ঢাকা, শুক্রবার, ২৫ আশ্বিন ১৪৩২, ১০ অক্টোবর ২০২৫, ১৭ রবিউস সানি ১৪৪৭

আন্তর্জাতিক

গাজায় যুদ্ধবিরতি: হামাস অস্ত্র সমর্পণে রাজি হবে?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২:৩৬, অক্টোবর ১০, ২০২৫
গাজায় যুদ্ধবিরতি: হামাস অস্ত্র সমর্পণে রাজি হবে?

গাজার ওপর ইসরায়েলি যুদ্ধের স্থায়ী সমাপ্তির পথে হামাসের নিরস্ত্রীকরণ ইস্যুটি হয়ে উঠতে পারে সবচেয়ে বড় অন্তরায়। যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রথম ধাপে ইসরায়েল ও হামাস সম্মত হলেও দুই পক্ষের মধ্যে এখনও বেশ কয়েকটি গুরুতর মতভেদ রয়ে গেছে, বিশেষত ফিলিস্তিনি সংগঠনটির অস্ত্রভাণ্ডার নিয়ে।

ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে, গাজার ওপর দুই বছরব্যাপী যুদ্ধের অবসান ঘটাতে হলে হামাসকে তার সব অস্ত্র সমর্পণ করতে হবে। পাশাপাশি, হামাসকে গাজার শাসনক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে এবং সংগঠন হিসেবে নিজেকে ভেঙে দিতে হবে।

অন্যদিকে, হামাস প্রকাশ্যে অস্ত্র সমর্পণের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংগঠনটি ব্যক্তিগত আলোচনায় তাদের কিছু অস্ত্র হস্তান্তরে আগ্রহ দেখিয়েছে।

ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস (ইসিএফআর)-এর ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ হিউ লাভাট আল জাজিরাকে বলেছেন, “নিরস্ত্রীকরণের ক্ষেত্রেই হামাসের অবস্থানে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন দেখা গেছে। হামাস কর্মকর্তারা মধ্যস্থতাকারীদের বলেছেন, তারা হামাসের ‘আক্রমণাত্মক অস্ত্রসমূহের’ একটি অংশ নিষ্ক্রিয় করার প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারেন। ”

অনিশ্চিত যুদ্ধবিরতি

বিশ্লেষকরা সতর্ক করছেন, হামাসের অস্ত্রভাণ্ডার নিয়ে আলোচনা ভেস্তে গেলে যুদ্ধবিরতি চুক্তিও ভেঙে যেতে পারে এবং ইসরায়েল আবারও গাজার দারিদ্র্যপীড়িত, দুর্দশাগ্রস্ত জনগণের ওপর তার গণহত্যা পুনরায় শুরু করতে পারে।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের আওতায় একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর দখলদার শক্তির বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ ও প্রতিরোধ করার অধিকার রয়েছে, যা মূলত যুদ্ধের সময় বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার উদ্দেশ্যে প্রণীত।

তবুও, ইসরায়েল ও তার পশ্চিমা মিত্ররা বরাবরই দাবি করে এসেছে যে, ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলোকে শান্তি প্রক্রিয়া শুরু করার আগে অস্ত্র ত্যাগ করতে হবে, যে প্রক্রিয়ার লক্ষ্য নাকি ইসরায়েলের ফিলিস্তিন দখলদারিত্বের অবসান ঘটানো।

এই কাঠামোটিই ছিল ১৯৯০-এর দশকের অসলো শান্তি চুক্তির ভিত্তি, যা তৎকালীন ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি নেতাদের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছিল।

ইসরায়েল এবারও একই দাবি তুলতে পারে, তবে হামাস সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণে রাজি হবে না বলে মনে করেন ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের (আইসিজি) গাজাভিত্তিক গবেষক আজমি কেশাওয়ি।

তিনি বলেন, হামাস হয়তো শুধু কিছু ‘আক্রমণাত্মক অস্ত্র’, যেমন স্বল্প ও দীর্ঘপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ত্যাগ করতে রাজি হতে পারে।

তবে তার বিশ্বাস, হামাস কখনোই তাদের ছোট আগ্নেয়াস্ত্র বা হালকা অস্ত্র দেবে না, আর ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য বহু বছর ধরে তৈরি করা জটিল সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্কের মানচিত্রও তারা কারও হাতে তুলে দেবে না।

কেশাওয়ি আল জাজিরাকে বলেন, ‘হামাস কেবল তখনই হালকা অস্ত্র ছাড়বে, যখন এগুলোর আর দরকার থাকবে না। অর্থাৎ, ইসরায়েলি দখলদারিত্ব শেষ করে যখন একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠিত হবে এবং সেই রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দায়িত্ব নেবে, তখনই তারা এসব অস্ত্র হস্তান্তর করবে। ’

ক্ষমতার শূন্যতা?

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের নেতৃত্বে ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে হামলার পর ইসরায়েল যখন গাজায় যুদ্ধ শুরু করে, তার আগে গাজার বেশ কয়েকটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে হামাস ছিল সবচেয়ে বড় সংগঠন।

এই গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে রয়েছে ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদ (পিআইজে), প্যালেস্টাইনের মুক্তির জন্য পপুলার ফ্রন্ট (পিএফএলপি) এবং আল-আকসা শহীদ ব্রিগেডস।

এই গোষ্ঠীগুলো বহুদিন ধরে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ চালিয়ে আসছে। তবে গত দুই বছরে ইসরায়েলের নিরবচ্ছিন্ন বোমা হামলায় তারা কতটা দুর্বল হয়েছে, তা এখনও স্পষ্ট নয়।

ইসরায়েল এই গণহত্যার সময় গাজার ভেতরে কিছু কুখ্যাত গ্যাং গোষ্ঠীকে সহায়তা করেছে, যারা গাজার মানুষের জন্য সীমিত যে সামান্য সহায়তা ঢুকতে পেরেছে, সেটি লুটপাট ও মুনাফার জন্য ব্যবহার করছে।

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিষয়ক বিশ্লেষক এবং গাজাভিত্তিক গবেষক তাগরিদ খোদারি আল জাজিরাকে জানান, গাজার অনেক ফিলিস্তিনি মনে করেন হামাসের কিছু সামরিক সক্ষমতা বজায় রাখা উচিত, যাতে এই গ্যাংগুলো ক্ষমতার শূন্যতা সৃষ্টি করে পরিস্থিতি নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে না পারে।

তিনি বলেন, ‘ইসরায়েল গ্যাং তৈরি করেছে, তাদের অস্ত্র দিয়েছে, যাতে তারা নিজেদের মানুষকেই (গাজায়) হত্যা করে। এখন ইসরায়েল হামাসকে উৎখাত করতে চায়, কিন্তু গাজার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বজায় রাখতে হামাসেরই প্রয়োজন। ’

তাগরিদ খোদারি জোর দিয়ে বলেন, ‘নিরাপত্তা রক্ষার ক্ষেত্রে হামাস খুবই দক্ষ। ’

ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস (ইসিএফআর)-এর হিউ লাভাটের মতে, হামাস সম্ভবত একটি অন্তর্বর্তী নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয়ে কাজ করতে রাজি হতে পারে, যারা অস্ত্রের আংশিক নিষ্ক্রিয়করণ তত্ত্বাবধান করবে।

তবে তিনি সতর্ক করেন, হামাস কেবল তখনই এমন সহযোগিতায় রাজি হবে, যদি সেই বাহিনীর ম্যান্ডেটে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে যে, তারা ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করবে না।

“আমি মনে করি পশ্চিমা দেশগুলোর কেউই সেই ‘সন্ত্রাসবিরোধী বাহিনী’-এর ভূমিকায় যেতে আগ্রহী নয়। আর হামাসের কাছেও এটি গ্রহণযোগ্য হবে না, কারণ এতে ওই আন্তর্জাতিক বাহিনী সরাসরি ইসরায়েলের স্বার্থে কাজ করছে বলে প্রমাণিত হবে,” লাভাট বলেন।

হামাস প্রতিরোধের প্রতীক

ইসরায়েল পুরো যুদ্ধকালজুড়ে দাবি করেছে যে তাদের লক্ষ্য হলো হামাসকে ধ্বংস করা। কিন্তু আইসিজি গবেষক কেশাওয়ি মনে করেন, হামাসকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করা সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, ‘আগামী বছরগুলোতে অসংখ্য নিঃস্ব ও প্রতিশোধপরায়ণ তরুণ হামাসে যোগ দেবে। অনেকের কাছে হামাস কেবল একটি সংগঠন নয়, বরং একটি চেতনা, প্রতিরোধের প্রতীক।

কেশাওয়ি আরও বলেন, ‘তারা এমন এক যুদ্ধ লড়েছে, যা কেউ কল্পনাও করেনি যে তারা লড়তে পারবে, যদিও এর মূল্য ছিল ভয়াবহ। ’

অন্যদিকে লাভাট বলেন, হামাস এখনও বাস্তববাদী অবস্থানে রয়েছে এবং যুদ্ধবিরতি যতদিন সম্ভব টিকিয়ে রাখতে কিছু ছাড় দিতে প্রস্তুত।

তিনি আরও বলেন, এই যুদ্ধবিরতির স্থায়িত্ব শেষ পর্যন্ত নির্ভর করছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং অন্যান্য পশ্চিমা নেতারা ইসরায়েল ও তার কঠোর দাবি-দাওয়া কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন তার ওপর।

লাভাট সতর্ক করে বলেন, ‘খুব বেশি ঝুঁকি রয়েছে যে ইসরায়েল পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে এই যুক্তিতে জয়ী হতে পারে যে, হামাসকে সম্পূর্ণভাবে নিরস্ত্রীকরণ করতে হবে (দখলদারিত্ব শেষ হওয়ার আগেই)। ’

তিনি আরও যোগ করেন, ‘যদি তা ঘটে, তবে এটি হবে পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য ইসরায়েলকে দায়মুক্তি দেওয়ার নতুন অজুহাত, যেমনটি ঘটেছিল অসলো চুক্তির পর। ’

সূত্র: কাতার ভিত্তিক সম্প্রচারমাধ্যম আল জাজিরার প্রতিবেদন

এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।