ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২২ মাঘ ১৪৩১, ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৬ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

শিক্ষা প্রশাসনে দুই অধিদপ্তরের সুপারিশ

ইসমাইল হোসেন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২৫
শিক্ষা প্রশাসনে দুই অধিদপ্তরের সুপারিশ

ঢাকা: মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিবর্তে আলাদা দুটি অধিদপ্তর করার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, কলেজ শিক্ষা অধিদপ্তরসহ শিক্ষা প্রশাসনে নানা সুপারিশ করেছে তারা।

কমিশনের প্রতিবেদনের নির্বাহী সারসংক্ষেপ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন।

বাংলাদেশ শিক্ষা সার্ভিস কমিশন গঠন:

প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়, বিসিএস ক্যাডার বাতিল করে প্রত্যেক সার্ভিসের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নামকরণের সুপারিশ করা হয়েছে। সে অনুযায়ী বিসিএস (শিক্ষা) ক্যাডারের পরিবর্তে ‘বাংলাদেশ শিক্ষা সার্ভিস’ নামকরণ করা হবে। ‘বাংলাদেশ শিক্ষা সার্ভিস- এ’ জনবল নিয়োগ, পদোন্নতি ইত্যাদি পরীক্ষার কাজ সম্পাদনের জন্য আলাদা বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (শিক্ষা) গঠন করার সুপারিশ করা হলো।

নিয়মিত পদোন্নতির ব্যবস্থা:

বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য ৯ম গ্রেড থেকে ১ম গ্রেডে পৌঁছানোর সুযোগসহ নিয়মিত পদোন্নতির ব্যবস্থা রাখার জন্য সুপারিশ করা হলো। এ জন্য একটি পদোন্নতি নীতিমালা প্রণয়ন করা যেতে পারে। পদোন্নতির ভিত্তি হবে দক্ষতা, কর্মদক্ষতা, অভিজ্ঞতা এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা। নতুন শিক্ষা সার্ভিস কমিশনের নিয়ন্ত্রণে পদোন্নতির জন্য পরীক্ষা/মূল্যায়ন পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। শিক্ষা ক্যাডারের অন্তত পাঁচ শতাংশ অধ্যাপককে জাতীয় বেতন স্কেলের দ্বিতীয় গ্রেডে উন্নীত করতে হবে। যারা পিএইচডি ডিগ্রিধারী অধ্যাপক ও অধ্যাপক হিসেবে পাঁচ বছর চাকরি করেছেন এমন অধ্যাপকদেরও মধ্য হতে দ্বিতীয় গ্রেডে উন্নীত হবে বলে সুপারিশে উল্লেখ করা হয়েছে।

বাধ্যতামূলক গবেষণা:

মানসম্পন্ন শিক্ষক তৈরির জন্য সহযোগী অধ্যাপক পর্যায়ে পদোন্নতিতে অন্তত তিনটি মৌলিক গবেষণা এবং অধ্যাপক পদে অন্তত পাঁচটি গবেষণা বাধ্যতামূলক করতে হবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক (ইনডেক্সড) জার্নালে গবেষণা প্রকাশিত হতে হবে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষা প্রশাসন: বাংলাদেশে দুই হাজার ২০০টির অধিক কলেজে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পাঠদান চালু আছে। ঢাকা শহরে অবস্থিত সাতটি কলেজই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত। এসব কলেজের শিক্ষা প্রশাসন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করে এবং শিক্ষার্থীরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই সনদ লাভ করে থাকে। এ বিশ্ববিদ্যালয় কার্যত মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের মতো স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষা বোর্ডের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষত্ব হারিয়ে ফেলেছে। অধিকন্তু এত বিপুল সংখ্যক প্রতিষ্ঠানের ১১টি অনুষদের আওতায় ৪৫টি বিভাগে অধ্যয়নরত প্রায় ৩৪ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে মানসম্মত শিক্ষা প্রদান নিশ্চিত করা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে একটি দুরূহ কাজ। এতে প্রতিনিয়তই মানব সম্পদ বিকাশের প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। যেহেতু বর্তমানে দেশের বিভিন্ন বিভাগ ও জেলায় অনেক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, সেহেতু সংশ্লিষ্ট এলাকার ডিগ্রি পর্যায়ের কলেজগুলোকে ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার জন্য কমিশন সুপারিশ করছে।

বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে একটি করে প্রধান কলেজ নির্বাচন:

বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে একটি করে প্রধান কলেজ নির্বাচন করে সেগুলোকে উচ্চ শিক্ষার বিশেষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা যাতে এগুলো বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের কাছাকাছি হতে পারে। এসব কলেজের প্রাতিষ্ঠানিক ও জনবল সক্ষমতা দ্রুত পরীক্ষা করতে হবে এবং উচ্চ শিক্ষার উপযোগী করার জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করতে হবে। পিএইচডি ডিগ্রিধারী এবং যাদের গবেষণা প্রকাশনা আছে এমন শিক্ষকদের এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ/পদায়ন করতে হবে।

পৃথক মাধ্যমিক অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা:

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে মাধ্যমিক বিভাগকে পৃথক করে আলাদা মাধ্যমিক অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মাধ্যমিক শিক্ষা অঙ্গীভূত থাকার কারণে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা গুরুত্ব পাচ্ছে না এবং ক্রমেই মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার মান কমছে। তাই এটি আলাদা হওয়া গুরুত্বপূর্ণ বলে সুপারিশে উল্লেখ করা হয়েছে।

কলেজ শিক্ষা অধিদপ্তর:

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে মাধ্যমিক বাদ দিয়ে কলেজ শিক্ষা অধিদপ্তর করা যেতে পারে এবং মহাপরিচালকের পদকে গ্রেড-১ এ উন্নীত করা যেতে পারে বলে সুপারিশে উল্লেখ করা হয়েছে।

কলেজ পর্যায়ে অনার্স চালু:

কলেজ পর্যায়ে উচ্চ শিক্ষায় দ্বৈত-শাসন অবসানের লক্ষ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে। অনার্স চালুর জন্য শিক্ষা সচিবের নেতৃত্বে গঠিত একটি কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বেসরকারি কলেজ পর্যায়ে অনার্স চালু যতটুকু সম্ভব সীমিত করতে হবে।

ন্যাশনাল একাডেমি ফর এডুকেশন ম্যানেজমেন্টকে (নায়েম) যুগোপযোগী করতে হবে যাতে শিক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও গবেষণা করতে পারে। বিভাগীয় পর্যায়ে নায়েমের আঞ্চলিক অফিস করা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য সমঝোতা স্মারক করা যেতে পারে বলে সুপারিশে উল্লেখ করা হয়েছে।

কারিগরি শিক্ষার উন্নয়ন:

বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণি থেকে কারিগরি বিষয়ে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। দেশে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ানো এবং পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটসমূহকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। মান সম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। মান উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সহায়তা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে বলে সুপারিশে উল্লেখ করা হয়েছে।

মাদ্রাসা শিক্ষার সংস্কার:

সব বিভাগে সরকারি পর্যায়ে বিশেষায়িত (উচ্চ শিক্ষা) মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। বিভাগীয় পর্যায়ে একটি করে মহিলা সরকারি মাদ্রাসা (ইবতেদায়ি থেকে আলিয়া পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। সব বিভাগীয় পর্যায়ে মাদরাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান তৈরি করা যেতে পারে।

মাদরাসা পর্যায়ে শিক্ষার্থী নিশ্চিতের জন্য ইবতেদায়ি/প্রাথমিক পর্যায়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রদেয় সব সুবিধা নিশ্চিত করা যেতে পারে।

বেসরকারি পর্যায়ের মানসম্পন্ন মাদরাসাগুলোকে বিশেষ মনিটরিং ও বিনিয়োগের মাধ্যমে অধিকতর দক্ষ করা যেতে পারে।

বেসরকারি পর্যায়ে মাদরাসার মানসম্পন্ন অধ্যক্ষ ও শিক্ষক নিয়োগের জন্য নীতিমালা তৈরি করা যেতে পারে বলে সুপারিশ করা হয়।

শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত অনুযায়ী শিক্ষক নিয়োগ:

বর্তমানে দেশে শিক্ষার্থীর অনুপাতে শিক্ষক সংখ্যা খুবই কম। এর ফলে আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে পাঠদান সম্ভব হচ্ছে না। এ সমস্যা দূর করার জন্য শিক্ষা খাতের বাজেট বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য সুপারিশ করা হলো। একই সঙ্গে শিক্ষকদের শূন্য পদ পূরণের জন্য একটি বিশেষ উদ্যোগ নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।

কলেজ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটি গঠন:

মাঠ পর্যায়ে নাগরিক ও শিক্ষকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে প্রতীয়মান হয় যে, কলেজ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটিতে রাজনৈতিক ব্যক্তিরা সংশ্লিষ্ট থাকায় নানারকম সমস্যা হতো। তারা সরকারি অফিসারদের নিয়ে বেসরকারি কলেজ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটি গঠন করার পক্ষে জোরালো মত দিয়েছেন। কমিশন নাগরিক সমাজের মতামতের প্রতি সমর্থন জানায়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের শিক্ষক সংকট:

পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের তিন পার্বত্য জেলা ও উপজেলায় মারাত্মক শিক্ষক সংকট রয়েছে। দুর্গম এলাকা বিধায় সেখানে শিক্ষকরা যেতে চান না। এলাকাবাসীর সুপারিশ মোতাবেক এনটিআরসি চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের মধ্য থেকে শিক্ষক নিয়োগের বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয় বিবেচনা করে দেখতে পারে বলে সুপারিশে উল্লেখ করা হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে আবাসিক বিদ্যালয় স্থাপন:

দুর্গম পার্বত্য এলাকার শিশুদের প্রতিদিন ৫-১০ কিলোমিটার দূর থেকে বিদ্যালয়ে আসা খুবই কঠিন। এ অবস্থা নিরসনে সরকার কয়েকটি এলাকায় আবাসিক বিদ্যালয় স্থাপন করার সুপারিশ বিবেচনা করতে পারে। এছাড়া ভি-স্যাট স্থাপন করে ইন্টারনেট সুবিধা দিয়ে অনলাইন স্কুলও পরিচালনা করা যেতে পারে বলে সুপারিশে উল্লেখ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ২০৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৫, ২০২৫
এমআইএইচ/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।