ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২০ ফাল্গুন ১৪৩১, ০৬ মার্চ ২০২৫, ০৫ রমজান ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

জেলেনস্কি এত সাহস কোথায় পান?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৪ ঘণ্টা, মার্চ ৫, ২০২৫
জেলেনস্কি এত সাহস কোথায় পান?

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভলোদিমির জেলেনস্কির মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে বেশ আগেই। তারপরও লম্বা সময় ধরেই দেশটিতে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা ছিলো না।

কিন্তু রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আলোচনা এবং যুক্তরাষ্ট্র আর ইউক্রেনের মধ্যে বাড়তে থাকা বিবাদের মতো সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো জেলেনস্কির ভবিষ্যত কী হবে সেই প্রশ্নটিকে জোরালো করে তুলেছে।

রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই এখন একমত যে, জেলেনস্কির বৈধতা ক্রমশ প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। কোনো বাধ্যতামূলক চুক্তি করার আগেই তাকে নির্বাচনের মুখোমুখি হতে হবে। রাশিয়ান এবং মার্কিন কর্মকর্তাদের প্রকাশ্য বিবৃতি ইঙ্গিত দেয় যে, যদি জেলেনস্কিকে নির্বাচনের পর পদ ছাড়তে হয়, তাহলে দুই পক্ষই তা স্বাগত জানাবে।

কিন্তু জেলেনস্কির সরে যাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ইউক্রেনের নেতৃত্ব ছাড়ার জন্য, তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্যে কমপক্ষে দুটির সৃষ্টি হতে হবে। প্রথমটি হলো, ইউক্রেনে যুদ্ধের মূলে যারা রয়েছে, সেই রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন অবশ্যই তাকে পদ ছাড়তে বলবে। দ্বিতীয়ত, ইউক্রেনের মূল রাজনৈতিক শক্তিগুলোর পক্ষ থেকে অবশ্যই তার পদত্যাগের জন্য চাপ আসতে হবে। তৃতীয় পরিস্থিতিটি হলো, জেলেনস্কিকেই পদ ছাড়ার কারণ খুঁজে পেতে হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে তিনটির একটিও পুরোপুরি দেখা দেয়নি।

যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া যুদ্ধবিরতি, নির্বাচন, শান্তি আলোচনা প্রক্রিয়া নিয়ে এক হয়েছে। দুইদেশের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক একটি ঐকমত্য তৈরি হচ্ছে। তবে, কোনোপক্ষই স্পষ্টভাবে এক হওয়ার কথা স্বীকার করেনি। কারণ, সম্ভবত আলোচনা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন কী করবে তা এখনও বোঝা যাচ্ছে না। ব্রাসেলস দৃঢ়ভাবে বলেছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান যাই হোক না কেন, ইউক্রেনকে সমর্থন করা উচিত। এটি জেলেনস্কিকে একটি বিকল্প শক্তি দেবে। এর মানে হল, জেলেনস্কি সরে যাক তা রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাইলেও, তিনি ক্ষমতায় থাকার ন্যায্যতা প্রমাণ করার জন্য এখনও ইউরোপের সমর্থনের ওপর নির্ভর করতে পারেন।

ইউক্রেনের জনগণ কি জেলেনস্কিকে চায়? জনসাধারণের মনোভাব সঠিকভাবে জানা কঠিন। যদিও জরিপগুলো বলছে যে, ২০২৩ সাল থেকে জেলেনস্কির অনুমোদনের রেটিং ক্রমাগত কমে যাচ্ছে। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং অন্যান্য পশ্চিমা সমালোচকদের সাম্প্রতিক আক্রমণগুলো তার প্রতি সমর্থনকে আবার বাড়াচ্ছে। এটি সত্য, নাকি তার প্রশাসনের তৈরি সংকটের প্রতিক্রিয়া, তা এখনও স্পষ্ট নয়। যুদ্ধের সময় করা জরিপে বিশ্বাস করা খুব কঠিন। ফলে ইউক্রেনীয় জনগণ সত্যিই জেলেনস্কির পদত্যাগ চায় কি না, তা বোঝা সহজ নয়।

ইউক্রেনীয় রাজনৈতিক বিরোধী দলও একমত নয়। শাসকগোষ্ঠীর অনেক ব্যক্তিত্ব জেলেনস্কির বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ। কিন্তু তার কর্তৃত্বকে কার্যকরভাবে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ইউক্রেনীয় সংসদ সম্প্রতি তাকে প্রথম প্রচেষ্টায় তার বৈধতা পুনর্ব্যক্ত করার জন্য একটি প্রস্তাব পাস করতে ব্যর্থ হয়েছে। এটি কোনো জোট বেঁধে অভ্যুত্থানের চেষ্টা নয়। বরং, এটি জেলেনস্কির বিরোধীদের ঐক্যের অভাবের প্রমাণ।

জেলেনস্কির বিরোধীদের এক করার জন্য কোনো ব্যক্তিত্ব এখনও পাওয়া যায়নি। সাবেক কমান্ডার-ইন-চিফ ভ্যালেরি জালুঝনিকে একসময় সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা হত। তিনি এখনও পর্যন্ত কোনো প্রকাশ্য রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেননি। তাকে ছাড়া, জেলেনস্কির বিরোধীরা গুরুতর চ্যালেঞ্জ তৈরির চেয়ে ছোটখাটো ঝামেলা বাধাতে বেশি আগ্রহী বলে মনে হয়।

জনপ্রিয়তা কমার পরেও, ইউক্রেনের ভেতরে জেলেনস্কির প্রভাবশালী মিত্র আছে। তার অভ্যন্তরীণ মহল, বিশেষ করে ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রপতি প্রশাসনের প্রধান আন্দ্রে ইয়েরমাক, স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষে। তাকে প্রায়শই ক্ষমতার পেছনের শক্তি হিসেবে দেখা হয়। জেলেনস্কির ঘনিষ্ঠ হয়ে তিনি নিজের ক্যারিয়ার গড়ে তুলেছেন। ইউক্রেনের নেতৃত্বে যেকোনো পরিবর্তন তার এবং তার সহযোগীদের প্রভাবকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। ফলে জেলেনস্কিকে পদে টিকিয়ে রাখার জন্য তারা লড়াই করবেন, সেই সম্ভাবনা আছে।

জেলেনস্কি কি স্বেচ্ছায় সরে যাবেন? না, তিনি সরছেন না। তিনি নিশ্চিতভাবে মনে করেন যে, তার নেতৃত্ব ইউক্রেনের টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য। আগাম নির্বাচন বা স্বেচ্ছায় পদত্যাগের যেকোনো পরামর্শ তিনি বারবার প্রত্যাখ্যান করেছেন। এই বিষয়ে তার বক্তব্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিভ্রান্তিকর। তিনি বলেন যে, ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করা হলেই তিনি পদত্যাগের কথা বিবেচনা করবেন। এটি একটি অসম্ভব শর্ত। এর অর্থ হল, তিনি যতদিন সম্ভব ক্ষমতায় থাকবেন।

জেলেনস্কি গদি আঁকড়ে থাকলেও, যুদ্ধক্ষেত্রে পরিস্থিতির পরিবর্তন তাকে সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য করতে পারে। ইউক্রেনের সামরিক পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত রয়েছে। দেশটির সম্পদের পরিমাণ কমছে। পশ্চিমা সমর্থন আর নিশ্চিত নয়। নতুন মার্কিন প্রশাসন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মতো ধৈর্য দেখাবে, সেই সম্ভাবনা কম।

যদি ইউক্রেন নিজে পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে জেলেনস্কির সামনে থাকা দুইট পথই কঠিন। হয় তাকে পরিস্থিতি বিপর্যয়কর হওয়ার আগেই নির্বাচন দিতে হবে। অথবা, নিজেদের ভবিষ্যত রক্ষা করতে মরিয়া ইউক্রেনীয় অভিজাতরা প্রাসাদ ষড়যন্ত্র করে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করবে। ইতিহাসে দেখা গেছে, যেসব নেতা সামরিক পরাজয় মেনে নিতে রাজি হন না, তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের কাছাকাছি পদমর্যাদার ব্যক্তিদের হাতে ক্ষমতাচ্যুত হন। যদি জেলেনস্কি গোঁ ধরে থাকেন, তাহলে তারও একই পরিণতি হতে পারে।

এদিকে কিয়েভে মার্কিন সামরিক সহায়তা বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আর এ খবরের পরই সুর নরম করেছেন জেলেনস্কি। ডোনাল্ড ট্রাম্পের শক্তিশালী নেতৃত্বে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন তিনি। অথচ কয়েকদিন আগেই হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে ট্রাম্পের সঙ্গে বাগবিতণ্ডার জড়িয়েছিলেন জেলেনস্কি।

হোয়াইট হাউসের বৈঠকে ওই বাগবিতণ্ডাকে ‘দুঃখজনক’ হিসেবে বর্ণনা করে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি এক পোস্টে বলেছেন, এখন সবকিছু ঠিকঠাক করার সময় এসেছে। আমরা চাই ভবিষ্যতে আমাদের সহযোগিতা ও যোগাযোগ গঠনমূলক হোক।

যুদ্ধের ইতি টানতে তার দেশে প্রস্তুত বলে জানান ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট। তিনি লেখেন, যুদ্ধ বন্ধে প্রথম ধাপ হতে পারে বন্দিদের মুক্তি দেওয়া। এর সঙ্গে আকাশে অস্ত্রবিরতি— ক্ষেপণাস্ত্র, দূরপাল্লার ড্রোন; বিদ্যুৎ ও জ্বালানি এবং অন্যান্য নাগরিক অবকাঠামোয় বোমা হামলা নিষিদ্ধ করা। পাশাপাশি সাগরে অস্ত্রবিরতি। তবে রাশিয়াকেও এসব মানতে হবে বলে শর্ত দেন জেলেনস্কি।

জেলেনস্কি লেখেন, ‘তারপর আমরা পরবর্তী সব ধাপে দ্রুত এগোতে চাই এবং একটি শক্তিশালী চূড়ান্ত চুক্তি করতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করতে চাই। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৫০৭ ঘণ্টা, মার্চ ০৫, ২০২৫
এসএএইচ 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।