পাকিস্তানের সীমান্ত সংলগ্ন কয়েকটি এলাকায় ভারতের হামলার পর ইসলামাবাদ দাবি করেছে, তারা ভারতের দুটি রাফাল, একটি সু-৩০ এবং একটি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। মঙ্গলবার (৬ মে) মধ্যরাতে ভারত ওই হামলা চালানোর সময় যুদ্ধবিমানগুলো ধ্বংস করা হয় বলে দাবি করেছে পাকিস্তান।
এ দাবিটি আন্তর্জাতিক সামরিক বিশেষজ্ঞদেরও নজর এসেছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নির্ভর ভারত, পাকিস্তান ও চীনের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষণ সংক্রান্ত গ্রুপগুলো বিষয়টি নিয়ে বেশ আগ্রহ দেখাচ্ছে।
রাফাল একটি চতুর্থ-প্রজন্মের আধুনিক মাল্টিরোল যুদ্ধবিমান। এটি স্থল, আকাশ ও নৌপথে বিভিন্ন ধরনের অভিযানে সক্ষম। শব্দের চেয়ে ১.৮ গুণ বেশি গতিতে উড়ে যেতে সক্ষম ৯.৫ টন ওজনের এই যুদ্ধবিমানের রয়েছে সর্বাধুনিক ইলেকট্রনিক জ্যামিং ও আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা।
ভারতীয় বিমান বাহিনীর ‘গোল্ডেন অ্যারো’ স্কোয়াড্রনে যুক্ত রয়েছে ৩৬টি রাফাল জেট। ২০১৬ সালে যা কিনতে প্রায় ৭.৮৭ বিলিয়ন ইউরো ব্যয় করে ভারত। এই হিসাবে প্রতিটি জেটের দাম পড়েছে ২১৫.৫৬ মিলিয়ন ইউরো।
রাফাল যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার প্রথম দাবিটি করা হয় ওপরের ছবিটি দেখিয়ে। এটি ভারতশাসিত কাশ্মীরের পাওয়া যাওয়া রাফালের ধ্বংসাবশেষ বলে দাবি করা হয়। পরে এটি একটি ড্রপ ট্যাংক বলে নিশ্চিত হওয়া যায়।
ড্রপ ট্যাংক হল যুদ্ধবিমানে অতিরিক্ত জ্বালানি বহনের স্টোরেজ ট্যাংক, যা যুদ্ধবিমানকে অতিরিক্ত সময় ওড়ার ক্ষমতা দেয়। খালি হলে বিমানের ওজন কমাতে এই ট্যাংক গুলো ইচ্ছাকৃত ভাবেই ফেলে দেওয়া হয়। কাশ্মীরে পাওয়া ড্রপ ট্যাংকের ছবি দেখে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে এটি ফরাসি যুদ্ধবিমান মিরাজ-২০০০ অথবা রাফালের ব্যবহৃত ড্রপ ট্যাংক।
এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠেছে, ড্রপ ট্যাংকগুলো যদি ইচ্ছেকৃতভাবেই ফেলে দেওয়া হয় তাহলে যুদ্ধবিমান ভূপাতিতের দাবি করা হচ্ছে কেন। এর কারণ কাশ্মীরে একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়েছে এবং এলাকাটি ভারতীয় সেনারা ঘিরে রেখেছে।
তাছাড়া পাকিস্তানি ডিফেন্স এন্থুজিয়াস্টদের দাবি, যে অবস্থায় ড্রপ ট্যাংকটি পাওয়া গেছে তা শুধু মিসাইল ইমপ্যাক্টেই এমন হওয়া সম্ভব। স্বাভাবিক পতনে ড্রপ ট্যাংকগুলো অনেকটা অক্ষতই থাকে।
আর যেহেতু এই ড্রপ ট্যাংক রাফালে ব্যবহৃত হয়, তাই কাশ্মীরের পাম্পোর অঞ্চলে বিধ্বস্ত যুদ্ধবিমানটি রাফাল বলে দাবি করছেন তারা।
তবে ওপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ওই যুদ্ধবিমানটির সামনের অংশ বা ‘নোস কোন’ রাফালের সঙ্গে নয়, মিলছে ভারতীয় বিমান বাহিনীর বহরে থাকা মিরাজ-২০০০ সঙ্গে। যে যুদ্ধবিমানগুলোও একই ড্রপ ট্যাংক ব্যবহার করে।
রাফাল ভূপাতিত করার পাকিস্তানি দাবিটি ওপরের যুক্তিতেই উড়িয়ে দেওয়া যেত, তবে বাদ সেধেছে পাঞ্জাবে ভূপাতিত আরেকটি যুদ্ধবিমান।
ভারতের পাঞ্জাবে বিধ্বস্ত ওই যুদ্ধবিমানের ধ্বংসাবশেষের ভিডিও-ছবি বিশ্লেষণ করে ডিফেন্স এন্থুজিয়াস্টরা এটি যে রাফাল নয় তা জোর দিয়ে বলতে পারছেন না। নিচের ছবিতে দেখা যাচ্ছে বিধ্বস্ত ওই যুদ্ধবিমানের ইঞ্জিন নজেল আর রাফালের ইঞ্জিন নজেল দেখতে একই।
তাছাড়া রাফাল ব্যবহৃত হয় স্নেকমা এম৮৮-৪ই ইঞ্জিন আর মিরাজ-২০০০ ব্যবহার করে স্নেকমা এম৩৩-পি২ ইঞ্জিন, যাদের নজেল ব্যবস্থা সম্পূর্ণ আলাদা। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে ভারত তাদের মিরাজ-২০০০ জেটগুলোকে এম৮৮-৪ই ইঞ্জিন ব্যবহারের উপযোগী করে আপগ্রেড করেছে বলেও তেমন কোনো খবর নেই। তাই পাকিস্তান ও চীনের ডিফেন্স এন্থুজিয়াস্টদের দাবি, পাঞ্জাবে বিধ্বস্ত যুদ্ধবিমানটি নিশ্চিতভাবেই রাফাল।
এই পর্যায়ে আলোচিত হচ্ছে, এত উন্নত প্রযুক্তির যুদ্ধবিমান যার কারণে ফ্রান্স ন্যাটোর এফ-৩৫ প্রকল্প থেকে সরে আসার ঝুঁকি নিতে পেরেছে তাকে পাকিস্তান ঘায়েল করলো কীভাবে? কোন সমরাস্ত্রে?
সেই উত্তরও পাওয়া যাচ্ছে পাকিস্তান ও চীনের ডিফেন্স এন্থুজিয়াস্টদের কাছ থেকে। তাদের দাবি, রাফাল শিকারে পাকিস্তান ব্যবহার করছে চীনের তৈরি আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য পিএল-১৫ ক্ষেপণাস্ত্র।
নিচের ছবিতে ভারতীয় পুলিশ যে মিসাইলের ধ্বংসাবশেষটি পরীক্ষা করছে তা পিএল-১৫ ক্ষেপণাস্ত্রের বলে নিশ্চিত করছে এই ইস্যুতে নিরপেক্ষ ডিফেন্স এন্থুজিয়াস্টরা।
পিএল-১৫ হলো চীনে উৎপাদিত বিয়ন্ড-ভিজ্যুয়াল-রেঞ্জ বা দৃষ্টিসীমার বাইরে নিক্ষেপযোগ্য এয়ার-টু-এয়ার ক্ষেপণাস্ত্র। যা উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন শত্রু জেট ধ্বংসের জন্য তৈরি করা হয়েছে। এটি বর্তমানে পাকিস্তানের বহরে থাকা জে-১০সি এবং জেএফ-১৭ ব্লক-থ্রি যুদ্ধবিমানেও সংযুক্ত করা হয়েছে।
তবে পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, এই রকম উত্তেজনাকর পরিস্থিতে কোনো পক্ষই সামরিক ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত চিত্র প্রকাশ করে না। অর্থাৎ কোনো পক্ষের দাবিই পুরোপুরি সত্য বলা যাচ্ছে না, আবার কোনো পক্ষের দাবিই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
অবশ্য ভারতের পরবর্তী রাফাল ক্রয়াদেশ থেকে বিষয়টি নিয়ে কিছুটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে। সপ্তাহখানেক আগে ভারত আরও ২৬ রাফাল কেনার চুক্তি করেছে, যা ৩৭ মাসের মধ্যে ডেলিভারি পাওয়া কথা।
এদিকে রাফালে ভূপাতিত করার দাবি ছড়ানোর পর ফরাসি যুদ্ধবিমান প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ডাসাল্ট অ্যাভিয়েশন-এর শেয়ারবাজারে বড়সড় ধাক্কা লেগেছে। পাকিস্তানি সামা টিভি বলছে, বুধবার কোম্পানিটির শেয়ারের দাম কমে গেছে ৬ শতাংশ, যা সাম্প্রতিক সময়ে অন্যতম বড় পতন। পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর হাতে রাফাল হারানোই এই ধসের প্রধান কারণ দাবি করছে পাকিস্তান।
এমএম