জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের স্মরণীয় আগস্ট প্রেসিডেন্সির ইতিহাস রয়েছে। ২০১১ সালে ভারতের প্রেসিডেন্সির সময় লিবিয়ার ঘটনা একটি কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছিল।
মোদি বিশ্বের কাছে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন এবং একটি নতুন বহুপাক্ষিকতায় প্রতিনিধিত্বহীনদের ‘কণ্ঠ’ হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতিত্ব করা ও অধিবেশন ডাকা ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। তাও আবার বৈশ্বিক উদ্বেগের একটি জরুরি বিষয়- সমুদ্র নিরাপত্তা নিয়ে তিনি পুরো বিশ্বকে একত্রিত করেন।
ভারতীয় প্রেসিডেন্সি এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ (১৪)টি প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। আফগানিস্তান, সোমালিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, মালি এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রম, পশ্চিম আফ্রিকা এবং সুদানসহ আরও চারটি দেশের পরিস্থিতি নিয়ে প্রেসিডেন্সি বিবৃতি (পিআরএসটি) দিয়েছে দেশটি। এর মধ্যে পাঁচটি পূর্ণাঙ্গ রেজুলেশন এবং পাঁচটি প্রেস বিবৃতি রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি কাবুল বিমানবন্দরে সন্ত্রাসী হামলাসহ আফগানিস্তানের চলমান ঘটনা নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ভারত একটি নতুন আন্তর্জাতিক ঐক্যমত গড়ে তোলার জন্য এবং সমুদ্রের নিয়মগুলি আপডেট করার জন্য সামুদ্রিক নিরাপত্তা, শান্তিরক্ষা এবং সন্ত্রাস দমনের তিনটি সম্ভাব্যতা স্বাক্ষরের বিষয় নিয়ে অনুষ্ঠান আয়োজন করে। আগস্টের এ অধিবেশনের উদ্দেশ্য ছিল সামুদ্রিক নিরাপত্তা নিয়ে একটি সামগ্রিক ধারণা দেওয়া। এতে ইউএনসিএলওএস-এর ভূমিকা, নৌ-চলাচলের স্বাধীনতা, দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের পেশী-শক্তি বাড়ানের মতো সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। একটি নতুন আন্তর্জাতিক সমুদ্র নিরাপত্তা আদেশের ক্ষেত্রে অবদান রাখার ফলে ভারতীয় নিরাপত্তা স্বার্থ আরো উন্নত হয়েছে।
"সুরক্ষাকারীদের সুরক্ষা: প্রযুক্তি এবং শান্তিরক্ষা" বিষয়ক ইভেন্টের ফলে শান্তিরক্ষীদের বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য জবাবদিহিতা এবং শান্তিরক্ষীদের প্রযুক্তি উন্নয়নে প্রথম পিআরএসটি হয়েছে। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী "সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে সৃষ্ট আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি", ক্রমাগত সন্ত্রাসী হুমকি ও আক্রমণের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কনভেনশনের প্রাথমিক সমাপ্তি এবং ভারতের আট দফা কর্মপরিকল্পনার ওপর হওয়া একটি অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন। জাতিসংঘের বৈশ্বিক কাউন্টার টেরোরিজম স্ট্র্যাটেজিকে আরো শক্তিশালী করার জন্য এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
ভারতের পরামর্শে মিয়ানমার, মালি এবং সোমালিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, ইথিওপিয়া, হাইতি এবং ডিপিআরকের মতো ইস্যুতে শক্তি মোতায়েন করা হয়েছিল। তবে দেশটির কূটনৈতিক দক্ষতা এবং এর দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতার সর্বচ্চ পরীক্ষা হয়েছে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মাধ্যমে।
উল্লেখযোগ্যভাবে, আগস্টে গৃহীত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ২৫৯৩-এর প্রস্তাবটি তালেবান শাসিত আফগানিস্তানকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আশ্রয়স্থল এবং প্রতিবেশী দেশ এবং বিশ্বের ওপর হামলা চালানোর জন্য একটি মুক্ত পরিসীমা পাওয়ার বিষয়ে গুরুতর উদ্বেগ জানায়। এতে দাবি করা হয় যে, আফগান ভূখণ্ডকে কোনো দেশকে হুমকি বা আক্রমণ করতে বা সন্ত্রাসীদের আশ্রয় বা প্রশিক্ষণ দিতে, অথবা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা বা অর্থায়নের জন্য ব্যবহার করা হবে না।
এটি ইউএনএসসি রেজুলেশন ১২৬৭ দ্বারা মনোনীত ব্যক্তি এবং সত্তাকে চিহ্নিত করে-যা ভারতের জন্য হুমকি যেমন, লস্কর-ই-তৈয়বা (এল ই টি) এবং জৈশ-ই-মোহাম্মাদ (জেইএম) এর মতো সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দেবে না তালেবান। এছাড়া আফগানিস্তানে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিক প্রতিশ্রুতিগুলি উল্লেখ করা হয়।
অন্যান্য প্রধান মানদণ্ডের মধ্যে রয়েছে, তালিবানরা যেন বিদেশিদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার অনুমতি দেয় এবং ২৭ আগস্টের বিবৃতি মেনে চলে যে আফগানরা যে কোনো সময় বিদেশে ভ্রমণ করতে পারবে এবং যে কোনো সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে প্রস্থান করতে পারবে। এটি সব পক্ষকে জাতিসংঘ এবং সমস্ত মানবিক কর্মীদের ত্রাণ কার্যক্রম, আফগানিস্তান এবং প্রধান আফগান শরণার্থী-আশ্রয়দাতা দেশগুলির জন্য দাতাদের সহায়তা এবং বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষাসহ আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধার জন্য পূর্ণ, নিরাপদ এবং বাধাহীন প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার আহ্বান জানায়।
তালেবানকে নারী, শিশু এবং সংখ্যালঘুদের অধিকারসহ মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে বলা হয়েছিল, যা ভারতের ক্ষেত্রে হিন্দু ও শিখ আফগানদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। সব পক্ষকেই নারীদের সমান অংশগ্রহণে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, আলোচনার রাজনৈতিক সমঝোতা এবং আইনের শাসন এবং মানবাধিকারের বিগত ২০ বছরের প্রপ্তি রক্ষা করতেও বলা হয়।
এগুলোর মাধ্যমে ভারত নিশ্চিত করতে সক্ষম হয় যে, ইউএনএসসি রেজুলেশন ২৫৯৩ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উদীয়মান তালেবান শাসনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে ক্রমবর্ধমান করার জন্য এবং এর জন্য নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে কিছু মৌলিক মানদণ্ড দাঁড় করিয়েছে। এটি তালেবানের কূটনৈতিক স্বীকৃতি এবং অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সমর্থনের পথ।
তবে ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্য হুঁশিয়ার করেছে যে, রেজুলেশন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তালেবান সরকারকে বিচার বিবেচনা করা হবে। আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার রাশিয়ার জন্য ছিল মধুর প্রতিশোধের মুহূর্ত। চীন নতুন, সৌম্য পরাশক্তি হিসেবে গ্র্যান্ডস্ট্যান্ডিংয়ের জন্য প্রস্তাবটি ব্যবহার করেছে। আফগানিস্তানকে "হেজমনিস্টদের" বিরুদ্ধে সমর্থন করেছিল দেশটি।
রাশিয়া এবং চীন উভয়ই নিজেদেরকে তালেবানদের বিজয়ে চ্যাম্পিয়ন হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছিল। যখন আমেরিকার ‘২০ বছরের যুদ্ধে ব্যর্থ হল’ এবং ‘তাড়াহুড়ো করে সেনা প্রত্যাহার’ করে তখন ‘তালেবানের ওপর টেবিল ঘুরিয়ে দেওয়া’ একটি প্রস্তাব সমর্থন করতে অস্বীকার করে। সন্ত্রাস দমনে, তারা সন্ত্রাসীদের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য একটি সুষম দৃষ্টিভঙ্গি পেশ করে। এর মধ্যে পূর্ব তুর্কিস্তান ইসলামী আন্দোলন (ইটিআইএম) ও ছিল। এই আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে, ভারত তাদের রেজুলেউশনে ভেটো না দিতে এবং শুধুমাত্র এড়িয়ে চলতে রাজি করতে সক্ষম হয়েছিল, এটি একটি কূটনৈতিক জয়। ইউএনএসসি- এর সকল সদস্য ভারতের প্রেসিডেন্সির প্রশংসা করেছেন এবং ইউএনএসসি- এর বর্তমান গতিশীলতার জন্য ভারতের অবদান স্বীকার করেছে। যা দেশটির জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্যপদের দাবিকে শক্তিশালী করেছে।
লেখক: লক্ষ্মী পুরী, (জাতিসংঘের সাবেক সহকারী মহাসচিব এবং ইউএন উইমেনের উপ-নির্বাহী পরিচালক)