ঢাকা: জলবায়ুর অপ্রত্যাশিত পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ। পরিবেশ বিপর্যয়ের সুদূরপ্রসারী বিরূপ প্রভাবেরও বেশি শিকার হতে হবে দক্ষিণ-এশিয়ার বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী এ দেশকে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর বিশেষ এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রভাবশালী সংবাদ মাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস।
সংবাদ মাধ্যমটির শুক্রবারের অনলাইন সংস্করণের একেবারে শীর্ষ খবর হিসেবে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সম্ভাব্য পরিণতি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
সম্প্রতি জাপানি শহর ইয়োকোহামায় পরিবেশ বিজ্ঞানীদের বৈঠকের আলোচনার উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বিশ্বব্যাপী তিন ফুট বৃদ্ধি পেতে পারে। এর সঙ্গে উষ্ণ আবহাওয়ার কারণে বৈশ্বিক পরিবেশে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে পারে।
জলবায়ু বিজ্ঞানীরা বলছেন, অনিয়ন্ত্রিত কার্বন ও বর্জ্য নিঃসরণের কারণেই বিশ্বকে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পড়তে হবে।
পরিবেশের বিপর্যয়ের জন্য বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলো খুব কম দায়ী হলেও তাদেরকেই ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে হবে বেশি। অথচ সম্ভাব্য বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঠেকাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বলা হলে দায়ী উন্নত রাষ্ট্রগুলো কোনো কথাই কানে তুলছে না। একইসঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবিও মানছে না।
প্রতিবেদনে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির পরিণতি উল্লেখ করে বলা হয়, মালদ্বীপ, কিরিবাতি ও ফিজির মতো সাগরবুকের দেশগুলো তাদের অনেকাংশ ভূমিই হারিয়ে ফেলবে। সমুদ্রোপকূলবর্তী অঞ্চল তলিয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের লাখো মানুষ বাস্তহারা হয়ে পড়বে।
প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটির স্কুল অব পাবলিক অ্যান্ড এনভারনমেন্টাল অ্যাফেয়ার্স বিভাগের অধ্যাপক রাফায়েল রুভেনির উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধিতে বিশ্বের অনেক ভূখণ্ডই তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। তবে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির সব তালিকায়ই শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। যদিও পরিণতি ভেবেও এ ব্যাপারে চরম উদাসীনতা দেখাচ্ছে বিশ্ব সম্প্রদায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কেবল নিজেদের করুণ পরিণতির কথা ভেবেই উন্নয়নশীল দেশগুলোর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ছে। শুধু সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধিই নয়, ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রাও উন্নয়নশীল জাতিগুলোর ভয়ের কারণ।
সম্প্রতি পোল্যান্ডের ওয়ারশ’তে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি মোকাবেলায় পদক্ষেপ নিতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানায় বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলো। অনেক বিশ্বনেতা দায়ী উন্নত দেশগুলোর কাছে ক্ষতিপূরণও দাবি করেন। এছাড়া, জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের শরণার্থীদের জন্য উন্নত দেশগুলোর সীমান্ত খুলে দেওয়ারও দাবি ওঠে সম্মেলনে।
বাংলাদেশের শীর্ষ জলবায়ু বিজ্ঞানী ও সেন্টার ফর অ্যাডভান্স স্টাডিজের (বিসিএএস) নির্বাহী পরিচালক ড. আতিক রহমান বলেন, এটা বৈশ্বিক ন্যায়বিচারের প্রশ্ন। যেসব রাষ্ট্র গ্যাস নিঃসরণ করে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীকে শরণার্থী হতে বাধ্য করছে, তাদেরই উচিত দুর্দশাগ্রস্তদের আশ্রয় দেওয়া। আশ্রয় পাওয়া শরণার্থীদের অধিকারও।
জলবায়ু বিজ্ঞানীদের উদ্ধৃতি দিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধিতে সম্ভাব্য অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতি এড়াতে শক্ত ও উচ্চ বেড়িবাঁধ দিলেও উন্নত শহর লন্ডন, ভেনিস কিংবা নিউ অর্লিনসকেও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি হতে পারে। তবে, বাংলাদেশসহ জনবহুল উন্নয়নশীল দেশগুলোকে নিশ্চিতভাবে চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে।
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের সামান্যতম দায় বাংলাদেশও দায় এড়াতে পারে না। নিজেরাই নিজেদের নদীগুলো দূষিত করে এখন ভূ-গর্ভের পানির প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের উপকূলীয় শহরগুলো যেমন তলিয়ে যাওয়ার হুমকিতে পড়েছে, তেমনি বাড়ছে বন্যার ঝুঁকিও। আর কোনো রকমে নির্মিত বেড়িবাঁধও সম্ভাব্য বিপর্যয় মোকাবেলায় অপ্রতুল।
ড. আতিক রহমান জানান, সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধিতে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের ১৭ শতাংশ ভূমি প্লাবিত হয়ে যাবে এবং ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ বাস্তুহারা হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে দেশের জলবায়ু বিজ্ঞানী ও রাজনীতিকরা একমত।
বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের উদ্ধৃতি দিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের বেড়িবাঁধের বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আরও কিছু কারণে লোকজন উপকূল থেকে সরে যাচ্ছে বলেই বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে দ্রুত নগরায়ন বাড়ছে।
ড. আতিক বলেন, বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় এমন পদক্ষেপ নেওয়া হলেও চিন্তার ব্যাপার হলো নদীমাতৃক দেশটিতে ঘনঘন জোয়ারের প্লাবন।
এ জলবায়ু বিজ্ঞানী জানান, এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বঙ্গোপসাগর তীর থেকে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ রাজধানী ঢাকায় চলে এসেছেন। এরা এখন বস্তিতে বসবাস করছেন। তবে তাদের বেশিরভাগেরই বাস নগরীর দূষিত নদীর তীরে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট বিষয়ের গবেষক ইংল্যান্ডের নিউক্যাশেল ইউনিভার্সিটির কোস্টাল সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. জন পেথিক বলেন, সম্ভাব্য পরিণতি চিন্তা করে বাংলাদেশের প্রশাসন ইতোমধ্যে বেশি কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। এর মধ্যে নদী খনন, বেড়িবাঁধ নির্মাণ, জলাবদ্ধতা নিরসনসহ বেশকিছু কর্মসূচি উল্লেখযোগ্য।
পেথিক জানান, এমন প্রস্তুতিতেও সার্বিক দুর্যোগের সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে বাংলাদেশ। কারণ অক্টোবরে প্রকাশিত গত ১০ বছরে দেশটির নদীগুলোর জোয়ারের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, বিশ্বের অন্য অঞ্চলের জোয়ারের চেয়ে ১০ গুণ বেশি জোয়ার আসে বাংলাদেশের নদীগুলোতে। যে কারণে, সমুদ্রের উচ্চতাবৃদ্ধির অভিশাপ থেকে বাঁচা গেলেও বিকল্প দুঃশ্চিন্তার নাম জোয়ার।
পেথিক হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, গবেষণা বলছে, ২১০০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উপকূলে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে ১৩ ফুট। অর্থাৎ বিশ্বের অন্য অঞ্চলের চেয়ে প্রায় ৪ গুণ বেশি সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে এখানে। বাংলাদেশের মোট ভূ-খণ্ডের প্রায় ১ এক চতুর্থাংশেরই বর্তমান অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭ ফুট উঁচুতে। ২১০০ সাল নাগাদ যদি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১৩ ফুট বৃদ্ধি পায়, তাহলে এ অঞ্চলের অবস্থা কী দাঁড়াবে সেটা এখনই ভাবা দরকার।
জলবায়ু গবেষক পেথিক বলেন, এ সমীক্ষার প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের নীতি-নির্ধারকসহ অনেকে আমাকে বলেছেন যে, আমি খুব ভুল বলছি। কিন্তু এটা আসলেই বোঝাবার মতো নয়। তবে, উদ্বেগের ব্যাপার হলো এই সমীক্ষাকে উড়িয়ে দেওয়ারে অর্থ হলো তারা এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত নন।
পেথিকের গবেষণা-তথ্যের সঙ্গে অমত নন জানিয়ে ড. আতিক রহমান বলেন, ভিন্ন বক্তব্যও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সির রুটজার্স ইউনিভার্সিটির রুটজার্স এনার্জি ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক রবার্ট ই. কপ ভারতের কলকাতা ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে সমীক্ষা চালিয়ে জানিয়েছেন, এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা ৫ থেকে ৬ ফুট বাড়তে পারে এ অঞ্চলে।
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, এতো বড় সম্ভাব্য বিপর্যয় মোকাবেলায় একটি মাত্র সরকারের সর্বোচ্চ প্রস্তুতি পর্যাপ্ত নয় বলে স্বীকার করছেন বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তারাও। তারা আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সমাধান চান। তারা বলছেন, যদি বৈশ্বিকভাবে সমাধান না হয়, তাহলে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী বিশ্বের অন্যতম সমস্যায় পরিণত হবে।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সরকারের একজন কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, এভাবে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা ২০৫০ সাল পর্যন্ত বাড়তে থাকলে বাংলাদেশের ৫ কোটি মানুষ দেশত্যাগ করতে বাধ্য হবে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, হিমালয়ের নিম্নাঞ্চল ও বঙ্গোপসাগরের সম্মুখের দেশ বাংলাদেশের আবহাওয়ারও স্থিতিশীলতা নেই। এই ভীষণ শীততো, এই খরা, আবার এই নামে বন্যা।
অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশেও তাপমাত্রা বাড়বে, আর সেটা বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি করবে। একইসঙ্গে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধি পুরো দুর্যোগের দেশে পরিণত করবে বাংলাদেশকে।
তবে, নিজেদের জনগণকে বাঁচাতে বাংলাদেশ অনেক করছে উল্লেখ করে মার্কিন সংবাদ মাধ্যমটিতে বলা হয়, দুর্যোগের পূর্বাভাস ব্যবস্থা চালুর পাশাপাশি এরইমধ্যে ইট দিয়ে ২৫শ’ সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করা হয়েছে। এর ফল হিসেবে দেখা যাচ্ছে, ১৯৭০ সালে যেখানে ঘূর্ণিঝড়ে (ভোলা) ৫ লাখ ৫০ হাজার মানুষ মারা গেছে, সেখানে ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড়ে (আইলা) মারা গেছে ৩০০ মানুষ।
ড. আতিক রহমান ও জন পেথিকসহ জলবায়ু বিজ্ঞানীরা মনে করেন, সম্ভাব্য বিপর্যয় মোকাবেলায় বাংলাদেশসহ উন্নত রাষ্ট্রগুলো পেরে উঠবে না। এজন্য উন্নত রাষ্ট্রগুলোকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি কার্বন ও বর্জ্য নিঃসরণের ব্যাপারে চুক্তিকে পৌঁছাতে হবে। নতুবা বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল তলিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি মানবতাও তলিয়ে যেতে পারে সমুদ্রবুকে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯১৬ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০১৪