ঢাকা, শনিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩২, ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ২৭ শাওয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

কাশ্মীরে হামলা: নিরাপত্তা বাহিনী কেন ২০ মিনিট পর পৌঁছালো?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২১ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৫, ২০২৫
কাশ্মীরে হামলা: নিরাপত্তা বাহিনী কেন ২০ মিনিট পর পৌঁছালো? বৈসরনে এখন সেনা সদস্যদের ছড়াছড়ি, তবে হামলার সময়ে সেখানে নিরাপত্তারক্ষীরা ছিলেন না। ছবি: সংগৃহীত

কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে বন্দুকধারীদের গুলিতে ২৬ পর্যটকের নিহত হওয়ার ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীর নিরাপত্তা ব্যবস্থার গাফিলতি নিয়ে। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতা নিয়েও চলছে সমালোচনা।

 

দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সংবাদপত্রের এক প্রতিবেদনে প্রকাশ, পহেলগাওঁয়ে প্রায় ২০ মিনিট ধরে গুলি চালায় বন্দুকধারীরা। এতে ২৬ জন নিহত হন, অনেকেই আহত হয়ে মাটিতে পড়ে কাতরাতে থাকেন। মিশন সাকসেসফুল করে বন্দুকধারীরা পালিয়েও যায়। এরপর নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছায়।  ওই হামলায় বেঁচে যাওয়া একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় এ তথ্য উঠে এসেছে।

এ প্রতিবেদনের পর সামাজিক মাধ্যমে ক্ষোভ ঝাড়ছেন ভারতীয় নেটিজেনরা। একইসঙ্গে অনেকের প্রশ্ন, হামলার সময়ে নিরাপত্তা বাহিনী কোথায় ছিল? হামলাস্থলে বা তার খুব কাছাকাছি এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনীর থাকার কথা ছিল।

মহারাষ্ট্রের পুণের বাসিন্দা আশাবরী ভারতের সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে জানিয়েছেন, হামলার সময় তিনি তার বাবা-মা ও আত্মীয়দের সঙ্গে ছিলেন। ওই হামলায় তার বাবা ও এক আত্মীয় নিহত হয়েছেন।

আশাবরী বলেন, ‘আমাদের সাহায্য করার জন্য সেখানে কেউ ছিল না। যেসব খচ্চর-চালক আমাদের ওখানে নিয়ে গিয়েছিলেন, তারাই একমাত্র আমাদের সাহায্য করেছিলেন। ’

তিনি দাবি করেন, হামলার ২০ মিনিট পর নিরাপত্তা বাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছায়।  

কাশ্মীরের পথে প্রহরায় সেনা সদস্যরা।  ছবি: সংগৃহীত

ভারতীয় সেনাবাহিনীর শ্রীনগরভিত্তিক ১৫ কোরের সাবেক কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল কেজেএস ধিলোঁ (অব.) এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আপাতত আমি এটাই বলব, হ্যাঁ, কাশ্মীরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গতিশীল বা ডায়নামিক পদ্ধতিতে কাজ করে। সেটার নিয়মিত পর্যালোচনা করা হয়। সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট থেকে দেখেছি, বৈসরন উপত্যকায় নিরাপত্তা বাহিনীর কোনো উপস্থিতি ছিল না। যে এলাকায় এত পর্যটকের ভিড়, সেখানে নিরাপত্তা বাহিনী থাকা উচিত ছিল। ’

তবে এ হামলার বিষয়ে গোয়েন্দা তথ্য ছিল বলে দাবি করেন ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোতে বিশেষ পরিচালক হিসেবে কাজ করা সাবেক আইপিএস অফিসার যশোবর্ধন আজাদ।  

বিবিসিকে তিনি বলেন,  ‘আমরা যে তথ্য পেয়েছি, এই সন্ত্রাসবাদীদের সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য ছিল। তারপরও সন্ত্রাসীরা তারা তাদের কার্যসিদ্ধি করে ফেলতে পারল – এটা এমন একটা বিষয়, যার সঠিক বিশ্লেষণ করা দরকার এবং এর থেকে শিক্ষা নেওয়া দরকার। ’

তিনি বলেন, ‘এভাবে, এত বড় হামলা – তাও বিশেষ করে পর্যটকদের ওপরে! এটা আমরা কল্পনাই করিনি। আক্রমণের জন্য পহেলগাঁওকে বেছে নেওয়াও ছিল কৌশলগত সিদ্ধান্ত। ওই এলাকা তো শান্তিপূর্ণ ছিল। সেখানকার মানুষ পর্যটনের সঙ্গে এতটাই জড়িয়ে আছে যে তারা কখনোই এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করবে না। ’

হামলার ঘটনায় চরমপন্থিদের কোনো ধরনের স্থানীয় সমর্থন ছিল কি না প্রশ্ন তোলেন যশবর্ধন। বলেন, ‘আমাদের এটাও ভাবতে হবে যে, ওই চরমপন্থিদের কোনো ধরনের স্থানীয় সমর্থন ছিল কি না। তাহলে কি এটা গোয়েন্দা ব্যর্থতা? আপনি হয়তো বলতে পারেন, কিন্তু এটাও মনে রাখবেন যে একটি জায়গায় লাখ লাখ নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েন করা যেতে পারে, তা সত্ত্বেও কিছু ফাঁকফোকর থাকবেই। ’ 

এ হামলার দায় পাকিস্তানের ওপর চাপালেন এ সাবেক আইপিএস অফিসার। যশোবর্ধন আজাদের ব্যাখ্যা, ‘আমার মতে, এই হামলার পেছনে পাকিস্তানের হাত রয়েছে। এখন বিপুল সংখ্যক ভারতীয় ও বিদেশি পর্যটক কাশ্মীরে আসছেন। সেখানে ‘জি-টোয়েন্টি’-র মতো সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এত কিছুর পরেও আন্তর্জাতিকভাবে ভারতের ক্ষতি করার লক্ষ্যেই সরাসরি আক্রমণ চালানো হয়েছে। এই ধরনের চিন্তাভাবনা একমাত্র পাকিস্তানই করতে পারে। ’

দোষ যার ওপরই চাপানো হোক পর্যটকদের প্রাণ রক্ষায় ব্যর্থ ভারত সরকার - তা এ ঘটনার পর বলাবলি হচ্ছে। নিহতদের তালিকায় চোখ রাখলে দেখা যাবে, কাশ্মীর থেকে কেরালা, গুজরাট থেকে পশ্চিমবঙ্গ আর আসাম – বহু রাজ্যেরই মানুষের নাম আছে সেখানে। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত এসব পর্যটকদের নিরাপত্তা দিতে পারল না কাশ্মীরের স্থানীয় সরকার?

এমন প্রশ্ন, ঘটনার পর পরই রেখেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বুধবার রাতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, আমি ভেবে পাচ্ছি না, এতক্ষণ সময় লেগেছে, বেছে বেছে ওরা হত্যা করেছে। ওখানে তো অনেক আর্মি ছিল, সীমান্ত এলাকা তো এমনিতেই সেনসেটিভ। সেনা কেন সেখানে সঙ্গে সঙ্গে পৌঁছতে পারল না? এলাকাটি পাকিস্তান সীমান্তঘেঁষা। সেখানে কেন নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢিলেঢালা থাকবে? 

‘পর্যটকদের সুরক্ষায় দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে’

পর্যটকদের ওপরে এই হামলায় ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের সাধারণ মানুষের মতোই ক্ষেপে উঠেছেন কাশ্মীরিরাও। কারণ, এই পর্যটকরাই যে কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশের রুজি-রুটির অংশ। আর এ ঘটনার পর কাশ্মীরে উল্লেখজনক হারে পর্যটক কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

এ বিষয়ে সেনাবাহিনীর ডিরেক্টর জেনারেল অব মিলিটারি অপারেশনস (ডিজিএমও) ছিলেন এমন একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পহেলগাঁওয়ে হামলার পরে পর্যটন নিয়ে সরকারকে কিছু দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে।

তিনি বলেন, ‘পর্যটকরা বরাবরই সফট টার্গেট। যেহেতু আগে তাদের ওপর এ ধরনের কোনো হামলা হয়নি, তাই ধারণা করা হচ্ছিল ভবিষ্যতেও হামলা হবে না। আমরা প্রতি বছর অমরনাথ যাত্রা পরিচালনা করি – ওই এলাকাতেই। তাই আমি মনে করি, একইভাবে সরকারকেও পর্যটন নিয়ে ভাবতে হবে। পর্যটনের অনুমতি দেওয়া হোক, তবে নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে। নিরাপত্তা বাহিনী যেসব জায়গায় তল্লাশি চালিয়েছে শুধু সেইসব জায়গায় পর্যটকদের যেতে দেওয়া যেতে পারে। ’

'পর্যটকরাই আমাদের প্রাণ' - এই পোস্টার নিয়ে কাশ্মীরীদের মিছিলে সামিল এই শিশুকন্যাও

অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ধিলোঁ বলেন, ‘বিপুল সংখ্যক পর্যটক, প্রত্যেকের ওপর নজর রাখা নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষে সত্যিই কঠিন। দেশি-বিদেশি পর্যটক ছাড়াও স্থানীয়রাও এসব জায়গায় ভিড় করেন। যেমন টুরিস্ট গাইড, অস্থায়ী হোটেল ও রেস্তোরাঁকর্মীরা, ট্যাক্সিচালক এবং ঘোড়াচালকরা। দুই-তিন জন সন্ত্রাসীর পক্ষে এরকম একটা ভিড়ের মধ্যে মিশে যাওয়া বা ধরা না পড়া খুবই সহজ। ’

ইনস্টিটিউট ফর কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্টের নির্বাহী পরিচালক অজয় সাহনি বলেন, ‘সাময়িকভাবে হলেও এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না করা হলে পর্যটকদের মধ্যে যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে তা জম্মু-কাশ্মীরের পর্যটনকে ধ্বংস করে দিতে পারে। ’

জম্মু-কাশ্মীর থেকে ২০১৯ সালে ৩৭০ ধারা অপসারণের পর থেকে পর্যটনসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করতে সরকার উৎসাহিত করেছে। এসব বিষয়ে সরকারের অবস্থান বদলাবে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

এদিকে কাশ্মীর ইস্যুতে গোয়েন্দা ব্যর্থতার বিষয়টি স্বীকার করেছে মোদী সরকার। বৃহস্পতিবার দেশটির জাতীয় সংসদ ভবনে এক বৈঠকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন, ‘যদি ভুল না হয়ে থাকে, তা হলে আমরা এখানে বসে আছি কেন? কোথাও না কোথাও ব্যর্থতা রয়েছে, তা খুঁজে বের করতে হবে। ’

সংসদীয় মন্ত্রী কিরেন রিজিজুর জানান, এদিনের বৈঠকে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগ ও সরকারের শীর্ষ কর্তারা সংসদের সদস্যদের বিস্তারিত জানিয়েছেন। কোথায় ত্রুটি হয়েছিল এবং কী পরিস্থিতিতে এই হামলা ঘটেছে তা জানানো হয়েছে। গোটা দেশ এই কঠিন সময়ে একজোট রয়েছে।  

বিবিসি অবলম্বনে

বাংলাদেশ সময়: ১৬১৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৫, ২০২৫
এসএএইচ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।