনে সরবরাহ করা হচ্ছে জমির পর্চা। আবেদনের প্রেক্ষিতে জমির পর্চা প্রস্তুত হয়ে গেলেই মোবাইলে ম্যাসেজ পাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট আবেদনকারী। এক্ষেত্রে তৃণমূল মানুষের ‘আপন’ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার।  
 
সাতক্ষীরার সুন্দরবন সংলগ্ন শ্যামনগর উপজেলার কৈখালী ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার, তালা উপজেলার নগরঘাটা ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার, সদর উপজেলার লাবসা ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারসহ বেশ কয়েকটি ডিজিটাল সেন্টার ঘুরে দেখা গেছে, দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের কাজ। আগে যেখানে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় নিয়মিত খোলা নিয়ে প্রশ্ন উঠতো, এখন সেখানে গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষ হয়েছে ইউনিয়ন পরিষদমুখী। ডিজিটাল সেন্টারগুলোতে প্রয়োজন অনুযায়ী কাজ সম্পন্ন করতে আসেন সব বয়সী নারী-পুরুষ। তাই হোক সেটা চাকরি অথবা ভর্তির আবেদন কিংবা বিদেশে অবস্থানরত স্বজনদের সাথে স্কাইপে কথা বলার জন্য।     
 
জেলা প্রশাসকের কার্যালয় জানায়, সাতক্ষীরা জেলার ৮০টি ডিজিটাল সেন্টার থেকে ২০১৪ সালে ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৭৫৬ জন সেবা গ্রহণ করেছেন। ডিজিটাল সেন্টারগুলোতে ২০১৪ সালে আয় হয়েছে ৬৮ লাখ ৮৪ হাজার ৭৫২ টাকা।  
 
কৈখালী ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা ফারুক হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, আমরা সেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছি। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ জমির পর্চা তোলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাজে আসেন। চেষ্টা করি দ্রুততর সময়ে কাজ করে দেওয়ার জন্য।  
 
কাজ করতে কোন সমস্যা হচ্ছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিদ্যুত সংযোগ না থাকাই সবচেয়ে বড় সমস্যা। সৌর প্যানেল দিয়ে কাজ চালাতে হয়। অনেক সময় তা কাজে লাগে না। ফটোকপি মেশিন চলে না। এছাড়া, ইন্টারনেটের গতি খুব কম। কাজ করতে করতে নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।  
 
শুধু কৈখালী ইউনিয়ন পরিষদ নয়, উপকূলীয় ও সীমান্তবর্তী জেলা সাতক্ষীরার অনেক ইউনিয়নে ডিজিটাল সেন্টারের কাজ বিঘ্নিত হচ্ছে বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকা ও ইন্টারনেটের কম গতিজনিত সমস্যার কারণে। এছাড়া, কম্পিউটার স্বল্পতার কারণে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি শুরু করতে পারছে না অনেক ডিজিটাল সেন্টার।  
 
লাবসা ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা ইকবাল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ডিজিটাল সেন্টারগুলো থেকে সরকারি-বেসরকারি ৬০ প্রকার সেবা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে আমরা কাজ শুরু করেছিলাম। এর মধ্যে অধিকাংশ সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। তবে, এখনো আমাদের জেলায় বিদ্যুৎ বিল নেওয়ার কাজ শুরু হয়নি। এই সেবাটি কিভাবে দ্রুত চালু করা যায় সে বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান তিনি।  
 
ডিজিটাল বাংলাদেশের সাফল্য কামনা ও দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিপ্লব হয়েছে উল্লেখ করে সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের অর্নাস ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আসাদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, আগে প্রতিবছর অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তির সময় সব ক্যাম্পাসে দ্বন্দ্ব-সংঘাত লেগে থাকতো। কিন্তু এখন ডিজিটালি ভর্তির আবেদন গ্রহণ, ফল প্রকাশ ও ভর্তি ফরম পূরণ করায় ভর্তি প্রক্রিয়া রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়েছে। ভর্তি নিয়ে রাজনৈতিক লিডাররা আর প্রভাব খাটাতে পারে না।  
 
এ সময় সেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের পথে যেসব সমস্যা রয়েছে সেগুলো দ্রুত সমাধানের দাবি জানান তিনি।  
 
সাতক্ষীরার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ও জেলা ইনোভেশন টিমের প্রধান মহসীন আলী বাংলানিউজকে বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন স্বপ্ন নয়, বাস্তব। সর্বত্র তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ ঘটাতে বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধানে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।  
 
তিনি বলেন, বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে জেলার ৭৮টি ইউপিতে সৌর প্যানেল সরবরাহ করা হয়েছে। ৩৩২টি স্কুল-কলেজে ডিজিটাল কনটেন্টের মাধ্যমে ক্লাস নেওয়ার কার্যক্রম ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। জেলা ইনোভেশন সার্কেল থেকে এ পর্যন্ত ৬০টিরও বেশি ডিজিটাল উদ্ভাবনীর প্রস্তাবনা পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে।   
 
তিনি আশ্বাস দিয়ে বলেন, আগামী এক দেড় বছরের মধ্যে জেলার প্রত্যেকটি ইউপিতে অপটিক্যাল ফাইবার সংযুক্ত করার প্রচেষ্টা চলছে। এটা সম্ভব হলে ইন্টারনেট সংশ্লিষ্ট সমস্যা আর থাকবে না। আমাদের টার্গেট ছিল ভিশন ২০২১ বাস্তবায়নের মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন সম্ভব হবে। কিন্তু এখন বলব ২০১৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ডিজিটালাইজড হবে। জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের ভিত্তি হবে ডিজিটাল সেন্টার। এজন্য সকলের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।   
 
জেলার লাবসা ইউপি চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল আলীম বাংলানিউজকে বলেন, আমি রাজনীতির বাইরে থেকে বলতে চাই, সরকার মানুষের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেওয়ার যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তা সত্যিই ইতিবাচক। ইউনিয়নে ইউনিয়নে ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন করায় মানুষ ব্যাপক উপকৃত হচ্ছে। আগে মানুষ ইউনিয়ন পরিষদে আসতে চাইত না, কিন্তু এখন সব বয়সের মানুষ প্রয়োজন হলেই পরিষদে আসে।  
 
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মোস্তফা জব্বার বাংলানিউজকে বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশে অর্থনীতি থেকে মানুষের জীবনধারা হবে জ্ঞান ভিত্তিক। ইতোমধ্যে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে অনেক দূর এগিয়েছি। রাজধানী থেকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ইউনিয়ন পর্যায়েও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি গতিশীল হয়েছে বেসরকারি খাত। সরকারি খাত অগ্রসর হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এখনো সচেতনতা দরকার। আমরা তরুণ সমাজকে নিয়ে আশাবাদী। কারণ তরুণ সমাজই তথ্যপ্রযুক্তি ভিত্তিক সমাজ গঠনের প্রধান হাতিয়ার।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।