পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী একটি টেকসই ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে। সরকারের মূল লক্ষ্য হলো, এমন একটি রাজনৈতিক কাঠামো তৈরি করা, যেখানে কর্তৃত্ববাদী প্রবণতার পুনরাবৃত্তি ঘটার সুযোগ থাকবে না।
তুরস্কে চলমান আন্তালিয়া কূটনৈতিক ফোরামে অংশগ্রণের ফাঁকে তুর্কি টেলিভিশন টিআরটি ওয়ার্ল্ডকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন।
সাক্ষাৎকারের প্রশ্নোত্তর পর্বটি বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:
প্রশ্ন: আপনি এখন অন্তর্বর্তী সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শেখ হাসিনা পালানোর পর এই সরকার দায়িত্ব নেয়, (ছাত্রদের পক্ষ থেকে) একটি নতুন সংবিধানের কথা বলা হয়েছে এবং আগাম নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। প্রক্রিয়াটি এখন কোন অবস্থায় রয়েছে?
তৌহিদ হোসেন: আমরা কখনও সরাসরি বলিনি যে অবশ্যই একটি নতুন সংবিধান আসছে। বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত নয়। সিদ্ধান্তটি আসবে জনগণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে— তারা সংস্কার, নাকি পুরোপুরি নতুন সংবিধান চায়। আমাদের দৃষ্টিতে সবচেয়ে জরুরি হলো— যে আইনি ফাঁকফোকরে বিগত সরকার সময়ের সাথে সাথে স্বৈরতন্ত্র কায়েম করতে পেরেছিল, গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেছিল— সেসব যেন আর ফিরে না আসে।
এই সরকার এসেছে মানুষের দাবি মেটাতে। যারা জীবন দিয়েছে, আন্দোলন করেছে, তারা চায় এমন একটি টেকসই ব্যবস্থা তৈরি হোক, যেখানে আর কেউ যেন ক্ষমতার অপব্যবহার করতে না পারে।
ইতিমধ্যে কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে, তারা সুপারিশ জমা দিয়েছে। এখন সেই সুপারিশগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলছে— কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, সেটাই সামনে বড় কাজ।
প্রশ্ন: নির্বাচন বা সংবিধান বদলের বাইরে, আপনার সরকারের অগ্রাধিকার কী?
তৌহিদ হোসেন: সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অর্থনীতি। আগের ১৫ বছরের শাসন আমলে দেশ একপ্রকার লুটপাটের শাসনে পরিণত হয়েছিল। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪২ বিলিয়ন থেকে কমে ২০ বিলিয়নে নেমে আসে। হাজার হাজার কোটি টাকা দেশের বাইরে পাচার হয়ে গেছে। আগের সরকারের অনেক প্রভাবশালী এখন বিদেশে বিলাসবহুল জীবন যাপন করছে। আমরা এখন অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি— বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতে। ব্যাংকগুলো যেন পুনরায় উঠে দাঁড়াতে পারে, তার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা ভালো কাজ করছে। আশা করি, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি দৃশ্যমান হবে।
প্রশ্ন: গত বছরের বিক্ষোভে বহু মানুষ নিহত হয়েছিল। এরপর শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক এখন কোন পর্যায়ে? আপনি কি এখনও আশা করেন যে তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব?
তৌহিদ হোসেন: আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণের অনুরোধ জানিয়েছি। এটা আমাদের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অংশ। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কার— পারস্পরিক স্বার্থ এবং সম্মানের ভিত্তিতে একটি ভারসাম্যপূর্ণ, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চাই।
আমার ধারণা, ভারতও সেই সম্পর্ক চায়। তবে হয়তো নতুন বাস্তবতায় মানিয়ে নিতে তাদের একটু সময় লাগছে। আগের সরকারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক যেরকম ছিল, আমাদের সঙ্গে সেটি হবে না। তবে আমি আশাবাদী— যেহেতু উভয় দেশের মধ্যেই পারস্পরিক স্বার্থ রয়েছে, সম্পর্ক ভালোভাবেই এগিয়ে যাবে।
প্রশ্ন: তাহলে আপনি কি মনে করেন শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণই দুই দেশের সম্পর্কের চাবিকাঠি?
তৌহিদ হোসেন: বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সম্পর্কের সবকিছুই এটা নির্ধারণ করে না। এর বাইরেও আমাদের মধ্যে অর্থনীতি, বাণিজ্য এবং রাজনীতি নিয়ে কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে। সেই সুযোগগুলোকে কাজে লাগিয়ে সম্পর্ক উন্নয়ন সম্ভব।
প্রশ্ন: এ বছরের শুরুর দিকে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত তৈরি হয়। সেই সময় তুরস্কের বাণিজ্যমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করেন। বৈঠকে তিনি একটি প্রস্তাব দেন— যেহেতু বর্তমানে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক কিছুটা অবনতির দিকে, আর দুই দেশের মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক সংযোগ রয়েছে, তাই তুরস্ক এই সংকটকালে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াতে প্রস্তুত। বিশেষ করে যেসব পণ্য সাধারণত ভারত থেকে আসে, কিন্তু সম্পর্কের টানাপোড়েনের কারণে সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে, সেসব পণ্য তুরস্ক সাময়িকভাবে সরবরাহ করতে পারে বলে তিনি ইঙ্গিত দেন।
এই প্রস্তাব আপনার সরকার কীভাবে গ্রহণ করেছে? আর ভবিষ্যতে তুরস্কের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক কীভাবে এগোতে পারে—আপনি কীভাবে দেখছেন?
তৌহিদ হোসেন: তুরস্কের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক একেবারেই স্বতন্ত্র। বাংলাদেশের জনগণের হৃদয়ে তুরস্কের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রয়েছে। আমরা চাই, তুরস্কের সঙ্গে এক শক্তিশালী, দীর্ঘস্থায়ী সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে উঠুক। আশা করি, এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে এবং তুরস্কের সঙ্গে সম্ভাব্য সবক্ষেত্রে সহযোগিতা গড়ে উঠবে। আমরা সেই দিকেই এগোচ্ছি।
প্রশ্ন: জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি বিশেষ চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। দেশের অনেক অঞ্চল নিচু এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ঝুঁকিতে রয়েছে। বর্তমানে দেশের অবস্থা কী? আর আন্তর্জাতিক সহযোগিতার দিক থেকে আপনি কী ধরনের সহায়তা পাচ্ছেন, যা বাংলাদেশকে এই সংকট মোকাবিলায় সহায়তা করতে পারে?
তৌহিদ হোসেন: আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নে আমাদের অবদান খুবই নগণ্য। অথচ এর সবচেয়ে বড় শিকার আমরা। কারণ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে আমাদের বিশাল এলাকা হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। খুব রক্ষণশীল হিসাবেও বলা যায়, আমরা আমাদের মোট ভূমির প্রায় ১১ শতাংশ হারাতে পারি যদি এভাবে চলতে থাকে।
বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়ায় এই ক্ষতির পরিমাণ হবে বিপুল। আমরা এই বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছি এবং তুরস্কসহ অনেক দেশ বলছে যে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধির এই প্রবণতাকে থামাতে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
দুঃখজনকভাবে, বিশ্বের অনেক দেশের কাছে এটা অগ্রাধিকারের বিষয় নয়। এটাই আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা—আমরা এই বিপর্যয়ের কারণ নই, অথচ আমরা এর প্রধান ভুক্তভোগী।
আমি কিছুটা আশাবাদী, পুরোপুরি না হলেও— বিশ্ব এক সময়ে এই বাস্তবতা উপলব্ধি করবে এবং এই দুর্যোগ ঠেকাতে কার্যকর কিছু করবে।
প্রশ্ন: আপনি কি জলবায়ু সম্মেলনগুলো (কপ), জাতিসংঘের বার্ষিক জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে সংস্থাটি যেভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলো নিয়ে সমস্যাগুলো মোকাবিলা করছে, সেই প্রসঙ্গে কিছুটা হতাশ?
তৌহিদ হোসেন: সমস্যা হলো, সবাই সমস্যাগুলো সম্পর্কে জানে এবং কপ সম্মেলনগুলোতে এসব সমস্যা নিয়েও আলোচনা হয়। কীভাবে সমাধান করা যায়, সেটাও আলোচনায় আসে। কিন্তু সমস্যা হলো প্রতিশ্রুতির অভাব— কেউ স্পষ্টভাবে বলে না যে, ‘হ্যাঁ, আমরা এটা করব, এটা বন্ধ করব’। সেখানেই ঘাটতি। এ কারণে এক ধরনের হতাশা তো রয়েই গেছে। কারণ আমরা যেটা করা উচিত, সেটা ঠিকভাবে করছি না।