নীলফামারী: ‘এক মাইয়্যাত কি অ্যায়লান’ অর্থাৎ একটি শোক সংবাদ; অথবা জারুরি অ্যায়লান, মানে জরুরি ঘোষণা- প্রায়ই মাইকে এমন ঘোষণায় সকালের ঘুম ভাঙে উত্তরের বাণিজ্য কেন্দ্র সৈয়দপুরবাসীর। প্রতিটি মাইকিং করা হয় বাংলার পাশাপাশি উর্দুতে।
ভারত বিভাগের পর বিহার রাজ্য থেকে উর্দুভাষী বিহারীরা নীলফামারীর সৈয়দপুর শহরে আসতে শুরু করে। দেশের বৃহত্তম রেলওয়ে কারখানা এখানে অবস্থানের কারণে চাকরি সূত্রে বিহারী পরিবারগুলো শহরের বিভিন্ন স্থানে আস্তানা গড়ে তোলে। ৫২’র ভাষা আন্দোলনের সময় বিহারীদের দাপট এতটাই ছিল, বাঙালিরা তাদের কাছে ছিল অসহায়। সেই থেকে এখন পর্যন্ত শহরটি বাঙালি-বিহারীর মিশ্র শহর হিসেবে বিবেচিত। নতুন কেউ এই শহরে পা রাখলে মনে করেন এটি বোধহয় পাকিস্তান।
বিহার পাকিস্তানের না হলেও দেশটির বহু মুসলিম একটা সময় ভারতের এ অঞ্চলটিতে বসবাস করত। সেখান থেকেই তারা বাংলাদেশের এ অঞ্চলটিতে চলে আসে। ভারত থেকে এলেও তারা মূলত পাকিস্তানি। এখানে তারা বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়ির মালিক হয়েছে। পৌরসভার ১৫টি ওয়ার্ডে তাদের বসবাস। আর পাকিস্তান যেতে ইচ্ছুক নিম্ন আয়ের বিহারীরা শহরের ২২টি আটকেপড়া ক্যাম্পে বসবাস করছেন।
অঞ্চলটিতে তালিকা অনুযায়ী ভোটার সংখ্যা ৮১ হাজার ৩৬৮ জন। এসব ভোটারের মধ্যে প্রায় ৪০ হাজার অবাঙালি (বিহারী)। যদিও এর প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে দ্বিমত আছে। ভোটের সময় এসব নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। এর মধ্যে একজন অবাঙালি পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসাবে নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। এবারের পৌরসভা নির্বাচনে প্রায় হাফ ডজন অবাঙালি কাউন্সিল নির্বাচিত হয়েছেন।
এসব বিহারীরা জাতিগতভাবে পরিশ্রমী। তাই আয়-রোজগারের জন্য যেকোনো পেশা বেছে নিতে তারা কুণ্ঠাবোধ করে না। ক্যাম্পের বিহারীরা মানবেতর জীবন-যাপন করলেও বাইরে বসবাসকারীরা সমাজে ও রাজনৈতিক অঙ্গনে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছেন। স্বাধীনতার পর টিকে থাকার জন্য তারা কৌশল পরিবর্তন করেছেন। বাঙালি পরিবারের সঙ্গে বিয়ে-শাদিসহ নানা সম্পর্ক গড়ে তুলছেন। ছেলে-মেয়েদের শহরের নামীদামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করাচ্ছেন। তাদের ফলাফলও বাঙালিদের চেয়ে ভালো। কেউ কেউ উচ্চ পদস্থ চাকরিও করছেন।
বিয়ে-শাদির ক্ষেত্রে বিহারীরা এখনও তাদের রীতি বহাল রেখেছেন। বিয়ের আমন্ত্রণ পত্রে উর্দু ব্যবহার না করলে বাংলাও ব্যবহার করেন না তারা। এক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করে থাকেন তারা।
বিজয়ের ৫১ বছর অতিবাহিত হলেও বিহারী প্রবীণ ব্যক্তিরা বাঙালিদের ভালো চোখে দেখেন না। এমনকি বাঙালি হকারকে তাদের দোকানের সামনে বসতে দেন না। কোনো প্রয়োজনে কিছু কেনাকাটা করতে হলে তাদের সম্প্রদায়ের লোকজনের দোকানে করে থাকেন। তবে এক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম বর্তমান প্রজন্মের বিহারীরা। তাই ক্যাম্পে বসবাসকারী ও ক্যাম্পের বাইরে অবস্থানকারী কেউ আর পাকিস্তান যেতে চান না। তারা এদেশে পূর্ণ নাগরিক সুযোগ-সুবিধাসহ থাকার ইচ্ছে পোষণ করছেন। শহরে ঝুপড়ি ঘর বিক্রি করে গ্রামে জমি কিনে বসবাস শুরু করেছেন অনেক বিহারী।
এ ব্যাপারে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড সৈয়দপুরের সাবেক কমান্ডার একরামুল হক বলেন, স্বাধীনতার পর বিহারীরা (পাকিস্তানি) এ অঞ্চলে নিজেদের শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে। সৈয়দপুর শহরকে মিনি পাকিস্তান বললেও ভুল হবে না। রাজনীতি, জনপ্রতিনিধি, এমনকি ব্যবসা-বাণিজ্যে বিহারীদের প্রভাব রয়েছে। এক্ষেত্রে স্থানীয় বাঙালিরা কোণঠাসা রয়েছে বরাবরই।
সৈয়দপুর পৌরসভার মেয়র রাফিকা আকতার জাহান বলেন, পৌরসভায় অধিকাংশ অবাঙালি কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। বর্তমানে তারা ভোটাধিকার পেয়েছেন। এমনকি চাকরিতেও সুযোগ পাচ্ছেন। তাদের অবস্থান শক্ত। কিন্তু যেভাবে তারা উর্দু ভাষার ব্যবহার করে যাচ্ছেন, স্বাধীন বাংলাদেশে তা কাম্য নয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৯০৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০২২
এমজে